কাজী মুহাম্মদ মঈন উদ্দিন আশরাফী »
উপমহাদেশে ইসলাম এর প্রচার-প্রসারের অনন্য কৃতিত্ব আউলিয়া কেরামের। এ বাস্তব সত্যটি ঐতিহাসিক ভাবে স্বীকৃত যা অস্বীকার করার সুযোগ কারো নেই। উপমহাদেশের মুসলমানগণ ঈমান, ইসলাম লাভে যাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ, আজ তাঁদের অন্যতম পুরোধা, সুলতান হযরত মীর আওহাদ আদ-দীন সাইয়্যেদ মখদুম আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী (রহ.) এর ৬৩৯ তম পবিত্র ওফাত দিবস। ভারতের উত্তর প্রদেশস্থ ফয়েজাবাদ জেলার “কাছাউছা শরীফে” মহাসমোরহে অনুষ্ঠিত হচ্ছে তাঁর পবিত্র ওরশ শরীফ।
তিনি ৭০৮ হিজরি সনে বর্তমান খোরাসানের সিমনান প্রদেশে জন্মগ্রহন করেন, যা ইরানের বর্তমান রাজধানী তেহরানে থেকে ২০০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত । তাঁর পিতা ছিলেন সুলতান সাইয়্যেদ ইব্রাহিম নুর বকশী (রহ.)। তাঁর মাতা সাইয়্যেদা খাদিজা (রহ.) ছিলেন বিখ্যাত সুফী এবং দরবেশ খাজা আহমদ বসভী (রহ.) এর পুণ্যবতী বংশধর।
যথাসময়ে তাঁর পিতা সুন্নত মোতাবেক হযরতের “ছবকদান” অনুষ্ঠান করেন এবং যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের তাঁর শিক্ষাদানের দায়িত্বে নিয়োগ দেন। তন্মধ্যে কয়েকজন হলেন হযরত শায়খ রুকনুদ্দীন আলাউদ্দীন সিমনানী , হযরত শায়খ আব্দুর রাজ্জাক কাশিউল কাশানী, হযরত ইমাম আব্দুল্লাহ ইয়াফেয়ী ও হযরত সাইয়্যেদ আলী হামদানী প্রমুখ। তিনি বর্ণনাতীত মেধাবী ছিলেন। তিনি মাত্র সাত বছর বয়সে পবিত্র কুরআনুল কারীম “কেরাতে ছাবা” তথা সাত ক্বেরাত সহকারে হিফজ সম্পন্ন করেন। । এটি সমাপ্ত করার পর, তিনি ধর্মতত্ত্বের বিভিন্ন শাখা যেমন তাফসীর, হাদীস , ফিকাহ (ইসলামী আইনশাস্ত্র) এবং অন্যান্য সহযোগী বিষয়ের শিক্ষায় নিযুক্ত হন। তিনি চৌদ্দ বছর বয়সে ইসলামী শিক্ষার এ সকল শাখায় পূর্ণ দক্ষতা অর্জন করেন। একজন দক্ষ ইসলামিক স্কলার হিসেবে তার নাম ও খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পরে।
পিতার ইন্তেকালের পর, সুলতান সাইয়্যেদ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানি (রহ.) ১৫ বছর বয়সে সিমনানের সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনি অত্যন্ত ন্যায়পরায়নতা ও দক্ষতার সাথে শাসন করেছিলেন। তিনি সিমনানে একজন সত্য, আন্তরিক এবং ন্যায়পরায়ণ রাজা হিসাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তাঁর শাসনামলে সর্বত্র শান্তি বিরাজ করছিল, প্রজারা ছিল সমৃদ্ধ ও সুখী।
খোদাপ্রেমে বিভোর হয়ে একসময় এ মহান সুলতান সিংহাসন পরিত্যাগ করেন। আধ্যাত্নিক জগতের টানে ব্যাকুল হয়ে উঠেন তিনি। অতঃপর ২৫ বছর বয়সে ২৭ এ রমজান শবে কদর রাতে হযরত খাজা খিজির (আঃ) তাঁকে সিংহাসন ত্যাগ করে যোগ্য পীর মুর্শীদের খোজে হিন্দুস্তানের দিকে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেন। এরপর ৭৩৩ হিঃ সনে শ্রদ্ধেয়া মা সাইয়্যেদা খাদিজার অনুমতি নিয়ে তিনি স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রের ভার তার ছোট ভাই সুলতান মোহাম্মদ আরাফ এর হাতে অর্পণ করেন ।
