হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
আল্লাহ্ তাআলারই সমস্ত প্রশংসা, যিনি আমাদের সৃষ্টি করারও পূর্বে আমাদের হায়াত-মাওত, রিয্ক-দৌলত নির্ধারণ করে দিয়েছেন। জীবন ধারণের সমস্ত উপকরণ আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে রেখেছেন। তিনি সৃষ্টিকর্তা, রিয্কদাতাই শুধু নন, জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেক-যুক্তি দিয়ে তিনি মানুষকে সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। মানুষকেই তিনি নিজ খেলাফতের জন্য নির্বাচিত করেছেন। যে ¯্রষ্টা আমাদেরকে মর্যাদায় অতুলনীয় করেছেন, প্রভুত্বও তাঁরই এবং উপাস্য তিনিই।
আল্লাহ্ এক, অদ্বিতীয়। আসমানে-যমীনে আল্লাহ্ ছাড়া যদি আর কোন শক্তির নিয়ন্ত্রণ থাকতো, তাহলে নির্ঘাত বিপর্যয় সংঘটিত হত। সুরা আম্বিয়ার ২২নম্বর আয়াতে তাঁর একত্বের প্রমাণ তিনি এ মর্মেই দিয়েছেন। তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই, তাঁর কোন শরীক নাই। তাঁর দয়া বা শাস্তি- কোনটাই কেউ ঠেকাবার নেই। আমাদেরকে তাঁর পথে আহ্বানকারী, সত্যের মহিমা প্রচারকারী সায়্যিদুনা হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহরই বান্দা ও তাঁর রাসূল, যিনি ‘সুন্দরতম আদর্শ’ রূপে প্রেরিত হয়েছেন।
আমরা একটি কথা সবাই জানি এবং মানি। তা হলো, এ পৃথিবীতে আমরা কেউই স্থায়ী নই। শত চেষ্টা করেও আমরা আমাদের নির্ধারিত আয়ূ এক সেকেন্ড বাড়াতে পারি না। নিজের হাতে, তিলতিল করে সমস্ত মমতা উজাড় করে দিয়ে সাজানো এই সোনার সংসার ফেলে রেখে আমাদের মৃত্যুর কোলে সমর্পিত হতে হয়। এটাই সত্য, এটাই বাস্তব। পৃথিবীতে আসা-যাওয়ার প্রক্রিয়া সূচিত হয় মা-বাবার সমন্বয়ের মাধ্যমে। পিতার ঔরশ হতে এ ধারার প্রারম্ভ। অনুল্লেখযোগ্য সংক্ষিপ্ততম সময়ে মানব শিশুর ভ্রƒণ সেখান হতে বিচ্যুত হয়ে স্থানান্তরিত হয় এবং মাতৃজঠরে আরেক মেয়াদে তা গঠিত হয়। এরপর দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর মেয়াদে মানবসন্তান বর্ধিত হয়। এ জীবনকাল অতিক্রম করে মানুষের শেষ পরিণতি মৃত্যু। ইসলামী বিশ্বাসমতে এখানেও যাত্রার শেষ পরিণতি নয়। কবর বা বরযখ নামে আরেকটি অবস্থানকাল সবাই অতিক্রম করবে। এরপর কিয়ামত। এরপর হাশর বা বিচারপর্ব, তারপর চূড়ান্ত ঠিকানা স্থিরপূর্বক অনন্ত নিবাস। পর্ব হতে পর্বান্তরে মানুষের এ যাত্রা বিরতির আনুপূর্বিক ধারার বিবরণ পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে দেওয়া হয়েছে। বিবর্তনের এক পর্যায় হতে অন্য পর্যায়ে স্থিতিকাল ক্রমান্বয়ে বাড়ে। তবে সর্বশেষ পরিণতির মেয়াদ অনন্তকালীন।
