ভিসা জটিলতা : বেনাপোলের রাজস্ব আয়ে ও সীমান্তের ব্যবসায় ধস

সুপ্রভাত ডেস্ক  »

ভিসা নিয়ে ভারতের বিধিনিষেধে বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট দিয়ে দেশটিতে যাওয়া যাত্রীর সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। এর ফলে ‘ভ্রমণকর’ বাবদ রাজস্ব আদায় অর্ধেক হয়ে গেছে। বড় ধরনের ধস নেমেছে স্থানীয় ব্যবসা—বাণিজ্যে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে, আগে এ বন্দর দিয়ে দুই দেশের মধ্যে প্রতিদিন সাত থেকে নয় হাজার যাত্রী পারাপার হত, ভ্রমণ কর থেকে প্রতিমাসে রাজস্ব আয় হত গড়ে ১৫ কোটি টাকার। কিন্তু ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে প্রতিদিন যাত্রী পারপার নেমেছে পাঁচ হাজারে। আর বর্তমানে রাজস্ব আদায় হচ্ছে মাসে আট কোটি টাকা।

বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট ইমিগ্রেশন ওসি ইমতিয়াজ মো. আহসানুল কাদের ভূইয়া জানান, ‘স্বাভাবিক সময়ে বেনাপোল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৪ হাজার থেকে পাঁচ হাজার যাত্রী ভারতে যেত। এখন সেটা কমে গড়ে দেড় হাজার থেকে দুই হাজারে এসে দাড়িয়েছে।’

স্থলপথে দেশের সবচাইতে বড় আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট বেনাপোল থেকে ভারতের কলকাতার দূরত্ব ৮৪ কিলোমিটার। দূরত্ব কম ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হওয়ায় স্থলপথের অধিকাংশ যাত্রীই এ চেকপোস্ট দিয়ে ভারত যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আর ভারত—বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের যাতায়াতকারী এই মানুষদের সহযোগিতার জন্য বেনাপোল চেকপোস্টে এলাকায় গড়ে উঠেছে নানা প্রতিষ্ঠান। মানিচেঞ্জার থেকে শুরু করে দূরপাল্লার পরিবহন কাউন্টার, ট্যুর গাইড, ভিসা সহায়তা কেন্দ্র, বাস—ট্রেন— প্লেনের টিকেট বুকিং এজেন্সি এবং হোটেল, রেস্তোরাঁসহ ছোটখাটো এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা—বাণিজ্য পুরোপুরিই চেকপোস্ট ব্যবহারকারী যাত্রীদের উপর নির্ভরশীল। এখন যাত্রী কমে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলোও চরম দুঃসময় পার করছে। বড় ধাক্কা লেগেছে তাদের ব্যবসায়। বেনাপোল সোহাগ পরিবহনের স্থানীয় অফিস ব্যবস্থাপক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আগে যেখানে প্রতিদিন বেনাপোল থেকে দেড়শ দূরপাল্লার বাস বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় উদ্দেশে ছেড়ে যেত। এখন সেখানে ২০ থেকে ৩০টা বাস ছেড়ে যাচ্ছে। তারপরও অধিকাংশ বাসই খালি যাচ্ছে।

‘পরিবহন ব্যবসা টিকিয়ে রাখতেই কোম্পানির মালিকরা লসের টাকা মাথায় নিয়েই পরিবহন ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভারতীয় ‘ভ্রমণ ভিসা’ প্রদান শুরু না হলে খুব শিগগিরি পরিবহন ব্যবসা বেনাপোল থেকে গুটিয়ে নিতে হবে।’

চেকপোস্টের রাজা—বাদশা মানিচেঞ্জারের মালিক আবুল বাশার বলেন, ‘আমরা সাধারণত এক্সপোর্ট—ইমপোর্ট ব্যবসায়ী ও ভারত যাতায়াতকারী পাসপোর্ট যাত্রীদের টাকা এক্সচেঞ্জ করে থাকি। এদের যাতায়াত কমে গেলে আমাদের কাজও কমে যায়।

‘বাংলাদেশে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর আমরা একেবারেই হাতগুটিয়ে বসে আছি। আয় রোজগার না হলেও অফিস খরচ, নিজেদের হাত খরচ, কর্মচারী বেতন তো হয়েই যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের পথে বসতে হবে। চেকপোস্টের ব্যবসায়ী শামীম হোসেন বলেন, ‘চেকপোস্ট এলাকায় অন্তত চার শতাধিক বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। যারা শুধুমাত্র পাসপোর্ট যাত্রীদের উপর নির্ভরশীল। স্থানীয়রা খুব বেশি পণ্য কিনতে এখানে আসে না। পাসপোর্ট যাত্রী কমে যাওয়ায় অনেকের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হচ্ছে।’

