রায়হান আহমেদ তপাদার :
ত্যাগের মহিমা নিয়ে ঈদ উল আযহা উদযাপন করবেন সৌদি আরবসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা। প্রতি বছরের মতো এবারও ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন দেশে ঈদুল আযহা পালিত হবে। কিন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে,১৬ মাস পার হয়ে গেল করোনার নিত্যনতুন রূপান্তরিত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে লড়াই করতে করতে। তারপরও সংক্রমণকে ঠেকানোর মতো উপায়, অবলম্বন এবং কৌশল এতদিনে মানুষের নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে বিপরীত চিত্র আমাদের হতাশ এবং উদ্বিগ্ন হওয়ার মতোই। আসছে বহুল প্রতীক্ষিত কোরবানির ঈদ। মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবের আর এক মহা আয়োজন তো বটেই। দেশি গরুর হাট বসা থেকে শুরু করে সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় গরু আমদানি সবই এক অসহনীয় দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে পার করতে হবে। এবার বলা হচ্ছে দেশি গরুই কোরবানির চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট। ভারত থেকে পশু আমদানি কোনভাবেই সমীচীন হবে না। তবে ইতোমধ্যে অনলাইনভিত্তিক কার্যক্রমে পশু কেনা থেকে সার্বিক তত্ত্বাবধানে গুছিয়ে দেয়া সবই শেষের পর্যায়ে। সবার পক্ষে তেমন প্রযুক্তির বলয়ে যুক্ত হওয়া আসলে সম্ভব কিনা তাও বিবেচনার দাবি রাখে।
মহামারির কারণে হাট বসছে না অনেক জায়গায়। তার উপর বন্যা ক্ষতিগ্রস্ত করছে গবাদি পশুপালকদের। প্রতি বছর কোরবানির ঈদে গবাদি পশু থেকে বেশ মোটা অংকের টাকা হাতে পান হতদরিদ্র সাধারণ মানুষ। যার উপর নির্ভর করে বাস্তবায়ন হয় অনেকের সারা বছরের পরিকল্পনা। গ্রাম বাংলার ঈদুল আজহার সেই মূল আকর্ষণ কোরবানির পশু কেনা বেচা বন্ধ থাকায় তাদের ঈদ আনন্দ যেমন প- হচ্ছে ঠিক তেমনি সাম্প্রতিক বন্যা অভাব ডেকে এনেছে। অনেকে কোরবানির জন্য বছর ভরে পশু পালন করে বিক্রি করতে না পারায় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। মহামারি করোনা ভাইরাসের এই প্রকোপের মধ্যে অনেকেরই ঘর, বাড়ি বন্যার পানিতে ভেসে গেছে।
মহামারি এই ভাইরাসটি এখন সারা দেশে ভয়ঙ্করভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। শুধু তাই নয়, শনাক্ত এবং মৃত্যুর হারও ঊর্ধ্বগতির পর্যায়ে। উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে পড়েছে এক অবাঞ্ছিত দুর্দশা। বাংলাদেশ অতিক্রম করছে এক দুঃসহ ক্রান্তিকাল। সীমিত আকারে বার বার লকডাউন দেয়া হচ্ছে সেই এপ্রিল, মে এবং জুন মাস থেকে। দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে ভারতীয় নতুন ভ্যারিয়েন্ট আশঙ্কাজনক ভাবে ছড়ানোর যে অসহনীয় দাপট তাতে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। গত বছরের এই সময়ে করোনার বহুল সংক্রমণে রাজধানী ঢাকার অবস্থা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছলেও দেশের অন্যান্য অঞ্চল মোটামুটি নিরাপদ দূরত্বেই ছিল বলা যায়। ফলে গ্রাম-গঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে অতি সাধারণ নিম্নবিত্তের খেটে খাওয়া মানুষকে সে সময় করোনা মোকাবেলা করতে হয়নি।
২০২০ সালের এপ্রিল-মে যথার্থ লকডাউনের মধ্যেই ১ বৈশাখ, পবিত্র রমজান মাস এবং ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-ফিতর পালিত হয় সীমিত আকারে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধিকে আমলে নিয়েই। কিন্তু ঈদের আয়োজনে শিকড়ের টানে গ্রামে ছুটে যাওয়ার করুণ দৃশ্যও হতাশ হওয়ার মতোই ছিল। প্রায় দেড় বছর ধরে করোনার সঙ্গে ক্রমাগত লড়াইয়ে মানুষ কেমন যেন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। এই বছরের এপ্রিল, মে ও জুন মাসে অনেক কিছু ছাড় দিয়ে যে স্থবিরতার নির্দেশনা আসে তাতে স্বাস্থ্যবিধি মানা তো হয়ইনি বরং অযাচিতভাবে লঙ্ঘন করার চিত্র সত্যিই হতবাক হওয়ার মতো। আর তার দাম দিতে হচ্ছে সারা দেশের অসচেতন মানুষদের। নির্ভয়ে, নিঃসঙ্কোচে মানুষ যেন কেমন বেপরোয়া এবং অস্থির হয়ে উঠেছে। সময়টা তো একেবারে কমও নয়। আবার নাড়ির টানে গ্রামের বাড়ি ছুটে যাওয়াও ঈদের অপরিহার্য উৎসব আয়োজন। ১ জুলাই থেকে যে কঠোর বিধিতে সারা দেশকে আটকে দেয়া হয়েছে সেখানে অনেকের দেশের বাড়ি চলে যাওয়ার দৃশ্য উঠে এসেছে। আর কয়দিন পরেই পবিত্র কোরবানির ঈদ। সঙ্গতকারণে যারা গেছে তাদের কর্মস্থলে ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