আল্লাহ্ তাআলা এ প্রসঙ্গে ইরশাদ করেন, ‘তিনি তোমাদেরকে একটি ‘নফস’ (মানবাত্মা) হতে সৃষ্টি করেছেন। অনন্তর, তোমাদের কোনটি স্থায়ী আবাসন, আবার কোনটি স্বল্পমেয়াদী সাময়িক অবস্থান। (একটি স্থায়ী নিবাস, অপরটি অস্থায়ী বা ক্ষণস্থায়ী অবস্থান)। নিঃসন্দেহে আমি প্রমাণাদি বিশদভাবে বর্ণনা করেছি ওই সম্প্রদায়ের জন্য, যারা বুঝতে পারে। মাতৃজঠর থেকে পৃথিবীতে, এখান থেকে কবরে, কবর হতে হাশরে, এরপর হাশর হতে মানুষ তার শান্তির, নয়তো শাস্তির অনন্তকালীন অবস্থান, স্থায়ী নিবাস, ঠিকানা খুঁজে পাবে। স্বল্প বা দীর্ঘ এ মেয়াদগুলো এক পর্যায়ে শেষ হয়ে যাবে। তাই এসব আবাসন ক্ষণস্থায়ী। আমাদের দেখা পৃথিবীর জীবন, পৃথিবীর মেয়াদকালের মধ্যে বুদবুদের মত সামান্যই। পৃথিবীর এ নশ্বর জীবনের চেয়ে পরবর্তীগুলো (অর্থাৎ বরযখ, হাশর পর্যন্ত অবস্থান) আরো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। তাই এই জীবনের সুখ স্থায়ী করতে গিয়ে আমাদের পরবর্তী দীর্ঘতর অবস্থানগুলো শাস্তির মধ্যে স্থির করা নিছক বোকামি।
পৃথিবীর মানুষ পারস্পরিক হক, অধিকার ইত্যাদির ভিত্তিতে দু’ভাগে বিভক্ত। জালিম ও মাজলুম তথা অত্যাচারী ও বঞ্চিত। ‘জুলুম’ শব্দটির অর্থ কোন বস্তুকে তার নির্ধারিত স্থানে না রাখা, অনুচিত জায়গায় সংস্থাপন করা। এটা অভিধানগত অর্থ। ব্যক্তি ভেদে এর অর্থ হতে পারে ভিন্ন ভিন্ন। অর্থাৎ একে যে ব্যক্তির সাথে সম্পর্কিত করা হবে তাঁর মর্যাদাগত অবস্থান ভেদে জুলুম স্বরূপও হবে স্বতন্ত্র। মানুষ আল্লাহ্র সৃষ্টি। ¯্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে হক ও প্রাপ্য থাকে। মানুষ মুখাপেক্ষী, আল্লাহ্ কারো মুখাপেক্ষী নন। তাই, আল্লাহ্র কাছে মানুষের প্রাপ্য বাধ্যতামূলক নয়, তাঁর অনুগ্রহ স্বরূপ। মানুষের অস্তিত্বও আল্লাহ্র দয়ায় সৃষ্ট। আল্লাহ্র ইচ্ছা না হলে আমাদের অস্তিত্বই হতো না। তাঁর ওপর আমাদের আশা ও ভরসা থাকে, অধিকার নয়। কিন্তু, তাঁর প্রতি বিশ্বাস এবং তাঁর সামগ্রিক আনুগত্য করে যাওয়া আমাদের ওপর তাঁর হক। মানুষের মধ্যে একের ওপর অন্যের হক আছে। তা অনাদায় রাখলে অথবা একজনের অধিকার অন্যজনে কেড়ে নিলে, সেটা জুলুম। এর পরিণতি ভয়াবহ।
শেষ বিচারের দিন বান্দার আমল-নামা, কৃতকর্মের নথি হিসাব অনুযায়ী তিন প্রকারের থাকবে। মুমিন-জননী হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাদ্বি.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন, ‘সে দিন বান্দার আমলানামা তিন প্রকারের থাকবে। এক প্রকার, আল্লাহর বান্দার জুলুম। এ বিষয়টি আল্লাহ্ কোন মতে ক্ষমা করবেন না। (অর্থাৎ তাঁর কাছে এ অপরাধ অমার্জনীয়)। সেটা হলো, আল্লাহ্র সাথে কাউকে বা অন্যকোন কিছুকেই শরীক করা। আল্লাহ্ নিজে বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ্ তাঁর সাথে কাউকে শরীক করা ক্ষমা করবেন না’।। আরেক প্রকার নথি, যাতে লিপিবদ্ধ অপরাধ, যেটার হিসাব বা দাবি আল্লাহ্ ছাড়বেন না। তা হলো, পারস্পরিক ব্যাপারে বান্দার হক। যতক্ষণ না, পাওনাদারের হক বা বদলা মিটিয়ে দেয়া হবে। আরেকটি ব্যাপারে আল্লাহ্ পরোয়া করেন না। এ নথি হলো আল্লাহ্ ও বান্দার মধ্যেকার, অর্থাৎ বান্দার ওপর তাঁর হক। তা একান্তই আল্লাহ্র ইচ্ছা, চাইলে তিনি আযাব দিতে পারেন, ইচ্ছা হলে ক্ষমাও করে দিতে পারেন’। (মিশকাতুল মাসাবীহ্, পৃ.৪৩৫)