ছাত্র—জনতার আন্দোলনে বাংলাদেশে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর ভিসা কার্যক্রম সীমিত করে রেখেছে ভারত। দেশটির ভিসাকেন্দ্রগুলো এখন কেবল জরুরি মেডিকেল ও স্টুডেন্ট ভিসার জন্য সীমিত পরিসরে স্লট দিচ্ছে। তাতে পর্যটন বা বিভিন্ন কাজে যারা ভারতে যাতায়াত করতেন, তারাও পড়েছেন বিপাকে। বেনাপোল বন্দরে পারাপারে অপেক্ষায় থাকা এক যাত্রী বলেন, ভারতে উন্নত চিকিৎসার জন্য মেডিকেল ভিসা নিয়ে ভারতে যাচ্ছেন। কিন্তু মেডিকেল ভিসা পেতেও তাদের দুই থেকে তিন মাস সময় লাগছে। তিনি আরও বলেন, আগেও বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ভারতে গেছেন কিন্তু এমন চিত্র কখনো দেখেননি। চেকপোস্ট একদম ফাঁকা। তারা কয়েকজন ছাড়া ভারতে যাওয়ার কোনো যাত্রী নাই। ভারত সরকার বাংলাদেশিদের জন্য টুরিস্ট ভিসা প্রদান বন্ধ রাখার কারণেই হয়তো চেকপোস্টে যাত্রী নেই বলে তিনি জানান। বাংলাদেশ ভারত চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ডিরেক্টর মতিয়ার রহমান বলেন, ভিসাকেন্দ্রগুলো এখন কেবল জরুরি মেডিকেল ও স্টুডেন্ট ভিসার জন্য সীমিত পরিসরে স্লট দিচ্ছে। ব্যবসা ও ভ্রমণ ভিসার যাত্রীদের সংখ্যা নেই বললেই চলে। ভারত সরকার ব্যবসা (বিজনেস) ভিসা না দেওয়ায় বেকায়দায় পড়েছেন তারা। এর প্রভাব স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি—রপ্তানি বাণিজ্যেও পড়তে শুরু করেছে।

একজন আমদানি—রপ্তানিকারক আবু নিদাল ফয়সল জানান, ‘প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে যেসব পণ্য আমদানি করা হয় তা কেনার আগে দেশটির বিভিন্ন জায়গাতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের পণ্য পছন্দ করে থাকেন তারা। কিন্তু ভিসা জটিলতার কারণে এখন তারা এ কাজ করতে পারছেন না। ফলে অনেকেই ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন।’

বেনাপোলের ইমিগ্রেশন ওসি ইমতিয়াজ মো. আহসানুল কাদের ভূইয়া বলেন, ‘৫ আগস্টের পর যাত্রী সংখ্যা অনেক কমে গেছে। এখন যাতায়াতকারীদের অধিকাংশই অগাস্টের আগেই ভিসা পাওয়া যাত্রী। ভিসা না দেওয়ার পর নতুন যাত্রী সংখ্যা নেই বললেই চলে। তিনি জানান, বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে বৃহস্পতিবার মোট পারাপার হয়েছেন ৫ হাজার ১৫৯ জন। এর মধ্যে ভারতে গেছেন ২ হাজার ৬৫১ জন, এসেছেন ২ হাজার ৫০৮ জন। এর আগে বুধবার পারাপার হওয়া ৫ হাজার ২৩১ জনের মধ্যে ভারতে গেছেন ২ হাজার ৬০২ জন, এসেছেন ২ হাজার ৬২৯ জন। মঙ্গলবার ৪ হাজার ৪৫ জন যাত্রী পারাপার হয়েছে, এর মধ্যে ভারতে গেছেন ১ হাজার ৮৮৮ জন, এসেছে ২ হাজার ১২৭ জন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে যায় কেবলমাত্র সেই সব যাত্রী প্রত্যেকেই ভ্রমণ কর বাবদ এক হাজার টাকা এবং প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ফি বাবদ ৫৪ টাকা দিয়ে থাকেন। ফেরত আসা যাত্রীরা এই করের আওতামুক্ত। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘নতুন করে টুরিস্ট ভিসা চালু না করলে আগামী এক মাসের মাসের মধ্যে দু’দেশের মধ্যে যাত্রী পারাপার শূন্যের কোটায় নেমে আসবে।’ সূত্র: খবর বিডিনিউজ।