সময় এখন খুব বেশি হাতেও নেই। যারা যাওয়ার তারা সবাই নিজ নিজ গন্তব্যে চলেও গেছে। ঈদের আগে যে বাড়তি চাপ সড়ক-মহাসড়ক এবং গণপরিবহনে সেটা বোধহয় আর হবে না। বরং ঈদের পরে ফিরে আসার যে অসহনীয় ঢল তাতে করোনার নতুন সংক্রমণ বয়ে নিয়ে আসা ছাড়াও পরিস্থিতি যে কি মাত্রায় উত্তাল হবে তাও এক ধরনের মহাদুর্বিপাক। আইন করে, শাস্তি দিয়ে, জরিমানা গুণে কাউকেই বিধিনিষেধ রপ্ত করানো যায় না।
মানুষ যদি নিজের ভালটা নিজেই বুঝতে পারে সেটাই অপেক্ষাকৃত মঙ্গল। যেমন নিজের জন্য একইভাবে দেশের সার্বিক কল্যাণের পর্যায়কেও নিরাপত্তায় আগলে রাখে। তবে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতিতে শুধু যে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা বাড়ছে তা কিন্তু নয়, পাশাপাশি চিকিৎসাসামগ্রীর যথার্থ ঘাটতিও চোখে পড়ার মতো যা বাংলাদেশের ঢাকা ছাড়া অন্যান্য বিভাগীয় শহর, জেলা, উপজেলা এবং গ্রাম-গঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে দৃষ্টিকটুভাবে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। রাজশাহী, খুলনা ও সাতক্ষীরা এসব অঞ্চলে করোনার অত্যধিক প্রাদুর্ভাবে মৃতের সংখ্যা আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়াই শুধু নয়, চিকিৎসা সরঞ্জামের সঙ্কটও এক বিব্রতকর অবস্থায় চলে যাচ্ছে। বিশেষ করে অক্সিজেনের প্রয়োজনীয় সরবরাহ একেবারে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠিত হওয়ার মতো। আর আইসিইউর অতুলনীয় সঙ্কটাপন্ন রোগীদের প্রাসঙ্গিক চিকিৎসারও ব্যাহত হওয়ার চিত্র সংশ্লিষ্টদের বিপদের ঝুঁকি বাড়িয়ে চলেছে। সারা দেশে যেভাবে করোনার চরম সংক্রমণ অতীতের রেকর্ডকে অতিক্রম করে যাচ্ছে সে মাত্রায় প্রাসঙ্গিক চিকিৎসার অভাবও অনেক দুর্ভাগা রোগীকে মরণের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
লোকবল অবধারিত বিষয় বলে স্বাস্থ্য সুরক্ষা আমলে নেয়াও অত সহজসাধ্য হবে না। কারণ মানুষ এখন অবধি তার নিজের সুরক্ষাকে খুব বেশি তোয়াক্কাও করছে না। তার ওপর ধর্মীয় উৎসব পালনের ক্ষেত্রে কতখানি সহনশীল এবং পরিমিত হবে তাও দেখার অপেক্ষায় আমরা সবাই। এবার আমাদের মাঝে এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ঈদ-উল-আযহা এসেছে। বিশ্বজুড়ে মহামারি করোনা ভাইরাসের থাবা। বাংলাদেশেও এ অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণ। প্রতিদিনই আক্রান্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। অনেকে মৃত্যুবরণ করছেন। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ, অর্থনীতির অবস্থাও নাজুক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ পরিস্থিতিতে জনকল্যাণমুখী নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। ঘোষণা করেছেন নানা প্রণোদনা। ফলে গরিব দুখী মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে। আমার বিশ্বাস, করোনাভাইরাস মহামারির সব অন্ধকার কাটিয়ে ঈদ-উল-আযহা সবার মাঝে আনন্দ বয়ে আনবে। কোভিড-১৯ এর উদ্ভূত দুর্যোগময় পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে আমাদের ধৈর্য, সাহস ও শক্তি প্রয়োজন। আসুন, আমরা মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি যে, তিনি যেন আমাদের সেই তাওফিক দেন। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন আমি তাদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। পাশাপাশি তাদের পরিবারের শোকসন্তপ্ত সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। ঈদ-উল-আযহা আমাদের শান্তি, সহমর্মিতা, ত্যাগ ও ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা দেয়। সঞ্চারিত করে আত্মদান ও আত্মত্যাগের মানসিকতা। এ মর্ম অনুধাবন করে সমাজে শান্তি ও কল্যাণের পথ রচনা করতে আমাদের সংযম ও ত্যাগের মানসিকতায় উজ্জীবিত হতে হবে।
পবিত্র ঈদ-উল-আযহার আনন্দ ও ত্যাগের অনন্য মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক দেশের প্রতিটি নাগরিকের জীবন। সবাই ভালো থাকুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, সুরক্ষিত থাকুন। দূরত্ব বজায় রেখে ঈদ জামাতসহ প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করি। সবাইকে আবারও জানাই পবিত্র ঈদ-উল-আযহার শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট