কাজী মুহম্মদ মুঈন উদ্দিন আশরাফী »
উপমহাদেশে ইসলাম এর প্রচার-প্রসারের অনন্য কৃতিত্ব আউলিয়া কেরামের। এ বাস্তব সত্যটি ঐতিহাসিকভাবে স্বীকার যা অস্বীকার করার সুযোগ কারো নেই। উপমহাদেশের মুসলমানগণ ঈমান, ইসলাম লাভে যাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ, আজ তাঁদের অন্যতম পুরোধা, সুলতান হযরত মীর আওহাদ আদ-দীন সাইয়্যেদ মখদুম আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী (রহ.) এর ৬৩৮তম পবিত্র ওফাত দিবস। ভারতের উত্তর প্রদেশস্থ ফয়েজাবাদ জেলার ‘কাছাউছা শরীফে’ মহাসমোরহে অনুষ্ঠিত হচ্ছে তাঁর পবিত্র ওরশ শরিফ।
তিনি ৭০৮ হিজরি সনে বর্তমান খোরাসানের সিমনান প্রদেশে জন্মগ্রহন করেন, যা ইরানের বর্তমান রাজধানী তেহরানে থেকে ২০০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। তাঁর পিতা ছিলেন সুলতান সাইয়্যেদ ইব্রাহিম নুর বকশী (রহ.)। তাঁর মাতা সাইয়্যেদা খাদিজা (রহ.) ছিলেন বিখ্যাত সুফি এবং দরবেশ খাজা আহমদ বসভী (রহ.) এর পুণ্যবতী বংশধর।
যথাসময়ে তাঁর পিতা সুন্নত মোতাবেক হযরতের ‘ছবকদান’ অনুষ্ঠান করেন এবং যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের তাঁর শিক্ষাদানের দায়িত্বে নিয়োগ দেন। তন্মধ্যে কয়েকজন হলেন হযরত শায়খ রুকনুদ্দীন আলাউদ্দীন সিমনানী, হযরত শায়খ আব্দুর রাজ্জাক কাশিউল কাশানী, হযরত ইমাম আব্দুল্লাহ ইয়াফেয়ী ও হযরত সাইয়্যেদ আলী হামদানী প্রমুখ। তিনি বর্ণনাতীত মেধাবী ছিলেন। তিনি মাত্র সাত বছর বয়সে পবিত্র কুরআনুল কারীম ‘কেরাতে ছাবা’ তথা সাত ক্বেরাত সহকারে হিফজ সম্পন্ন করেন। এটি সমাপ্ত করার পর, তিনি ধর্মতত্ত্বের বিভিন্ন শাখা যেমন তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ (ইসলামী আইনশাস্ত্র) এবং অন্যান্য সহযোগী বিষয়ের শিক্ষায় নিযুক্ত হন। তিনি চৌদ্দ বছর বয়সে ইসলামী শিক্ষার এ সকল শাখায় পূর্ণ দক্ষতা অর্জন করেন। একজন দক্ষ ইসলামিক স্কলার হিসেবে তার নাম ও খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পরে।
পিতার ইন্তেকালের পর, সুলতান সাইয়্যেদ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানি (রহ.) ১৫ বছর বয়সে সিমনানের সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনি অত্যন্ত ন্যায়পরায়নতা ও দক্ষতার সাথে শাসন করেছিলেন। তিনি সিমনানে একজন সত্য, আন্তরিক এবং ন্যায়পরায়ণ রাজা হিসাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তাঁর শাসনামলে সর্বত্র শান্তি বিরাজ করছিল, প্রজারা ছিল সমৃদ্ধ ও সুখী।
খোদাপ্রেমে বিভোর হয়ে একসময় এ মহান সুলতান সিংহাসন পরিত্যাগ করেন। আধ্যাতিœক জগতের টানে ব্যাকুল হয়ে উঠেন তিনি। অতঃপর ২৫ বছর বয়সে ২৭ এ রমজান শবে কদর রাতে হযরত খাজা খিজির (আ.) তাঁকে সিংহাসন ত্যাগ করে যোগ্য পীর মুর্শিদের খোঁজে হিন্দুস্তানের দিকে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেন। এরপর ৭৩৩ হি. সনে শ্রদ্ধেয়া মা সাইয়্যেদা খাদিজার অনুমতি নিয়ে তিনি স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রের ভার তার ছোট ভাই সুলতান মোহাম্মদ আরাফ এর হাতে অর্পণ করেন ।
