ফজলে এলাহী, রাঙামাটি »
পাহাড়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন শুরুর আগেই শুরু হয়ে গেছে হত্যাযজ্ঞ। রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার চিৎমরম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী নেথোয়াই মারমা (৫৬)কে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। শনিবার রাত বারোটার পরে চিৎমরমের আগাপাড়া এলাকায় নিজ বাসাতেই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে জানান আওয়ামী লীগের নেতারা।
ওই ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সভাপতিও ছিলেন নিহত নেথোয়াই মারমা। আগামী ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ছিলেন তিনি।
কাপ্তাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অংসচাইন চৌধুরী এবং রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মুছা মাতব্বর এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকে দায়ী করেছেন।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অংসুচাইন চৌধুরী জানিয়েছেন, সে (নেথোয়াই মারমা) এতদিন উপজেলা রেস্টহাউজে ছিলো। আজই মনোনয়ন জমা দিয়ে চিৎমরমে এলাকায় গিয়েছিলো নেতাকর্মী ও স্বজনদের সাথে দেখা করতে। রাতে তার নিজ বাড়িতে জেএসএস এর একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী এসে তাকে গুলি করে হত্যা করেছে। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’
অংসুচাইন চৌধুরী আরো জানান, এর আগে চিৎমরমে দুইজন যুবলীগ নেতাকে হত্যার ঘটনার পর সে (নেথোয়াই) উপজেলা সদরে রেস্টহাউজেই বসবাস করতো। গতকালই মনোনয়ন জমা দিয়ে বাড়িতে গেছে পরিবারের সাথে পরামর্শ করতে। কিন্তু রাত বারোটার পরে তার আগাপাড়া এলাকার বাসায় প্রায় ১৪/১৫ জনের একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাসার দরজা ভেঙে প্রবেশ করে তাকে গুলি করে হত্যা করেছে। এই হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতির কাজ।’
চন্দ্রঘোনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকবাল বাহার চৌধুরী ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, চিৎমরম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নেথোয়াই মারমাকে শনিবার রাত বারোটার দিকে সবুজ গেঞ্জি পরিহিত ১০ থেকে ১২ জন অস্ত্রধারী পাহাড়ি সন্ত্রাসী দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢুকে গুলি করে চলে যায়। ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। নিহতের শরীরে ৩টি গুলি লাগে বলে জানান ওসি।
তিনি জানান, এদিকে ঘটনার খবর পাবার পর পরই রাতে চন্দ্রঘোনা থানা পুলিশ এবং বিজিবির সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে উপস্থিত হন। পুলিশ নিহতের মরদেহ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসেন। রোববার মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান তিনি।
কাপ্তাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অংসুচাইন চৌধুরী জানান, নিহত নেথোয়াই মারমার ছেলে রাতে তাকে জানান যে, সবুজ গেঞ্জি পরিহিত ১০ থেকে ১২ জন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ১২টার দিকে তাদের ঘরের সামনে দরজা ভাঙার চেষ্টা করে না পেরে পেছনের রান্না ঘরের দরজা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে তার বাবাকে গুলি করে পালিয়ে যায়। আমি বিষয়টি তাৎক্ষণিক আইন শৃংখলারক্ষাকারী বাহিনী ও দলের উর্ধতন নেতাদের অবহিত করেছি।’
অথচ জীবনের ভয়েই ছিলেন তিনি!
চিৎমরমে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির সাংগঠনিক শক্তি বেশ। মারমা অধ্যুষিত এই ইউনিয়নটিতে আওয়ামী লীগের অবস্থান মোটামুটি শক্তপোক্ত। তবুও জনসংহতির সশস্ত্র কর্মীদের দাপটে কোণঠাসা থাকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। জনসংহতির সশস্ত্র কর্মীদের হাতে দুইজন নেতা নিহত হওয়ার পর নিরাপত্তাজনিত কারণে গত ২ বছর ধরে নেথোয়াই মারমা উপজেলা পরিষদের রেস্ট হাউসে অবস্থান করে আসছিলেন। বাড়িতেও খুব একটা যেতেন না তিনি। গত শনিবার মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে সন্ধ্যায় তিনি বাড়িতে যান, সেই যাওয়াই কাল হতো তার। আওয়ামী লীগ সভাপতি অংসুইচাইন চৌধুরী বলছেন, যে জীবনের ভয়ে নিজের বাড়ি থেকে এত দূরে এসে বসবাস করত, সেই বাড়িতে যাওয়াটাই কাল হলো তার!
