ভিটামিন স্যার

এমরান চৌধুরী :

আমাদের বাংলা স্যারের একটা সুন্দর নাম আছে। নামটা চন্দ্রের মতো সুন্দর।

চাঁদ সুলতান!

স্যারের পাশের বাড়ির এক ছাত্র আমাদের ক্লাসে পড়ে। ওর  নাম গুন্ডুইল্লা।  স্যার তাকে গুগল  বলে ডাকে। ওর সাথে  স্যারের মায়ের খুব ভাব।  স্যারের মা জননী গুন্ডুইল্লাকে খুব স্নেহ করেন- যেন আদরের নাতি। মা জননী একদিন গল্প বলতে গিয়ে বলেছেন, স্যার  জন্ম নেন চাঁদনি পসর রাতে। সেদিন আঁতুড়ঘর এত বেশি  ঝলমল করছিল তাতে মনে হয়েছিল গোলগাল চাঁদটাই আকাশ থেকে চৌচালা খড়ের ছাউনি ভেদ করে  ঘরে নেমে এসেছে।

এ কারণে স্যারের নাম রাখা হয়েছে চাঁদ সুলতান।

কিন্তু এ নামে স্কুলে স্যারকে  কেউ  চেনে না। অফিসের হাজিরা খাতা আর বেতনের বিল পর্যন্ত চাঁদ সুলতান নামটার রাজত্ব। ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যেকের  কাছে তিনি   ভিটামিন স্যার নামে পরিচিত। শুধু পরিচিত নয়—সুপরিচিত।  যে সব ক্লাসে তাঁর ক্লাস নেই ওরাও এই ভিটামিন স্যারকে চেনেন।

স্যার  প্রধানত বাংলার শিক্ষক। তবে তিনি নির্দিষ্ট পাঠে  থাকার মানুষ নন।  পাশাপাশি চলে যান বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাসেও। কলম্বাস কীভাবে আমেরিকা আবিষ্কার করেছিল। পানিপথের যুদ্ধ কী পানির ওপর হয়েছিল?  তেমনি পৃথিবীটা কি রকম গোল? ডিমের মতো না আলুর মতো! নাকি কমলালেবু মতো। এসব তিনি বেশ মজা করে বুঝিয়ে দেন ছাত্রদের। সেদিন তিনি পড়ার  ফাঁকে চলে যান ভিটামিনে। বললেন, তোমরা কে কে ভিটামিন এ ক্যাপসুল খেয়েছ।

ছাত্রছাত্রীরা পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি শুরু করল। স্যার যেন মঙ্গলগ্রহ থেকে আগন্তুক কেউ। আসলে কম বেশি সবার মুখে ভিটামিন এ ক্যাপসুলের ফোঁটা পড়েছে। এ মুহূর্তে মনে করতে পারছে না হয়তো। সবাই যখন একজনের মুখ আরেকজনে চাওয়ায় ব্যস্ত তখন মধ্যম সারি থেকে একজন বলে ওঠল, আমি খেয়েছি স্যার। ছাত্রছাত্রীদের সবার চোখ গিয়ে হুড়মুড়িয়ে  পড়ল তার ওপর।

ছেলেটার নাম পটল। এ বছর এ স্কুলে ভর্তি হয়েছে। এর আগে পড়ত শান্তির হাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তাই সবার সঙ্গে এখনো ভাব হয়ে ওঠেনি।

আমি স্যার কাল খেয়েছি।

কাল খেয়েছিস!

জী, স্যার।

কোথায়?

আমাদের বাড়িতে।

তোকে খেতে দিল কারা?

কাল ছিল স্যার ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইন।

তো আমাকে দিতে চায়নি, আমি আপুদের বলে কয়ে নিয়ে একটা খেয়েছি।

দেখ, দেখ, পটল ভিটামিন খেয়েছে। আর তোমরা কখন খেয়েছ  সেটাই মনে করতে পারছ না।

সব ছাত্র-ছাত্রীর মুখ পানসে হয়ে উঠল। এ সুযোগে গুন্ডুইল্লা নড়েচড়ে উঠে বলল, স্যার আমিও খেয়েছি।

তুমিও খেয়েছ!

হ্যাঁ। তুমি কী জানো,  এই ভিটামিন কখন কোথায় খাওয়ানো হয়?

জানি স্যার, আপনার শিশুকে টিকা দিন কেন্দ্রে। ৬ মাস থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের।

তুমি বসো। তোমরা সবাই গুগলের জন্য একটা হাত তালি দাও।  তবে দুই হাতে নয়, এক হাতে।

এক হাতে কেমনে হাততালি দেব স্যার ? সমস্বরে বলল ছাত্র-ছাত্রীরা!

সেটাই বুঝলে না!  তোমার এক হাত, তোমার পাশের জনের এক হাত।

ওহ, তাই। সবাই সোৎসাহে তালি দিতে শুরু করল। তালির রেশ মিলিয়ে আসতেই স্যার বললেন, তোমাদের মধ্যে কে পারবে বয়সের বিষয়টি ক্লিয়ার করতে ?

এবার ক্লাস কাপ্তান নওরিন দাঁড়াল। এই চূড়ামণি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত সব ক্লাসের কাপ্তান। এমনকি পঞ্চম শ্রেণির খ শাখারও। এখানে একমাত্র মেয়ে কাপ্তান নওরিন।

বলল, স্যার  দু ধরনের ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়।  ৬ মাস থেকে ১১ মাসের শিশুদের নীল রঙের ক্যাপসুল, আর ১২ থেকে ৫৯ মাসের শিশুদের লাল রঙের ক্যাপসুল।

খুব ভালো বলেছ নওরিন।

এবার ভিটামিন স্যার ফার্স্ট বেঞ্চের লম্বা ছেলেটার দিকে ইঙ্গিত করল দাঁড়াতে।

ধরো,  তোমার  বোনের বয়স সাড়ে পাঁচ মাস তাকে কোন ভিটামিনটা খাওয়ানো যাবে?

কোনো ভিটামিন খাওয়ানো যাবে না।

কেন?

কারণ তার বয়স এখনো ছয় মাস পূর্ণ হয়নি।

ভেরি গুড। এবার ঐ লাস্ট বেঞ্চের কালো জামের  মতন ছেলেটা, তুমি বলো তোমার ভাইয়ের বয়স ৫ বছর পেরিয়ে ১দিন হয়েছে তাকে কোন রঙের ভিটামিন খাওয়াবে?

সে ঝটপট বলল, কোনো ভিটামিনই খাওয়াব না।

কেন?

কারণ তার বয়স ৫৯ মাস পেরিয়ে গেছে।

আমি জানতাম, কে কখন ভিটামিন খেয়েছ তা মনে না থাকলেও তোমরা অনেক কিছুই জানো।

গুগল, এবার তুমি বলো?  সব ছাত্র-ছাত্রীর চোখ নিবিড় হলো গু-ুইল্লার ওপর। গু-ুইল্লাদের বাড়িতে একটা টিকা কেন্দ্র আছে। তাদের দেউড়ি ঘরে মাসে একবার টিকাওয়ালারা বসেন। যারা এখানে টিকা দিতে আসেন তাদের কাছে সে জেনেছে এসব কেন্দ্রের নাম ইপিআই আউটরিচ কেন্দ্র। আর যারা এখানে কাজ করেন গ্রামের লোকেরা  তাঁদের ডাক্তার বলেই ডাকেন। তবে এঁদের কারও পদবি স্বাস্থ্য সহকারী, কারও  পরিবার কল্যাণ সহকারী।  এঁদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে থাকতে গিয়ে গু-ুইল্লা এসব জেনেছে।

ভিটামিন  বছরে কয়বার খাওয়াতে হয়?

২ বার স্যার।

ভিটামিন এ’র অভাবে কোন রোগ হয়?

রাতকানা।

রাতকানা কাদের হয়?

ছোট শিশুদের।

ছোট শিশুদের মানে  ১ মাস থেকে ৬ বছরের শিশুরা এই রোগে বেশি ভোগে, গুন্ডুইল্লার কথার সঙ্গে যোগ করল স্যার।

কোন শিশুর  রাতকানা হয়েছে কি না তা কীভাবে বোঝা যাবে? নওরিনের দিকে তাকিয়ে  জিজ্ঞেস করল স্যার।

চতুর্থ শ্রেণিতে নওরিন বিষয়টি পড়েছে। তবে কেন জানি তা মনে পড়ছে না। শুধু রাতের বেলা কথাটা মনের ভেতরে ওঠানামা করছে।  ঠিক এই শব্দটিই তার মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়ল, স্যার রাতের বেলা—-। ঠিক বলেছ,  রাতের বেলা বা  অল্প আলোতে যারা কম দেখে। কোনো  জিনিস খুঁজতে গিয়ে যে জায়গায আছে সেখানে না  খুঁজে  অন্য জায়গায় খোজে। হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খায়।

এই হলো রাতকানা। সবাই বুঝতে পেরেছ।

জী স্যার, বলে যেন পুরো এক বঙ্গোপসাগর গর্জে উঠল। গর্জনের ধ্বনি মিলিয়ে যেতেই ভিটামিন স্যার বললেন, ধরো রাতকানা হয়েছে তাহলে কী করতে হবে?

ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

না, ঐ যে টিকা কেন্দ্রের কথা বললে ওখানে নিয়ে যেতে হবে। সেখানে যে স্বাস্থ্যকর্মীরা টিকা দেন তাঁরা এ ব্যাপারে পরামর্শ দেবেন।  প্রয়োজনে ডাক্তারের কাছে পাঠাবেন।

কারও রাতকানা হলে এ কাজটি করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সময়মতো যদি রাতকানার চিকিৎসা না হয় তাহলে শিশুটি অন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাহলে বুঝতে পারলে সরকার কেন প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ শিশুকে ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ায়।

জী স্যার। বুঝেছি

তাহলে এখন থেকে ছোটদের, বড়দের,  সকলের চোখ বাঁচাতে, চোখের আলো ফকফকা রাখতে কী খেতে হবে?

পুরো ক্লাসে নেমে এলো নীরবতা। সে নীরবতা ভেঙে পেছন থেকে কে যেন বলে ওঠল,  কচুশাক, কচুশাক স্যার।

পুরো ক্লাস হো হো করে হাসিতে ভেঙে পড়ল। সে হাসির তোড়ে গুগলের গলার পারদ নিমেষে নেমে এলো শূন্য ডিগ্রীতে।  মনে হলো জীবনে প্রথম সে ভুল উত্তর দিল।

ভিটামিন স্যার সগর্বে বললেন, আমি জানতাম তুমি পারবে। আর তোমার বন্ধুরা কেন হাসলো জানো?

না, স্যার।

এত দামি দামি খাবার থাকতে তুমি কেন কচু শাকের কথা বলতে গেলে ?

শোনো ডিয়ার স্টুডেন্টস, কচুশাক হচ্ছে ভিটামিন এ এর রাজা। বাড়ির আশেপাশে অযতেœ অবহেলায় বেড়ে উঠলেও খাদ্যোপযোগী  প্রতি ১০০ গ্রাম কচুশাকে থাকে ১২০০০ মাইক্রোগ্রাম  ভিটামিন এ।