রাজকীয় সকল সুযোগ সুবিধা, এমনকি আরোহনের ঘোড়াটিও সদকা করে পদব্রজে রওনা করেন হিন্দুস্তানের দিকে। যাত্রাপথে পাকিস্তানের মুলতানে তিনি হযরত জালাল উদ্দিন বুখারী জাহানিয়া জাহাগাস্ত (রহ.) এর সাথে সাক্ষাত করেন ও রুহানী ফয়েজ লাভ করেন। তিনি তাকে বিদায় জানিয়ে বলেন, ‘এই যাত্রায় অভিনন্দন; বাংলার পান্ডুয়ায় শায়খ আলাউদ্দীন গাঞ্জেনাবাত (রহ.) আপনার আগমনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন; পথে দেরি করবেন না।’
অনেক পথ পেরিয়ে অবশেষে তিনি মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছান এবং হযরত আলাউদ্দীন গাঞ্জেনাবাত (রহ.) এর পবিত্র হাতে বায়াত গ্রহণপূর্বক আধ্যাতিœক অপূর্ব নেয়ামত লাভ করেন। একসময় তাঁর পীর ও মুর্শিদ হযরত আলাউদ্দীন গাঞ্জেনাবাত (রহঃ) তাঁকে অদৃশ্য ইংগিতে ‘জাহাঙ্গীর’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
অতঃপর তিনি শরিয়ত ও তরিকতের মহান দায়িত্ব পালনে আতœনিয়োগ করেন। সুলতান সাইয়্যেদ আশরাফ জাহাঙ্গীর সেমনানি একজন আকর্ষণী শক্তিসম্পন্ন আধ্যাত্মিক পুরুষ ছিলেন যার শিক্ষা ইসলামের নিগুঢ়, রহস্যময় অংশের উপর জোর দিত। তাঁর গভীর আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি এবং সুফিবাদের অনুশীলন অসংখ্য অনুসারীকে আকৃষ্ট করেছিল, যা ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামী আধ্যাত্মিকতার প্রসারে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিল।
তিনি বেশ কয়েকটি খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন যা আধ্যাত্মিক শিক্ষা এবং সমাজসেবার কেন্দ্র হয়ে উঠে। এই খানকাহগুলো ধর্মীয় ও সামাজিক কর্মকা-ের কেন্দ্র হিসাবে কাজ করে, ইসলামী শিক্ষা এবং সুফি চর্চার প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
একজন নিবেদিতপ্রাণ ধর্মপ্রচারক হিসেবে তিনি ইসলাম ও সুফিবাদের বার্তা প্রচারে ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেছিলেন। তার অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের বিভিন্ন পটভূমির লোকদের সাথে অনুরণিত হয়েছিল, যা মানুষকে ইসলাম গ্রহণে অনুপ্রাণিত করে এবং ইসলামী আধ্যাত্মিকতার ব্যাপ্তি হয় আরো সুদূরপ্রসারী। তিনি আরব ও আজমের অধিকাংশ দেশে ভ্রমণ করেন এবং ইসলাম ধর্মতত্ত্বকে স্পষ্টভাবে প্রচার ও উপস্থাপনের মাধ্যমে হাজার হাজার বিপথগামী মানুষকে সঠিক পথে নিয়ে আসেন। আরবি, ফারসি ও তুর্কি ভাষার উপর তার পূর্ণ কর্তৃত্ব ছিল যার ফলস্বরূপ তিনি অত্যন্ত প্রভাব বিস্তারকারী ভাষণ দিতেন যাতে শ্রোতারা আধ্যাত্মিকতা ও আল্লাহর একত্ববাদের জগতে হারিয়ে যেতেন।
সুলতান সাইয়্যেদ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী শুধু একজন মহান ওলীই নন, তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ বক্তা এবং একজন অনবদ্য লেখক। তিনি ইসলামী ও সুফি সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তার লেখা কিতাবগুলো বুদ্ধিবৃত্তিক এবং আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে সুফিবাদ এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্বের নীতিগুলোকে শক্তিশালী করেছে। তিনি ধর্মীয় ও সাহিত্যে যে অবদান রেখেছেন তা ইসলামের এবং বিশেষ করে সুফিবাদের ইতিহাসে সোনালী অধ্যায় হিসেবে থাকবে।
