হাবিবুল হক বিপ্লব »
ভূপেন বাবু, আমি নিশ্চিত জানি, এ চিঠি আপনি কখনোই পাবেন না। সেখানেই চলে গেলেন আপনি, যেখানে গেলে কোনো চিঠি কেউ পায় না কোনোদিন। তবুও, আমার সবসময়ের প্রিয় গায়ক, আপনাকে নিয়ে, দু-চার কথা লিখতে ইচ্ছে হল।
সেই ছোটবেলায় আমার বাসার টেপরেকর্ডারে শোনার জন্য মাত্র দু-তিনটে ভাল ক্যাসেট ছিল। এগুলোই বারবার শুনে নিতাম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। এর একটা ছিল আপনার। বারোটা গান ছিল ক্যাসেটটায়। আপনার এই দরাজ কন্ঠের গানগুলোই আমার শৈশবের গান শোনার চমৎকার স্মৃতি। ক্যাসেট প্লেয়ারটা এখন কই জানি না, ক্যাসেটটাও নাই হাতের কাছে। কিন্তু, আজ এত বছর পরেও, অনেক গান বহুদিন না শোনার পরেও, গানের কলি ভুলিনি আমি। গুণগুণ করলেই শৈশব থেকে মিষ্টি সব সুর ভেসে আসে। এলোমেলো হাওয়ায় চোখে স্বপ্ন আনে আপনার গান।
আমার সবচে প্রিয় গান ‘মোর গাঁয়ের সীমানার পাহাড়ের ওপারে/নিশীথ রাত্রির প্রতিধ্বনি শুনি…জেগে ওঠা মানুষের হাজার চিৎকারে/আকাশ ছোঁয়া অনেক বাঁধার পাহাড় ভেঙে পড়ে…’।
এই প্রতিধ্বনি কান পেতে শুনতাম, চোখ মেলে দেখতাম আর চোখ বুজে ভাবতাম। ‘পৃথিবী আমাকে আপন করেছে, ভুলেছি নিজের ঘর’ কী রোমান্টিসিজম না ছিল গানের এই কলিটায়! রঙের খনিতে মনটাকে রাঙিয়ে নিয়ে আর পথের টানে পথকে আপন করে নিয়ে যাযাবর হয়ে যেতে ইচ্ছে করত সেসময়। গঙ্গা, মিসিসিপি, ভল্গা, অটোয়া, অস্ট্রিয়া, প্যারিস, ইলোরা, শিকাগো, তাসখন্দের মিনারে ঘুরে এসেছি কল্পনায় আপনার গানের সাথে।
আপনার গানের প্রতি শব্দে রক্তিম এক উত্তাপ ছিল, প্রচণ্ড প্রতাপ ছিল, ছিল ‘ভয়ার্ত মানুষের না ফোটা আর্তনাদ’। কী গভীর জীবনবোধ লুকিয়ে ছিল গানের কথায় কথায় ! আপনার গান শুনে আমি ‘কখনো তো হই নাই ক্লান্ত’’। আপনি চেয়েছিলেন, আপনার গান হোক ‘বহু আস্থাহীনতার বিপরীতে এক গভীর আস্থা’, ‘কল্পনাবিলাসের বিপরীতে এক সত্য প্রশস্তি’, যেন ‘সেই গানে জাগুক জনৈক সংগ্রামী সৈনিকের মহাপ্রাণ’।
গানের মধ্য দিয়ে বলে গিয়েছেন সবসময়ের জন্য কিছু সত্য। এখনো ‘মানুষের মৃগয়ায় মানুষ কাঁদে, বাঁচার লড়াই নিয়ে প্রতিযোগিতায়, আর আমাদের করতে হয় ‘জন্মের ঋণ শোধ মৃত্যু দিয়ে’। আজও ‘মানুষ মানুষকে পণ্য করে, জীবিকা করে’ – পুরোনো ইতিহাস আমাদের লজ্জা দেয় না। আপনিই কেবল বৃথা ‘মানুষ মানুষের জন্য’ গেয়ে যান। এখনো গগনচুম্বী অট্টালিকার ছায়াতে গৃহহীন নরনারীরা আশ্রয় খোঁজে। থরে থরে ফুটে থাকা গোলাপ-বকুলের পাশেই না ফোটা ফুলের কলিরা অনাদরে ঝরে যায়।
প্রেমহীন ভালবাসায় দেশে দেশে সুখের ঘর ভেসে যায়। জমিদার আর বর্গীরা হানা দেয় না এখন, তবু স্বাধীন এদেশ জুড়ে এখনো নিত্য হাহাকার।
আমাদের ঘামে ভেজা শরীরের বিনিময়ে আঁকাবাঁকা পথে আমরা রাজা-মহারাজাদের কাঁধে নিয়ে ছুটে যাই আজও। এত অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও, নৈতিকতার স্খলন, মানবতার পতন দেখেও নির্লজ্জ অলসভাবে বয়ে যায় গঙ্গা, নিঃশব্দে, নীরবে। মবকে জাস্টিস বলে প্রতিদিন কতো অপমান, মৃত্যুর খবর আসে। সেই সংবাদ শুনেও আমরা বধির থাকি, শেষ প্রতিবাদটুকু করি না।
আপনি জানিয়েছিলেন, সংগ্রাম জীবনের আরেক নাম। তাই ত্রাস ভুলে দানবের নাশ করতে ডেকেছিলেন সজাগ জনতাদের। অন্য কারো কন্ঠে মানুষের জন্য এতটা আর্তনাদ দেখিনি আমি! তাই শুনে কষ্ট পেয়েছিলাম, সারাজীবন সবহারাদের অধিকারের জন্য গেয়ে যাওয়া, পরের সুখে কাঁদতে চাওয়া আপনি সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে যখন যোগ দেন।
জানি না, কী ভেবে গিয়েছিলেন এই ভুল পথে। মানুষের গান শুনিয়েছিলেন আপনি আমায়। হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনায় নজরুল, এক হাতে অগ্নিবীণা আর কন্ঠে গীতাঞ্জলি নিয়ে প্রতিকূল হাওয়ায় পথ চলতে বলেছিলেন। একই রক্ত-মাংসে গড়া আর প্রেম-প্রীতি দিয়ে হৃদয় ভরা, একই আকাশ-বাতাসে শ্বাস নেওয়া, একই আশা-ভালোবাসা-কান্না হাসির একই ভাষার এসব মানুষের মাঝে ভেদাভেদ না করতে শিখিয়েছিলেন।
হাসি নিয়ে, বাঁশি নিয়ে, ফাগুন ফুলের আনন্দ নিয়ে, মনের চড়ুই পাখিটির বাঁধন খুলে দিয়ে, হাজার বন্ধ দুয়ার ভেঙে, নতুন আলোর দিগন্তে জীবন খুঁজে নিতে ছুটে আসতে বলেছিলেন।
আপনার সুর অজস্র মানুষকে বাঁচতে শিখিয়েছিল একদিন। প্রভাত আনতে পারা একেকটি অমর গানের জন্য আপনি বেঁচে থাকবেন বাংলার আকাশে। সারাজীবন, সবসময় আপনার এই কয়টা লাইন সবাইকে শুনিয়ে যাব- “এই পৃথিবীর ধর্ম যত তুমি বিচার কর দেখবে সেথায় একই কথা উর্ধ্বে সবার মানবতা… সেই কথাটাই বলে সবাই বড়াই কর আবার কেন লড়াই কর?”
ইতি- আপনার গানের একজন মুগ্ধ ভক্ত