ময়ুখ চৌধুরীর নীরবতা ছিল

বই আলোচনা

আরফান হাবিব »

বাংলা কবিতার চলমান ধারা যখন চিৎকার, শব্দের হাহাকার আর অনুভূতির ঘূর্ণিতে আবদ্ধ, তখন ময়ুখ চৌধুরীর “নীরবতা ছিল, আজও থাক” গ্রন্থটি যেন এক স্নিগ্ধস্বর হয়ে ধরা দেয়। মাত্র ৪৭ পৃষ্ঠার ক্ষুদ্রাকৃতির হলেও বইটি পাঠকের ভেতরে জাগায় দীর্ঘতর প্রতিধ্বনি-যেখানে নীরবতার গভীরতা এবং মানুষের আত্মসংলাপ একাকার হয়ে যায়।
বইটির শিরোনামই যেন এক স্থির অথচ সজীব অনুভূতির দিকনির্দেশ করে: নীরবতা ছিল, এবং সেই নীরবতা আজও টিকে আছে, হয়তো আরও ঘনীভূত হয়ে। ময়ুখ চৌধুরীর লেখনী ঠিক এই নীরবতার গভীরতা থেকেই উৎসারিত-যেখানে শব্দ নয়, শব্দের ফাঁকে ফাঁকে বিরামগুলোই অধিক অর্থবহ হয়ে ওঠে।
বইটির কবিতাগুলো পড়তে পড়তে মনে হয়, লেখক এক ধরনের নির্জন যুদ্ধ লড়ছেন নিজের সাথেই, আর সেই লড়াইয়ের সাক্ষী হয়ে উঠি আমরা, পাঠকেরা। যেমন একটি কবিতায় তিনি লেখেন:
এখন ভীষণ যুদ্ধে নিজের বিরুদ্ধে তুমি একা
তাই চেয়েছিলে তুমি আমি যেন তোমাকেই ভাবি (অপরাজিতা ভাঁজে)
এখানে ‘তুমি’ কাকে নির্দেশ করে-প্রিয় কোনো মানুষ, নাকি নিজেরই কোনো অতলসত্তা-তা স্পষ্ট না হলেও স্পষ্ট হয় অন্তর্লীন সংঘাত আর একাকীত্বের তীব্রতা।
ময়ুখ চৌধুরীর কবিতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো স্বর, যা একেবারেই স্বতন্ত্র। তাঁর লেখা সহজ নয়, কিন্তু জটিলও নয়; বরং প্রতিটি পংক্তির ভেতরে থাকে একটি আড়াল, একটি গোপন ইঙ্গিত। যেমন:
সহজে যাই না আমি, সহজে হারাই বলে নিজেকে আমার
এখনও নিজেকে খুঁজি বুক পকেটের কাছে পুটোনো জামার। (সহজে হারিয়ে ফেলি)
এই দুই লাইনে ধরা পড়ে আত্মঅনুসন্ধান আর আত্মবিস্মৃতির টানাপোড়েন। কবি স্বীকার করেন যে তিনি সহজে নিজেকে হারান না, কিন্তু হারিয়ে ফেললে আবারো খুঁজে ফেরেন নিজেরই কাছের কোনো স্মৃতিতে, হয়তো কোনো জামার বুক পকেটে লুকনো কাগজে বা গন্ধে। প্রকৃতি ও নিসর্গ ময়ুখ চৌধুরীর কবিতায় শুধু পটভূমি নয়, একধরনের চরিত্র হয়ে ওঠে। যেমন এই পঙক্তিগুলো:
কবে মেঘ নেমে আসবে এই ধরণীতে
বৃষ্টি হয়ে ধুয়ে দেবে কারো জন্মদিন?
ধুরং নদীটা কবে ঝাপ দেবে হালদার বুকে? (কথাগুলো মাটিতে নামাও)
এখানে মেঘ, বৃষ্টি আর নদীর ভাষায় কবি আসলে মানুষের অন্তর্গত আকাঙ্ক্ষা ও অতৃপ্তির কথা বলেন। কারো জন্মদিনে বৃষ্টি ধুয়ে দেবে সব গ্লানি-এ যেন এক ধরনের শুদ্ধির আকাঙ্ক্ষা, আবার নদীর ঝাঁপ দেয়ার মধ্যে আছে স্বতঃস্ফূর্ততা আর উচ্ছ্বাসের কামনা।
ময়ুখ চৌধুরীর কবিতায় রূপান্তর একটি প্রধান থিম। এই রূপান্তর কখনো নিজস্বতা থেকে সামাজিকতার দিকে, কখনো আবার ব্যক্তিগত অবচেতন থেকে সামষ্টিক চেতনায়। তিনি বলেন:
প্রজাতির প্রজাতির প্রকাশিত হও।
শাদামাটা লৌকিক কথার অন্ধকারে
ঢাকা পড়ে আছ তুমি। (মেটামরফোসিস)
এখানে ‘মেটামরফোসিস’ বা রূপান্তর বলতে কবি বুঝিয়েছেন মানুষের আসল স্বরূপকে প্রকাশ করা-যা শাদামাটা, লৌকিক কথার আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকে। এটি শুধু ব্যক্তিগত নয়, এক ধরনের প্রজাতিগত জাগরণের ডাক।
শৈলীর কথা বললে-ময়ুখ চৌধুরীর লেখনীতে সুনিপুণভাবে আসে ছন্দহীন, মুক্তছন্দের বৈচিত্র্য। কবিতাগুলোতে কখনো সংলাপের মতো সরলতা, আবার কখনো গভীর প্রতীক, ইঙ্গিত আর ভাবার্থ। এই বৈপরীত্যই তাঁর কবিতাকে জীবন্ত করে তোলে।
সব মিলিয়ে, “নীরবতা ছিল, আজও থাক” কেবল কবিতার বই নয়; এটি আত্মসংলাপ, আত্মসংঘাত আর আত্ম-উন্মোচনের একটি পরিক্রমা। যারা শব্দের চেয়ে বেশি অনুভব করতে চান, যারা নীরবতার ভেতর থেকেও শব্দ শুনতে চান-তাদের জন্য এ বইটি এক অনন্য প্রাপ্তি।
বই: নীরবতা ছিল, আজও থাক
লেখক: ময়ুখ চৌধুরী
প্রকাশনা: চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন, চট্টগ্রাম
প্রকাশকাল: ২০২৫
প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত
মূল্য: ১৮০ টাকা