তিনি কাছাউছা শরীফে আধ্যাত্মিকতার প্রদীপ জ্বালিয়ে এবং কুফরের অন্ধকার দূরীভূত করে বিপথগামী মানুষকে সঠিক পথে নিয়ে এসেছেন। বর্ণিত আছে, হাজার হাজার অবিশ্বাসী তার চরিত্রের পবিত্রতা এবং আধ্যাত্মিকতার উচ্চতায় মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলো। তিনি একজন মহান সুফি ছিলেন। ইসলাম ধর্মতত্ত্বের বিভিন্ন শাখায় অকল্পনীয় দক্ষতার অধিকারী ইসলামের একজন বিখ্যাত আলেমও ছিলেন। হযরত নিজাম ইয়ামানি (র.) তার কিতাব লতায়েফে আশরাফীতে লিখেছেন, তিনি যেখানেই গেছেন সে এলাকার ভাষায় ভাষণ দিয়েছেন এবং সেই ভাষায় বই লিখেছেন এবং লিখিত বইগুলো তাদের উপকারের জন্য সেখানে রেখে গেছেন।
তিনি ৭৭১ হিজরি ১লা রজব গাউসিয়ত এর মহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন। এ মহান ওলি ২৮ মুহররম ৮০৮ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।
সিলসিলা: সুলতান সাইয়্যেদ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানীর প্রতিষ্ঠিত আশরাফিয়া সিলসিলা দিন দিন প্রসার লাভ করে চলেছে। তার বংশধর এবং শিষ্যরা তার শিক্ষাকে সংরক্ষণ ও প্রচার করে চলেছেন, যার মাধ্যমে একটি প্রাণবন্ত আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য বজায় রয়েছে যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বিস্তৃত।
প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে এ সিলসিলার মাশায়েখদের আগমন প্রায় শত বৎসর পুর্বে। সর্বপ্রথম আসেন বর্তমান সাজ্জাদনশীন এর পরদাদা আলে রাসুল (ﷺ),আওলাদে গাউসে পাক, সাইয়্যেদুল মুনাযেরীন হযরত আল্লামা সাইয়্যেদ আহমদ আশরাফ আশরাফী জিলানী (রহ.)। ভাটি অঞ্চল তথা কিশোরগঞ্জ ,অষ্টগ্রাম এবং তাঁর আশপাশে তাঁরা প্রথম আসেন এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য অঞ্চলেও হেদায়েতের বাণী পৌঁছে দেন।
কাছাউছা শরিফ: ভারতের উত্তর প্রদেশের কাছাউছা শরীফে সুলতান সাইয়্যেদ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানীর মাজারটি একটি উল্লেখযোগ্য তীর্থস্থান হিসেবে খ্যাতিমান। আধ্যাত্মিক আশীর্বাদ এবং শিক্ষার খোঁজে হাজার হাজার ভক্ত এই পবিত্র মাজারে যান। এ দরবারের সাজ্জাদনশীন হওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম শর্ত হচ্ছে তিনি এমন মাপের আলেম হতে হবে, যিনি সহীহ বুখারি শরীফ পাঠদানে সক্ষম। দক্ষ আলেম দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় এ দরবার শরীয়ত বিরোধী কর্মকা- থেকে সর্বদা পবিত্র থাকে।