রাজকীয় সকল সুযোগ সুবিধা, এমনকি আরোহনের ঘোড়াটিও সদকা করে পদব্রজে রওনা করেন হিন্দুস্তানের দিকে। যাত্রাপথে পাকিস্তানের মুলতানে তিনি হযরত জালাল উদ্দিন বুখারী জাহানিয়া জাহাগাস্ত (রহ.) এর সাথে সাক্ষাত করেন ও রুহানী ফয়েজ লাভ করেন। তিনি তাকে বিদায় জানিয়ে বলেন, “এই যাত্রায় অভিনন্দন; বাংলার পান্ডুয়ায় শায়খ আলাউদ্দীন গাঞ্জেনাবাত (রহ.) আপনার আগমনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন; পথে দেরি করবেন না।“
অনেক পথ পেরিয়ে অবশেষে তিনি মঞ্জিলে মকসুদে পৌছান এবং হযরত আলাউদ্দীন গাঞ্জেনাবাত (রহ.) এর পবিত্র হাতে বায়াত গ্রহণপূর্বক আধ্যাত্নিক অপূর্ব নেয়ামত লাভ করেন। একসময় তাঁর পীর ও মুর্শীদ হযরত আলাউদ্দীন গাঞ্জেনাবাত (রহ.) তাঁকে অদৃশ্য ইংগিতে “জাহাঙ্গীর” উপাধিতে ভুষিত করেন।
অতঃপর তিনি শরীয়ত ও তরীকতের মহান দায়িত্ব পালনে আত্ননিয়োগ করেন। সুলতান সাইয়্যেদ আশরাফ জাহাঙ্গীর সেমনানি একজন আকর্ষণী শক্তি সম্পন্ন আধ্যাত্মিক পুরুষ ছিলেন যার শিক্ষা ইসলামের নিগুঢ়, রহস্যময় অংশের উপর জোর দিত। তাঁর গভীর আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি এবং সুফিবাদের অনুশীলন অসংখ্য অনুসারীকে আকৃষ্ট করেছিল, যা ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামী আধ্যাত্মিকতার প্রসারে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিল।
তিনি বেশ কয়েকটি খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন যা আধ্যাত্মিক শিক্ষা এবং সমাজ সেবার কেন্দ্র হয়ে উঠে। এই খানকাহগুলি ধর্মীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হিসাবে কাজ করে, ইসলামী শিক্ষা এবং সুফি চর্চার প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
একজন নিবেদিতপ্রাণ ধর্মপ্রচারক হিসেবে তিনি ইসলাম ও সুফিবাদের বার্তা প্রচারে ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেছিলেন। তার অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের বিভিন্ন পটভূমির লোকেদের সাথে অনুরণিত হয়েছিল, যা মানুষকে ইসলাম গ্রহনে অনুপ্রাণিত করে এবং ইসলামী আধ্যাত্মিকতার ব্যাপ্তি হয় আরো সুদূরপ্রসারী। তিনি আরব ও আজমের অধিকাংশ দেশে ভ্রমণ করেন এবং ইসলাম ধর্মতত্ত্বকে স্পষ্টভাবে প্রচার ও উপস্থাপনের মাধ্যমে হাজার হাজার বিপথগামী মানুষকে সঠিক পথে নিয়ে আসেন। আরবি, ফারসি ও তুর্কি ভাষার উপর তার পূর্ণ কর্তৃত্ব ছিল যার ফলস্বরূপ তিনি অত্যন্ত প্রভাব বিস্তারকারী ভাষন দিতেন যাতে শ্রোতারা আধ্যাত্মিকতা ও আল্লাহর একত্ববাদের জগতে হারিয়ে যেতেন।
সুলতান সাইয়্যেদ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী শুধু একজন মহান ওলীই নন, তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ বক্তা এবং একজন অনবদ্য লেখক। তিনি ইসলামী ও সুফি সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তার লেখা কিতাবগুলি বুদ্ধিবৃত্তিক এবং আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে সুফিবাদ এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্বের নীতিগুলিকে শক্তিশালী করেছে। তিনি যে ধর্মীয় ও সাহিত্যিক সেবা করেছেন তা ইসলামের এবং বিশেষ করে সুফিবাদের ইতিহাসে সোনালী অধ্যায় হিসেবে থাকবে। তিনি কাছাউছা শরীফে আধ্যাত্মিকতার প্রদীপ জ্বালিয়ে এবং কুফরের অন্ধকার দূরীভূত করে বিপথগামী মানুষকে সঠিক পথে নিয়ে এসেছেন। বর্ণিত আছে যে, হাজার হাজার অবিশ্বাসী তার চরিত্রের পবিত্রতা এবং আধ্যাত্মিকতার উচ্চতায় মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলো। তিনি একজন মহান সুফি ছিলেন। ইসলাম ধর্মতত্ত্বের বিভিন্ন শাখায় অকল্পনীয় দক্ষতার অধিকারী ইসলামের একজন বিখ্যাত আলেমও ছিলেন। হযরত নিজাম ইয়ামানি(রঃ) তার কিতাব লতায়েফে আশরাফীতে লিখেছেন যে, তিনি যেখানেই গেছেন সে এলাকার ভাষায় ভাষণ দিয়েছেন এবং সেই ভাষায় বই লিখেছেন এবং লিখিত বইগুলো তাদের উপকারের জন্য সেখানে রেখে গেছেন।
তিনি ৭৭১ হিজরি ১লা রজব গাউসিয়ত এর মহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন। এ মহান ওলি ২৮শে মুহররম ৮০৮ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।
সিলসিলা: সুলতান সাইয়্যেদ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানীর প্রতিষ্ঠিত আশরাফিয়া সিলসিলা দিন দিন প্রসার লাভ করে চলেছে। তার বংশধর এবং শিষ্যরা তার শিক্ষাকে সংরক্ষণ ও প্রচার করে চলেছেন, যার মাধ্যমে একটি প্রাণবন্ত আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য বজায় রয়েছে যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বিস্তৃত।
প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে এ সিলসিলার মাশায়েখদের আগমন প্রায় শত বৎসর পুর্বে। সর্বপ্রথম আসেন বর্তমান সাজ্জাদনশীন এর পরদাদা আলে রাসুল (ﷺ),আওলাদে গাউসে পাক, সাইয়্যেদুল মুনাযেরীন হযরত আল্লামা সাইয়্যেদ আহমদ আশরাফ আশরাফী জিলানী (রহ.)। ভাটি অঞ্চল তথা কিশোরগঞ্জ ,অষ্টগ্রাম এবং তাঁর আশেপাশে তাঁরা প্রথম আসেন এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য অঞ্চলেও হেদায়েতের বাণী পৌছে দেন।
কাছাউছা শরীফ : ভারতের উত্তর প্রদেশের কাছাউছা শরীফে সুলতান সাইয়্যেদ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানীর মাজারটি একটি উল্লেখযোগ্য তীর্থস্থান হিসেবে খ্যাতিমান। আধ্যাত্মিক আশীর্বাদ এবং শিক্ষার খোঁজে হাজার হাজার ভক্ত এই পবিত্র মাজারে যান। এ দরবারের সাজ্জাদনশীন হওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম শর্ত হচ্ছে তিনি এমন মাপের আলেম হতে হবে, যিনি সহীহ বুখারি শরীফ পাঠদানে সক্ষম। দক্ষ আলেম দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় এ দরবার শরীয়ত বিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে সর্বদা পবিত্র থাকে।
সুলতান সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী ব্যাক্তিজীবনে মুজাররাদ তথা চিরকুমার ছিলেন। বর্তমান আস্তানা শরীফে যাদের মাধ্যমে শরীয়ত-তরীকত ও আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অসাধারণ খেদমত হচ্ছে তাঁরা হলেন তাঁর স্থলাভিষিক্ত হুজুর গাউসে আযম দস্তগীর (রঃ) এর বংশধর হজরত সাইয়্যেদ আব্দুর রাজ্জাক নুরুল আইন (রহ.) এর বংশধর। এ হিসেবে কাছাউছা শরীফের পীরানে কেরাম আলে রাসুল (ﷺ) ও আওলাদে গাউসে আযম (রা.)। এ দরবারে ইতিহাস প্রায় ৭০০ বছরের অধিককালের। উপমহাদেশের সর্বজন স্বীকৃত আলেমগণ এই দরবারের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল।
শায়খ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দেসে দেহলভী আখবারুল আখইয়ারে তাঁর সম্পর্কে গুরুত্ব সহকারে আলোচনা পেশ করেছেন। একইভাবে আল্লামা আব্দুর রহমান চিশতি “মিরআতুল আসরার” এ, অধ্যাপক গোলাম সাকলাইন তাঁর সুফী সাধক নিয়ে রচিত ,ইসলামিক ফাউন্ডেশন কতৃক প্রকাশিত গ্রন্থেও আলোচনা করেছেন। আলা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান বেরলভী (রহ.) এই দরবারের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সদরুল আফাযিল আল্লামা সাইয়্যেরদ নইমুদ্দীন মুরাদাবাদী (রহ.) এবং হাক্বীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী আশরাফী (রহ.) সিলসিলা এ কাদেরীয়া-চিশতীয়া আশরাফীয়ার মুরীদ এবং এ দরবারের খলিফা ছিলেন। মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী আশরাফী (রহ.) ক্তৃক লিখিত “তাফসীরে নঈমী” এর আসল নাম “আশরাফুত তাফাসীর” মাখদুম আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী (রহ.) এর পবিত্র নামে নামকরণ করা হয়েছে।
সুলতান সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানীর শিক্ষা ভালবাসা, সহনশীলতা এবং ঐক্যের মূল্যবোধকে উন্নীত করেছে, যা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সুন্দর সহাবস্থানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তার সিলসিলা সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে একীভূত করার প্রচেষ্টায় নিবেদিত, যা সর্বদা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বোধ জাগিয়ে তোলার উপর জোড় দিয়েছে।
তাঁর প্রভাব উপমহাদেশের অন্যান্য সুফি সিলসিলায় ও প্রসারিত হয়েছিল। তিনি যে নীতি ও অনুশীলনগুলি শিক্ষা দিয়েছিলেন তা দক্ষিণ এশীয় সুফিবাদের বিস্তৃত টেপেস্ট্রিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, এর আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
আশরাফি সিলসিলার বর্তমান মিশন
শান্তি ও সহনশীলতার প্রচার : আশরাফি সিলসিলা শান্তি, সহনশীলতার জন্য নিরন্তর কাজ করে চলেছে। বিভিন্ন কর্মসূচি এবং উদ্যোগের মাধ্যমে ইসলাম এবং সুফীবাদের সঠিক রুপ প্রচার করে যাচ্ছে । আশরাফি মিশন ধর্মের নামে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এবং ইসলামের বিভিন্ন বাতিল ফিরকার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে যুগে যুগে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা পালন করেছে।
হুজুর মখদুম সৈয়দ আশরাফি জাহাঙ্গীর সিমনানী (রহ.) এর ইন্তেকালের পর উনার সাজ্জাদানশীন, আলে রাসূল আওলাদে গাউছুল আজম সৈয়দ আবদুর রাজ্জাক নূরুল আইন (রহ.) এবং তাঁর আওলাদগণের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী এই সিলসিলার কার্যক্রমত্মমানুষকে ইসলামের পথে, শরীয়ত ও তরিকতের পথে আনয়নের এবং পরিচালনার কাজ আজও অত্যন্ত জোরালোভাবে অব্যহত।
এই ধারাবাহিকতায় কাছাউছা শরীফের বর্তমান সাজ্জাদানশীন বিশ্বের ৪৪টি দেশে এই সিলসিলার কার্যক্রম পরিচালনা করছেন শরিয়ত ও তরিকতের প্রচার-প্রসার এবং দ্বীনি ইলম ও আধুনিক শিক্ষার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
বর্তমান সাজ্জাদানশীনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
বিশ্বব্যাপী শরীয়ত ও তরিকতের অন্যতম কেন্দ্র ভারতের কাছাউছা শরীফ এর বর্তমান সাজ্জাদানশীন হলেন:
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ৪০তম এবং গাউছুল আজম (রহ.)-এর ২৭তম বংশধর,
কায়েদে মিল্লাত, শায়খে তরিকত, রাহনুমায়ে আহলে সুন্নাত, আল্লামা মুফতি আবুল মোখতার সৈয়দ শাহ মুহাম্মদ মাহমুদ আশরাফ আশরাফি আল জিলানী (ম.জি.আ.)।
তিনি ৭ই জুলাই ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে সম্মানিত পিতা শায়খে আজম আল্লামা সৈয়দ ইজহার আশরাফ (রহ.) ও মাতা সৈয়দা নুজহাত ফাতেমা (রহ.) এর ঘরে কাছাউছা শরীফে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর দাদা যুগশ্রেষ্ঠ অলী,শায়খুল হাদীস হুজুরে সরকারে কাঁলা আল্লামা সৈয়দ মুখতার আশরাফ আশরাফী আল জিলানী (রহ.) এর বিশেষ দোয়ার বরকতে তিনি জামেয়া নঈমিয়া মুরাদাবাদ ও ভারতের অন্যতম বিখ্যাত দ্বীনী প্রতিষ্ঠান জামে আশরাফ থেকে দ্বীনি ইলম অর্জন করেন। ১৪১০ হিজরিতে দাদার হাত থেকে দস্তারে ফজীলত তথা ইসলামী শিক্ষার সর্বোচ্চ সনদ অর্জন করেন।
পরে উত্তরপ্রদেশের আউধ বিশ্ববিদ্যালয়” থেকে বি.এ. এবং বিখ্যাত আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।
খিলাফত ও দাওয়াতের যাত্রা :
হুজুরে কায়েদে মিল্লাত তাঁর শিক্ষা জীবন শেষ করে জামে আশরাফ-এ এক বছর ফি সাবিলিল্লাহ শিক্ষকতা করেন।
তিনি তাঁর সম্মানিত দাদা সরকারে কাঁলা (রহ.)-এর নিকট সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়া মুনাওয়ারিয়া মুয়াম্মারিয়া তরিকায় বায়আত গ্রহণ করেন। এরপর দাদাজান হতে মাহবুবে ইলাহি হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া (রহ.) দরবার থেকে ইজাজত ও খেলাফত লাভ করেন।
পরবর্তীতে তিনি তাঁর সম্মানিত পিতা মাখদুমুল উলামা শায়খে আজম (রহ.) এর নিকট থেকে সিলসিলায়ে কাদেরিয়া, চিশতিয়া, আশরাফিয়া তরিকায় বায়আত গ্রহণ করে ইজাজত ও খেলাফত অর্জন করেন।
দ্বীন ও শরিয়তের খেদমতঃ তিনি তাঁর দাদা মখদুমুল মাশায়েখ সরকারে কাঁলা (রহ.) এবং পিতা শায়খে আজম (রহ.) এর রুহানি ফয়েজ ও বরকতে বিশ্বব্যাপী দ্বীন ও শরীয়তের খেদমতে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন এবং ইসলাম প্রচার ও প্রসারে অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন।
এই ধারাবাহিকতায়, ২০১২ সালের ২২শে ডিসেম্বর (২৯শে রবিউল আউয়াল ১৪৩৩ হিজরী) কাছাউছা শরীফের সাজ্জাদানশীন অবস্থায় থাকাকালে তাঁর সম্মানিত পিতা শায়খে আজম (রহ.) ইন্তেকাল করেন। এরপর কাছাউদা দরবার শরীফের চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী ২০১২ সালের ১লা জুন তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সাজ্জাদানশীন হিসেবে অভিষিক্ত হন।
হুজুর কায়েদে মিল্লাত আল্লামা সৈয়দ মাহমুদ আশরাফ (ম.জি.আ.)সাজ্জাদানশীন হওয়ার পর থেকে ইসলাম ধর্মের মহান বার্তা যুগোপযোগী পদ্ধতিতে, আধুনিক তথ্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বব্যাপী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে নানাবিধ প্রকল্প গ্রহণ করেন এবং সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে থাকেন।
এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তিনি মুম্বাইতে “আহলে সুন্নাত রিসার্চ সেন্টার” প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমে সময়োপযোগী বিভিন্ন বিষয়ের উপর বিভিন্ন ভাষায় পুস্তক প্রকাশ করতে থাকেন।
তিনি পাশাপাশি কাছাউছা শরীফে “সৈয়দ মাহমুদ আশরাফ দারুত তাহকিক” প্রতিষ্ঠা করেন।
বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার-প্রসার, ইসলামি শিক্ষার বিস্তার এবং মানবতার কল্যাণের নিমিত্তে হুজুরে কায়েদে মিল্লাত প্রতিষ্ঠা করেন “ আনজুমানে আশরাফিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট”।
এই ট্রাস্টের মাধ্যমে তিনি বর্তমান বিশ্বের ৪৪টি দেশে ইসলামের খেদমত এবং মানবতার কল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছেন।
ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ ছাড়াও কাছাউছা দরবার শরীফে তিনি এশিয়াখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামে আশরাফ পরিচালনা করছেন।
তিনি আরো প্রতিষ্ঠা করেছেন:
• মাখদুম আশরাফ মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজ
• ইসলামিক গার্লস কলেজ
• মডার্নাইজেশন অব জামে আশরাফ উইথ ইনফরমেশন অ্যান্ড টেকনোলজি
• বেকার মুসলিম যুবকদের জন্য কর্মসংস্থান প্রকল্প
• আহলে সুন্নাত রিসার্চ সেন্টার ।
বাংলাদেশে সিলসিলায়ে আশরাফিয়ার বর্তমান অবস্থা:
মহান আল্লাহর মেহেরবানিতে হুজুরে কায়েদে মিল্লাতের পরদাদা এই বাংলাদেশে
সিলসিলায়ে আশরাফিয়ার যে বীজ বপন করেছিলেন, তা আজ ফুলে ফলে সু-শোভিত
হচ্ছে। বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী, পাবনা, হবিগঞ্জ, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর, সিলেট এই সব জেলা সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এই সিলসিলার কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। আনজুমানে আশরাফিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট (বাংলাদেশ) এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত কিছু প্রতিষ্ঠান :
• জামে আশরাফ ইজহারুল উলুম, মুখতারুল মসজিদ – আশুলিয়া, ঢাকা
• খানকায়ে আশরাফিয়া সরকারে কাঁলা ু মগবাজার
• আশরাফিয়া ওসমানিয়া হানাফিয়া সুন্নিয়া মাদরাসা, হিফজখানা, এতিমখানা – হালিশহর, চট্টগ্রাম
• আশরাফিয়া মাহমুদুল উলুম সুন্নিয়া মাদরাসা, হিফজখানা, এতিমখানা – বরিশাল
• আশরাফিয়া মাহমুদুল উলুম সুন্নিয়া মাদরাসা- আজমিরিগঞ্জ, হবিগঞ্জ।
• আশরাফিয়া মুখতারুল উলুম সুন্নিয়া মাদরাসা, হিফজখানা, এতিমখানা ু কিশোরগঞ্জ
• এছাড়া সৈয়দপুর-নীলফামারী, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পাটুরিয়া-রাজশাহী বিভিন্ন জেলা ও শহরে অসংখ্য দ্বীনী ও সেবামুলক প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে।
সামাজিক ও মানবিক কার্যক্রম:
• রক্তদান কর্মসূচি
• বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ
• রমজানে ইফতার সামগ্রী বিতরণ
• ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প
• অসহায়দের আর্থিক সহায়তা
• দ্বীনি খেদমত ও মানবতার সেবায় নিয়োজিত অগণিত স্বেচ্ছাসেবক।
আল্লাহ তাআলা কাছাউছা শরীফের সাজ্জাদানশীন হুজুরে কায়েদে মিল্লাত এর নির্দেশনায় সিলসিলার কার্যক্রম যেন আরও বিস্তৃত হয় সে তাওফিক আমাদের সবাইকে দান করুন। আমীন।
লেখক : খলিফা, হুজুর সরকারে কাঁলা আল্লামা সৈয়দ মুখতার আশরাফ আশরাফী আল জিলানী (রহ.),
শায়খুল হাদীস, ছোবহানিয়া কামিল মাদরাসা, চট্টগ্রাম।
চেয়ারম্যান, আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত, বাংলাদেশ।