মধ্যবিত্তের ভরসা এখন মোটা চাল

রাজিব শর্মা »

গত এক মাস ধরেই ঊর্ধ্বমুখী চালের দাম। বলা যায়, প্রায় সব ধরনের চালের দামই বেড়েছে। এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে আমদানিতে কর অব্যাহতির পরও বাজারে এর কোন প্রভাব পড়েনি। বরং উল্টো দিন দিন বেড়েইে চলছে দাম। আগে যেসব মধ্যবিত্তরা সরু চালে অভ্যস্ত ছিল তাদের এখন ভরসা মোটা চাল।
নগরীর বাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরা পর্যায়ে মানভেদে স্বর্ণা, চায়না ও ইরি মানের মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৫৭ থেকে ৬০ টাকায়। আর পাইজাম , ব্রি, আটাশ মানের মাঝারী চাল বিক্রি হয়েছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়। এছাড়া রশিদ, ডায়মন্ড, সাগর, মোজাম্মেল, লিচু, মাহ আমানতসহ ইত্যাদি জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের নাজির ও মিনিকেট মানের সরু চাল বিক্রি হয়েছে ৭৫ থেকে ৮৫ টাকায়। সুপারশপে সুদৃশ্য মোড়কে বিক্রি হওয়া মিনিকেটের দাম আরও বেশি, ৯০ টাকার আশপাশে।
ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্য মতে, গত এক মাসের ব্যবধানে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি প্রায় ৭ থেকে ১০ টাকা। আর বছরের ব্যবধানে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মাঝারি মানের চালের দাম। এসব চাল প্রায় কেজিপ্রতি ১৬ থেকে ১৮ টাকা বেড়েছে।
সরকারি বাজার তদারকি সংস্থার তথ্য মতে, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারিতে এক কেজি সরু চালের সর্বনিম্ন দাম ছিল ৪৫ টাকা, যা এখন প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি বেড়ে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর যেসব মানের চাল সর্বোচ্চ ৬০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছিল, তা এখন ৮৪ টাকা।
এদিকে একেকদিন একেক নিত্যপণ্যের চড়া দরের মধ্যে নাজেহাল মানুষ। তার মধ্যে গত এক মাস ধরে সবজির দাম কিছুটা কমে স্বস্তিতে ফিরলেও চালের দাম লাগামহীন চড়া হওয়াতেই জনমনে নতুন করে বাড়ছে উদ্বেগ। যার ফলে আগে যারা মাঝারি মানের চাল কিনতেন, এসব ক্রেতারা এখন মোটা চাল কিনছেন।
‘মোটা চালই ভরসা’ মন্তব্য করে রেয়াজউদ্দিন বাজারে আসা মো. জামাল বলেন, ‘আগে পরিবারের জন্য কিনতাম সরু ও মাঝারি মানের চাল। এখন দিন দিন যেভাবে চালের দাম বাড়ছে, মোটা চাল কেনা ছাড়া আর উপায় দেখছি না। মোটা চালই বিক্রি করছে ৬৫ টাকা কেজি। এসব চাল গত চার মাস আগেও ৪৫ থেকে ৪৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

চাল নিয়ে রাজনীতিতে অসাধু ব্যবসায়ীরা
রেয়াজউদ্দিন বাজারের মুদি ব্যবসায়ী মো. আবুল ফয়েজ বলেন, ‘প্রতিদিনই চাল আমদানি হচ্ছে, তাহলে দাম বাড়ছে কেন? প্রশাসন খতিয়ে দেখলে সত্যতা বেরিয়ে আসবে।’
ব্যবসায়ী মো. আলী সওদাগর বলেন, ‘বর্তমান চাল নিয়ে ব্যবসায়ীরা রাজনীতি করছে। যা প্রত্যাশা করা যায় না। সবকিছুতে ছাড় দেওয়ার পরও আড়তদারেরা চালের দাম বাড়াবে কেন? ভোক্তাদের নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেশের পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। প্রশাসন চালের আড়তে তদারকি জোরদার করলে তারা প্রকৃত দামে ফিরবে।’
এদিকে চালের দাম বাড়তির বিষয়ে খাতুনগঞ্জের কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হলে, তারা বলেন, ‘ভারত থেকে যেসব চাল আমদানি করা হচ্ছে, তার দাম ওইদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে বাড়তি। সরকার শুল্কতে সুযোগ দিলেও ইতিপূর্বে যেসব চাল আমদানি করতে হয়েছে তার শুল্ক পরিশোধ করছে। যার কারণে আমদানির চাল বাজারে আসার পরও দামে কমতির প্রভাব পড়ছে না।’
এছাড়া আমদানির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রায় কর্পোরেট কোম্পানি। যারা চালের বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে বলে জানান চাক্তায়ের চাল ব্যবসায়ীরা।
অন্যদিকে, দাম বাড়তির কারণে সামাজিক অনুষ্ঠান ছাড়া মাছ-মাংসের তেমন ক্রেতা চাহিদা নেই বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
বাজারে সাইজভেদে তেলাপিয়া ১৫০ থেকে ২২০ টাকা, রুই ২২০ থেকে ৩৫০ টাকা, কাতলা ২৮০ থেকে ৩৮০ টাকা, কালিবাউশ ২৭০ থেকে ৩০০, সিলভার কার্প ১৫০ থেকে ২২০ টাকা, মৃগেল ২০০ থেকে ২৮০ টাকা, ট্যাংরা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, পাঙাশ ১৫০ থেকে ২২০ টাকা, শোল ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা, চাষের শিং ৩২০ থেকে ৪০০ টাকা, দেশী শিং ৬০০ থেকে ৯০০ টাকা, টাকি ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা, পাবদা ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা, মলা ৩০০ থেকে ৩৮০ টাকা, রাজপুঁটি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, কোরাল ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা, রুপচান্দা ৪০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। এছাড়া ইলিশের দামও কিছুটা কমেছে। কেজিপ্রতি ইলিশ সাইজভেদে ৪৫০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। হিসেবে প্রায়সব মাছের দাম কমেছে কেজিতে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। ও ইলিশের দাম কমেছে কেজিতে প্রায় ৩০০ টাকা।
এদিকে সপ্তাহের ব্যবধানে অপরিবর্তিত রয়েছে সকল ধরনের মাংসের বাজার। বাজারে ব্রয়লার মুরগি কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে ১৯০ টাকায়। আর সোনালি মুরগি ৩২০ থেকে ৩৪০ টাকা, লাল কক ৩২০ টাকা, সাদা কক ৩০০ ও লেয়ার ৩৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। আর গরুর মাংস ৭৫০ থেকে ৯৫০ টাকা ও খাসির মাংস এক হাজার ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। হিসেবে সকল ধরনের মুরগি ও গরুর মাংসের দর অপরিবর্তিত থাকলেও খাসির মাংসের দাম কেজিপ্রতি ৫০ টাকা বেড়েছে।