সুলতান সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী ব্যাক্তিজীবনে মুজাররাদ তথা চিরকুমার ছিলেন। বর্তমান আস্তানা শরীফে যাদের মাধ্যমে শরিয়ত-তরিকত ও আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অসাধারণ খেদমত হচ্ছে তাঁরা হলেন তাঁর স্থলাভিষিক্ত হুজুর গাউসে আযম দস্তগীর (রঃ) এর বংশধর হজরত সাইয়্যেদ আব্দুর রাজ্জাক নুরুল আইন (রহঃ) এর বংশধর। এ হিসেবে কাছাউছা শরীফের পীরানে কেরাম আলে রাসুল(ﷺ) ও আওলাদে গাউসে আযম(রাঃ)। এ দরবারে ইতিহাস প্রায় ৭০০ বছরের অধিককালের। উপমহাদেশের সর্বজন স্বীকৃত আলেমগণ এই দরবারের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল।
শায়খ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দেসে দেহলভী আখবারুল আখইয়ারে তাঁর সম্পর্কে গুরুত্ব সহকারে আলোচনা পেশ করেছেন। একইভাবে আল্লামা আব্দুর রহমান চিশতি ‘মিরআতুল আসরার’ এ অধ্যাপক গোলাম সাকলাইন তাঁর সুফি সাধক নিয়ে রচিত গ্রন্থেও আলোচনা করেছেন।
আলা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান বেরলভী (রহ.) এই দরবারের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সদরুল আফাযিল আল্লামা সাইয়্যেদ নইমুদ্দীন মুরাদাবাদী (রহ.) এবং হাক্বীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী আশরাফী (রহ.) সিলসিলা এ কাদেরীয়া-চিশতীয়া আশরাফীয়ার মুরিদ এবং এ দরবারের খলিফা ছিলেন। মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী আশরাফী (রহ.) লিখিত ‘তাফসীরে নঈমী’ এর আসল নাম ‘আশরাফুত তাফাসীর’ মাখদুম আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী (রহ.) এর পবিত্র নামে নামকরণ করা হয়েছে।
সুলতান সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানীর শিক্ষা ভালবাসা, সহনশীলতা এবং ঐক্যের মূল্যবোধকে উন্নীত করেছে, যা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সুন্দর সহাবস্থানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তার সিলসিলা সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে একীভূত করার প্রচেষ্টায় নিবেদিত, যা সর্বদা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বোধ জাগিয়ে তোলার উপর জোর দিয়েছে।
তাঁর প্রভাব উপমহাদেশের অন্যান্য সুফি সিলসিলায়ও প্রসারিত হয়েছিল। তিনি যে নীতি ও অনুশীলনগুলো শিক্ষা দিয়েছিলেন তা দক্ষিণ এশীয় সুফিবাদের বিস্তৃত টেপেস্ট্রিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, এর আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
আশরাফি সিলসিলার সাজ্জাদানশীন হুজুর কায়েদে মিল্লাত, আওলাদে গাউসে পাক (রা.) হজরত আল্লামা আবুল মোখতার সৈয়দ মোহম্মদ মাহমুদ আশরাফ আশরাফী আল জিলানীর নেতৃত্বে আন্জুমানে আশরাফিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট শান্তি, সহনশীলতা, শিক্ষা, সামাজিক কল্যাণের জন্য নিরন্তর কাজ করে চলেছে। বিভিন্ন কর্মসূচি এবং উদ্যোগের মাধ্যমে ইসলাম এবং সুফিবাদের সঠিক রূপ প্রচার করে যাচ্ছে। আশরাফি মিশন ধর্মের নামে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এবং ইসলামের বিভিন্ন বাতিল ফিরকার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে যুগে যুগে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ও সমাজে অবদান রেখে চলেছে।
লেখক : কাজী মুহম্মদ মুঈন উদ্দিন আশরাফী শাইখুল হাদিস, সোবহানিয়া কামিল মাদ্রাসা