এই হত্যাকাণ্ডের পর সমগ্র চিৎমরম এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর টহল জোরদার করা হয়েছে।
রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক হাজী মুছা মাতব্বর এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ‘জনসংহতি সমিতি’কে দায়ী করে বলেছেন, পাহাড়ে নির্বাচন আসলেই হত্যাকাণ্ডে মেতে উঠে এই সন্ত্রাসী সংগঠনটি। তিনি আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পার্বত্য জেলার সকল ইউনিয়নের প্রার্থীদের নিরাপদে ও সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়ে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আইনশৃংখলা বাহিনীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
যা বলছেন দীপংকর তালুকদার
কাপ্তাই চিৎমরম এলাকার ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী নেথোয়াই মারমা হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও রাঙামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার এক বিবৃতিতে পার্বত্য অঞ্চলের অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে অপারেশন জোরদার করার করার আহ্বান জানিয়েছেন।’
সংবাদমাধ্যমে দেয়া এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে আঞ্চলিক দলগুলো বেছে বেছে রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। গতকাল তারা নে থোয়াই মারমাকে হত্যা করেনি, হত্যা করেছে দেশের গণতন্ত্রকে। নে থোয়াই মারমার অপরাধ ছিল গণতান্ত্রিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে প্রার্থী হয়েছেন। এটাই তার বড় অপরাধ। ইতিপূর্বে জুরাছড়ির অরবিন্দ চাকমা, বিলাইছড়ির সুরেশ তঞ্চঙ্গ্যাসহ অসংখ্য নেতা কর্মীকে তারা হত্যা করেছে।তিনি বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে অবৈধ অস্ত্র ও অস্ত্রধারীদের দমন করতে নতুন করে তৎপরতা বাড়াতে হবে। অপারেশন উত্তরণের মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের শান্তি ফিরিয়ে আনতে সেনাবাহিনীর তৎপরতা আরো বেশি বাড়ানোর জন্য আহ্বান জানান তিনি।
মারমাদের ক্ষোভ
পার্বত্য রাঙামাটি ও বান্দরবানে মারমা জনগোষ্ঠীর কাছে কখনই খুব গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক দল ছিলো না পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলো। সাধারনত মূল ধারার জাতীয় রাজনীতির সাথেই জড়িত থাকেন মারমারা। খোদ পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানসহ বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট মারমা নেতা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত থাকায় মারমাদের আওয়ামী লীগ প্রীতি সর্বজনবিদিত। সর্বশেষ রাঙামাটির জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জনসংহতি সমিতির প্রার্থী পরাজিত হওয়ার অন্যতম কারণগুলোর একটি হলো, মারমাদের ভোট না পাওয়া। সংখ্যায় পাহাড়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই জনগোষ্ঠীর সাথে তাই বেশ স্নায়ুযুদ্ধই চলমান জনসংহতি সমিতির। আর আরেকটি মজার তথ্য হলো, তিন পার্বত্য জেলায় মারমা অধ্যুষিত চিৎমরমই একমাত্র ইউনিয়ন যেখানে জনসংহতি সমিতি বেশ কিছুটা ভালো অবস্থায় ছিলো, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সেই অবস্থানও হারিয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের পর সম্ভবত ক্ষোভ আরো বেড়েছে। মারমা সংস্কৃতি সংসদ (মাসস) হত্যাকান্ডের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে ব্যানার ঝুলিয়েছে, বিবৃতি দিয়েছে। এক বিবৃতিতে সংগঠনটি এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে নিহতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।’
আওয়ামী লীগের বিক্ষোভ
কাপ্তাই উপজেলার চিৎমরম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নেথোয়াই মারমার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রোববার বেলা ১টায় কাপ্তাই উপজেলা ছাত্রলীগের মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
উপজেলা পরিষদ বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল চত্বরে উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এ আর লিমন এর সঞ্চালনায় প্রতিবাদ সমাবেশে রাঙামাটি জেলা আওয়ামীলীগের সহসভাপতি রুহুল আমিন, কাপ্তাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জেলা পরিষদ সদস্য অংসুই ছাইন চৌধুরী, সহসভাপতি জেলা পরিষদ সদস্য দীপ্তিময় তালুকদার, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আনোয়ার হোসেন বাচ্চু, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক স্বপন বড়ুয়া, সাংগঠনিক সম্পাদক আকতার হোসেন মিলন প্রমুখ এইসময় উপস্থিত ছিলেন। বক্তাগণ অবিলম্বে নির্বাচনের পূর্বে দোষীদের গ্রেফতারের দাবি জানান।
এর আগে একটি বিক্ষোভ মিছিল উপজেলা পরিষদ চত্বর হতে শুরু হয়ে কাপ্তাই সড়ক-বড়ইছড়ি বাজার প্রদক্ষিণ করে উপজেলা পরিষদ চত্বরে এসে প্রতিবাদ সমাবেশে মিলিত হয়।
পিছিয়ে গেলো নির্বাচন
এদিকে নৌকার প্রার্থীকে হত্যার পর পিছিয়ে দেয়া হয়েছে কাপ্তাইয়ের চিৎমরম ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন। আগামী ১১ নভেম্বর এর পরিবর্তে তৃতীয় ধাপে ২৮ নভেম্বর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন উপজেলার নির্বাচন কর্মকর্তা তানিয়া আক্তার।
তিনি জানান, চিৎমরম ছাড়া বাকি তিন ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন যথাসময়েই হবে।
যা বলছেন চিৎমরম এর চেয়ারম্যান
কর্ণফুলি নদীর লাগোয়া ইউনিয়ন চিৎমরম। প্রায় পুরোটাই মারমা অধ্যুষিত এই ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান জনসংহতি সমিতির সমর্থনে বিজয়ী খাইসাইঅং মারমা। এবারের নির্বাচনে চারজন প্রার্থী মনোনয়ন নিলেও জমা দিয়েছেন তিনজন। তারা হলেন বর্তমান চেয়ারম্যান খাইসাঅং মারমা, স্বতন্ত্র প্রার্থী সাচিং মারমা এবং নেথোয়াই মারমা। হত্যাকাণ্ডের ব্যাপাওে চেয়ারম্যান খাইসাইঅং মারমা বলছেন, ‘আমি কিছু বলতে চাই না, কিছু জানিও না। জনগণের কাছ থেকে নানা কিছু শুনি, কেউ বলছে মনোনয়ন নিয়ে তাদের দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ, কেউ বলছে জনসংহতি সমিতির কাজ। আমি কিছু বলতে চাই না। তবে এই ঘটনার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নাই। আমি এবার জনসংহতি সমিতির সমর্থনে নির্বাচন করছি না, স্বতন্ত্র হিসেবেই করছি, কেউ এবার আমাকে সমর্থনও দেয়নি।’