নিলা চাকমা »
মনোরোগ চিকিৎসায় পুরো বিভাগের একমাত্র ভরসা হলো ২৩ শয্যার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ৩ নম্বর ওয়ার্ড। এ ওয়ার্ডে মনোরোগে আক্রান্ত ও মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। এখানে দেওয়া হয় শয্যা সংখ্যার প্রায় আড়াই গুণ রোগীর সেবা। অথচ এ ওয়ার্ডে সেবা দিচ্ছেন মাত্র তিনজন চিকিৎসক। নেই পর্যাপ্ত ওয়ার্ডবয় ও আয়া। সবকিছু অপর্যাপ্ত থাকায় রোগীরা যথাযথ সেবা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন তাদের স্বজনরা। অভিযোগ স্বীকার করেই লোকবলসহ ওয়ার্ডের বাজেট বাড়ানোর তাগিদ দেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন মনোরোগ বিভাগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ‘মনোযোগ’ নেই।
সরেজমিনে দেখা যায়, ওয়ার্ডে সেখানে কেউ কেউ অযথা-আনমনে চিৎকার চেঁচামেচি করছে। কেউ আবার আনমনে গান ধরেছে বেসুরো গলায়। কেউ চিকিৎসকের কাছে ছোট্ট শিশুর মতো বায়না ধরেছে। কারো হাত-পা বেঁধে সিটে ফেলে রাখা হয়েছে। কাউকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে ইনজেকশন দিয়ে। এসব পুরোটাই চলছে ঘুটঘুটে অন্ধকার পরিবেশে। শয্যা না পাওয়া রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেতে। এসব দেখে বুঝার উপায় নেই, এটি পরিত্যক্ত ঘর নাকি হাসপাতালের ওর্য়াড। লোকবল বলতে কাজ করছে হাতেগোনা তিন-চারজন। এরমধ্যে নার্স যারা রয়েছেন তাদেরও নেই মনোরোগী সামলানোর তেমন কোনো প্রশিক্ষণ। এরপরও চালু রয়েছে বহির্বিভাগ। যেখানে ১০ টাকার টিকিট কেটে প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ১২০ জন রোগীরা পরামর্শ নেয় চিকিৎসকের। ওয়ার্ডের ভেতরে প্রতিদিন গড়ে ৬০ থেকে ৭০ রোগী ভর্তি থাকে। জায়গা সংকটে শ্রেণিকক্ষেই দেওয়া হয় রোগীদের কাউন্সেলিং।
পটিয়া থেকে চিকিৎসা নিতে আসা এক মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীর মা বলেন, ‘আমরা দু বছর ধরে চিকিৎসা নিচ্ছি। অর্থের অভাবে মাঝখানে চিকিৎসাসেবা দিতে পারিনি। অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় গত ৯ দিন ধরে ভর্তি রয়েছি। আগে এখানে পর্যাপ্ত ওষুধ পাওয়া যেত। কিন্ত এখন প্রায় সবকটি ওষুধ বাইরে থেকে নিতে হচ্ছে। হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার ব্যয় আগের থেকে বেড়েছে দ্বিগুণ-তিনগুণ। হয়তো চিকিৎসাসেবা শেষ না হতেই রোগী বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে।’
লোহাগাড়া আসা আরেক মহিলা বলেন, ‘শুধু ওষুধের সমস্যা তা নয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো স্টাফ নার্সদের ব্যবহার। কারণ একজন সাধারণ রোগীদের সাথে যেভাবে আচরণ করা যায়, আমাদের রোগীদের সাথে ঠিক সেভাবে ব্যবহার করা যায় না। কিন্ত তারা ভালো ব্যবহার করেন না। এতে রোগীদের শান্ত করতে আমাদের সমস্যায় পড়তে হয়। একই সাথে এখানে টয়লেটের অবস্থা একেবারে ব্যবহার অযোগ্য। ধোঁয়া-মোছার যেন কেউ নেই।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ওয়ার্ডবয় বলেন, ‘পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় যে সমস্যায় পড়তে হয় তা বলার ভাষা নেই। এই ওর্য়াডের রোগীরা স্বাভাবিক নয়। এত বড় ওর্য়াডে আমি একজন রয়েছি। আমাকে সাহায্য করার জন্য রয়েছেন দু জন। তারা সকাল বিকাল দায়িত্ব পালন করে। প্রায় সময় রোগীদের সামাল দিতে শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হই। চিকিৎসাও নিতে হয় অনেক সময়। সব মিটিংয়ে স্যারদেরকে বলি লোকবল বাড়িয়ে দেওয়ার। কিন্ত কোনো সমাধান নেই এটার। এভাবে চলছে আামাদের ওর্য়াড।
মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ডা. পঞ্চানন আচার্য বলেন, ‘ওয়ার্ডে সমস্যার শেষ নেই। প্রথমত জনবলের সমস্যা। বর্তমান কাঠামোতে অধ্যাপক একজন, সহযোগী অধ্যাপকের পদ খালি রয়েছে। এছাড়া সহকারী অধ্যাপক পদে তিনজনের মধ্যে শুধু আমি একজন রয়েছি। বাকি পদ খালি পড়ে আছে। কাউন্সেলিং করানো, রোগী দেখা, প্রশাসনিক নানা ধরনের কাজ আমাকে একাই করতে হয়। যেসব কাজ ৬ জনের করার কথা, সেসব আমাকে একা করতে হয়। রেজিস্ট্রার, মেডিক্যাল অফিসার, মিড লেভেল চিকিৎসকের পদ দুটাও খালি আছে। আছে শুধু দুজন। এছাড়া ৮-৯ জন মেডিক্যাল স্টাফ দরকার।
সংকটের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘নার্সের সংকট সব সময় থাকে। বিশেষ করে কর্মক্ষম নার্স। মনো বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স দরকার। নার্স থাকলেও অদক্ষ বলা যায় তাদের, কারণ তাদের বিভিন্ন ওর্য়াড থেকে পাঠানো হয়। সাধারণ রোগীদের সঙ্গে যেভাবে আচরণ করা যায় মনোরোগীদের সাথে সেভাবে আচরণ করা যায় না। রয়েছে ওর্য়াড বয়ের সংকটও। সরকারিভাবে ওর্য়াড বয় রয়েছেন মাত্র একজন। তাকে সহাযোগিতা করার জন্য রয়েছে আরও দুজন। রোগী অনুযায়ী এখানে ৬ থেকে ৭ জন থাকা জরুরি। একজন মানসিক রোগীর চিকিৎসার জন্য বেঁধে রাখা, ওষুধ খাওয়ানোসহ প্রায় সব কাজে আরো জনবল দরকার। ওয়ার্ড বয়ের কাজও অনেক সময় চিকিৎসকদের করতে হয়।’
ওষুধ সংকটের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সরকারি বাজেট অনুসারে যে ওষুধ আসে, এটা দুই-তিন মাসে শেষ হয়ে যায়। ওষুধের জন্য বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিকট আবেদন করা হলেও সংকট কাটছে না। প্রায় প্রতিটি ওষুধ রোগীদের বাইরে থেকে সংগ্রহ করতে হয়। এতে অনেক চিকিৎসা নিতে আগ্রহ দেখায় না। এসব সংকটের সমাধানের জন্য আমাদের ওয়ার্ডে বাজেট বাড়ানো জরুরি। তা না হলে, এ ওয়ার্ডের অবস্থা আরও খারাপ হবে।
এ নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসানের সঙ্গে কথা হলে তিনি ওষুধ সংকটের বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘এই ওয়ার্ডে সব ওষুধ পাঠানো হয়। মানসিক রোগীদের ওষুধটা একটু কন্ট্রোলে রাখতে হয়। কারণ এটাতে বিভিন্ন এডিকশন হয়। ওই ওয়ার্ডের প্রফেসর চাহিদা স্বাক্ষর করে পাঠান। আমি ওই মোতাবেক ওষুধ সরবরাহ করি। যত ওষুধ দরকার তারা তা পান।
জনবল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের মেডিক্যালে জনবল এবং পর্যাপ্ত জায়গা না থাকার সমস্যা রয়েছে। দীর্ঘ সময়ের চেষ্টায় কিছু চিকিৎসক বাড়লেও অন্য স্টাফ বাড়েনি। আর এখন দরকার স্টাফের সংখ্যা বাড়ানো। আগে এত টেস্ট ছিলো না। এখন রোগীদের প্রায় ৭-৮ টা টেস্ট করতে হয়। ওইসব জায়গায় লোকবল দরকার। কিন্তু আমরা পাচ্ছি না। উপর মহল থেকে না আসলে, আমি কিভাবে দেব?’