বান্দার হক বান্দা যতক্ষণ ক্ষমা করবে না, ততক্ষণ আল্লাহ্ও ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ্র হক তিনি ইচ্ছা করলে ক্ষমা করবেন, নইলে অবধারিত শাস্তি। শির্কের অপরাধ তিনি ক্ষমা করেন না, এটা তাঁর ঘোষণা, যা পবিত্র কুরআনে দু’বার উল্লেখ হয়েছে। সুরা নিসার ৪৮তম আয়াতে এবং ১১৬তম আয়াতে জুলুম’র যত প্রকার আছে, তন্মধ্যে সবচেয়ে বড় জুলুম আল্লাহ্র সাথে সমকক্ষ বা শরীক স্থির করা, যা তিনি ক্ষমা করবেন না।
এক বর্ণনায় এমনও রয়েছে যে, পাওনাদারেরা সে দিন জালেমের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধরে টানাটানি করে নিজ নিজ পাওনা দিতে বলবে, তখন জালিমের অবস্থা হবে ছিঁড়ে যাবার উপক্রম। কারো আত্মসাতের টাকা দিয়ে মসজিদ তৈরি করলে পুণ্য তো হবেই না; বরং পুণ্যের প্রত্যাশা করলে কুফরী হবে। সামান্য কয় বছরের আয়ু নিয়ে আমাদের দুনিয়াতে আসা, যা কাক্সিক্ষত পরিমাণ কামাই করতে করতেই আমাদের জীবনের পড়ন্ত বেলা এসে যায়, ভোগেরও কোন অবকাশ মিলে না। সেই দুনিয়ার সুখভোগের জন্য অপরের ওপর জুলুম করে অন্যের অধিকার বা প্রাপ্য আত্মসাৎ করে অনন্তকালের জন্য শাস্তি বরাদ্দ করা কেন?
গাউসুল আ’যম বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জীলানী (রাদ্বি.)’র খেদমতে একবার বাগদাদের খলীফা মুস্তানজিদ বিল্লাহ আবুল মুযাফফর ইউসুফ হাযির হলেন। গাউসে পাককে সালাম আরয করে নসীহত চাইলেন। আর তাঁর সামনে দশ থলে আশরাফী (স্বর্ণমুদ্রা) নযরানা রাখলেন। তিনি (গাউসে পাক) তা গ্রহণ করলেন না। প্রত্যাখ্যান করলেন তাঁর উপঢৌকন। তারপরও যখন খলীফা বারবার তাগাদা দিচ্ছিলেন, তখন তিনি একটি থলে ডান হাতে ও আর একটি থলে বাম হাতে নিয়ে দুটোকেই একত্র করে রগড়াতে শুরু করলেন। এর ফলে দেখা গেল, ওখান থেকে রক্ত টপকে পড়তে লাগল। খলীফা অবাক চোখে চেয়ে রইলেন। গাউসে পাক বললেন, ‘হে আবুল মুযাফফর, আল্লাহ্কে ভয় করছো না, প্রজাদের রক্ত চোষণ করে তা আমার কাছে নিয়ে এসেছো নযরানা দিতে। যদি নবী ঘরানার সাথে তোমার সম্পর্কের বিষয়ে লক্ষ্য না থাকত, তবে এ রক্ত তোমার শাহী মহল পর্যন্ত বইয়ে দিতাম’। যেখানে খলীফা পর্যন্ত পরের হক থেকে ছাড় পাবে না, সেখানে সাধারণ বান্দাদের মুক্তি কীভাবে? রাসূলের সতর্কবাণী দিয়ে শেষ করি, ‘মজলুমের অভিশাপ হতে বাঁচো’।
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।