কমেছে সবজি-আলুর দাম
সপ্তাহের ব্যবধানে আরও কমেছে সবজির দাম। বাজারে কেজিপ্রতি ১০ টাকা কমে কাঁচামরিচ বিক্রি হয়েছে ৩০ টাকা, শসা ৩০, বেগুন ২০ থেকে ৩০ টাকা, শিম ২০ থেকে ৩০ টাকা, মিষ্টিকুমড়া ৩০, করলা ৪০, মটরশুঁটি ৭০, টমেটো ১০ থেকে ৩০ টাকা, গাজর ৪০ টাকা, মুলা ১৫, বরবটি ৫০ ও কচুরলতি ৩০ টাকা, বাঁধাকপি ২০ ও ফুলকপি ১৫ পিস, পেঁয়াজ পাতা ১০ থেকে ২০ টাকা, কাঁচকলা ২০ টাকা, লেবু ১৫ টাকা হালি ও লাউ ৩৫ থেকে ৪০ টাকা পিস বিক্রি হয়েছে। এছাড়া আলুর দামও কমেছে। বাজারে কেজিপ্রতি ১০ টাকা কমে মুন্সিগঞ্জের নতুন আলু বিক্রি হয়েছে ২৫ টাকা কেজিতে। কিছু কিছু দোকানে ২০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। আর লাল আলু ৩০ থেকে ৩৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।

আদা ও রসুনের দাম বেড়েছে
এদিকে সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম অপরিবর্তিত থাকলেও আদা ও রসুনের দাম বেড়েছে। প্রতিকেজি দেশি ও আমদানির পেঁয়াজ ৫০ থেকে ৬০ টাকা, দেশি রসুন ২৩৫, চায়না রসুন ২০০ থেকে ২২০ টাকা, ভারতীয় আদা ১০০ থেকে ১২০ টাকা, ভালো মানের চায়না আদা ২০০ থেকে ২২৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
বকসিরহাটের মুদি ও সবজি ব্যবসায়ী মো. রুবেল বলেন, সরবরাহ স্বাভাবিক থাকায় সবজির দাম কমেছে। দাম কমতির চিত্র আরও একমাস দেখা যেতে পারে।

অপরিবর্তিত অনান্য মুদিপণ্যের বাজার
বাজারের প্রায় সব মুদি দোকানের পণ্যের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। মুদির দোকানে ছোট মসুর ডাল ১৩৫ টাকা, মোটা মসুর ডাল ১১০ টাকা, বড় মুগ ডাল ১৪০ টাকা, ছোট মুগ ডাল ১৭০ টাকা, খেসারি ডাল ১১০ টাকা, বুটের ডাল ১৪৫ টাকা, মাষকলাই ডাল ১৯০ টাকা, ডাবলি ৭৫ টাকা, ছোলা ১৩০ টাকা, প্যাকেট পোলাও চাল ১৫০ টাকা, খোলা পোলাও চাল মানভেদে ১১০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। প্যাকেটজাত চিনি ১৩৫ টাকা, খোলা সাদা চিনি ১২৫ টাকা, লাল চিনি বাজার সংকট রয়েছে। এছাড়া দুই কেজি প্যাকেট ময়দা ১৪০ টাকা, আটা দুই কেজির প্যাকেট ১১০ থেকে ১২০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
আমদানি সরবরাহ ভালো থাকা স্বত্ত্বেও গত ছয় মাসে ডালের দাম স্বস্তির পর্যায়ে ফিরেনি। আর গমের আমদানি বাড়ায় দাম কমতির দিকে রয়েছে আটা ও ময়দার বাজার।