ভালোবাসার জাত নেই

অরূপ পালিত »

সকালের ঝুপঝুপ বৃষ্টি মনে করিয়ে দিল বর্ষা এসে গেছে। সারাঘরে কদমের মিষ্টি ঘ্রাণ আর ঘুমুতে দিচ্ছে না। গুনগুন মিষ্টিসুর কানে ভেসে আসে।
‘এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে
কর স্নান নবধারা জলে। …’
সাথে চায়ের মৌ মৌ গন্ধে বিছানায় শুয়ে থাকা দায়। শুক্রবারের ঘুমটা যেন ঝিলিক ইচ্ছে করে মাটি করে দিয়েছে।
বর্তমানে দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে সবকিছু। ঋতুরানির আগমনীবার্তায় এখন সবকিছু মেলে না। ব্যাঙের আর্তনাদ এখন আর নেই। সাপের দৌড়াদৌড়ি হারিয়ে গেছে সেই কবে।
আগে দেখা যেত ঋতুরানি আসলে গ্রামের খাল-বিলের থই-থই পানিতে মাছের চলাফেরা। কলাগাছের ভেলা বানিয়ে বিলের মাঝে মাছধরার কী যে আনন্দ! এখন সব ঋতুতে উল্টো হাওয়া বইছে। একটুখানি বৃষ্টি হলেই শহরের খানা-খন্দে পানি জমে হাঁটুর ওপরে।
অফিসগামী মহিলাদের জন্য বৃষ্টিপাত এখন খুব কষ্টের। অফিসে যাবার সময় সামান্য পায়ের গোড়ালির ওপরে কাপড় উঠলে দোকানে বসে ছেলেবুড়ো সবাই মজা নেয়। ইদানিং শহরের মানুষের মধ্যেও লাজ-শরম বলে কিছু নাই। বিশেষ করে বিবাহিত পুরুষেরা যেন আরও বেশি।
কয়েকদিন আগে ঝিলিক চাকরিতে যাওয়ার সময় চায়ের দোকান থেকে ওকে কে যেন কি বলেছে। বাসায় এসে নিতেনকে বললে সে উল্টো মন্তব্য করে। নিতেনের এই এক দোষ। সব সময়ই স্ত্রীর দোষ খুঁজে বেড়ায়। বেচারি ঝিলিক সারাদিন চাকরি করে এসে নিতেনের এসব শুনে-শুনে কান ওর ঝালাপালা হয়ে গেছে। তবে ঝিলিকও ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে নয়। মুখের ্রপর দু’চার কথা শুনিয়ে দেয়। পোষালে থাকেন, না পোষালে অন্য রাস্তা দেখেন। কখনও-সখনও দুজনের ঝগড়া ভয়াবহ রূপ নেয়।
নিতেন বলে, আমি কেন যাবো? যাওয়ার প্রয়োজন হলে তুমি যাও ।
: এক সেকেন্ডও চলবে না। আমি না থাকলে বাপবেটা না খাইয়া মরবা।
নিতেনের খোঁচা মারার স্বভাব।
: বিয়ের পর স্বামীছাড়া মেয়েলোকের কোনো দিকে যাওয়ার মুরোদ নেই।
নিতেন মুখের ভেতরে কথা রেখে চিবিয়ে-চিবিয়ে বলবে, ঘরের ভেতরে হাঁটছে যে তার গায়ের গন্ধে এখন ঘরে থাকা দায়।
ঝিলিককে রাগানোর জন্য নিতেন প্রায় এমন কথা বলে বসেন। সেই কথা নিয়ে ঝগড়া চলে সারারাত। অনেক সময় কাঁদতে কাঁদতে না-খেয়ে পড়ে থাকে ঝিলিক। আবার নিতেন ঝিলিককে খাবারের জন্যে তৈল মালিশ করতে হয়।
ভালোবাসা মানে অভিমান, রাগ, ঝগড়া। এতকিছুর মধ্যে দুজন দুজনকে ছাড়া কিছু বোঝে না।
ঝিলিককে অনেকবার নিতেন বলেছেন, চাকরিটা ছেড়ে দাও। কিন্তু পয়সার লোভ সামলাতে পারে কী? ছেলেটির জন্য তাদের মধ্যে যত অশান্তি। অথচ এই নিতেন ঝিলিককে বিয়ে করার পর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল বেশ কয়েক বছর। কারণ দু’জন দুই ধর্মের হওয়ায় অনেক বছর বাড়িতে যেতে পারে নাই। ছেলেটা হওয়ার পর নিতেন আর ছেলেকে নিতেনের পরিবারের সবাই মেনে নেয়। নিতেনের মায়ের স্পষ্ট জবাব, ওই মেয়ের হাতে তিনি ভাত খাবেন না।
চাকরিতে ঢোকার আগ ঝিলিক এবং ছোটভাইকে নিতেন পড়াতেন। একটা চাকরির জন্য পথে-পথে ঘুরেছে অনেক দিন। বিএ পাস করার পর শহরের আত্মীয়স্বজনের কাছে প্রতিনিয়ত ধরনা দিত। বড় বড় চাকরিজীবী আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করেছে অনেকবার। সবাই আশা দিয়েছে, কিন্তু কাজে আসেনি কেউ। শহরে এসে আত্মীয়স্বজনের স্বরূপ চেনা গেছে ।
নিকট আত্মীয় বলতে শহরে নিতেনের একমাত্র মামা। শেষমেশ মামার কাছে ঠাঁই হয়েছে নিতেনের। কিছুদিন যেতেই মামার বাসায়ও স্বস্তিবোধ হলো না। মামার শালাও থাকতো একই সাথে। নিতেন গ্রামের ছেলে। সকালে চা-পরটার চেয়ে পান্তাভাত খেতে পছন্দ। ভাত খাওয়া মামার শালার চক্ষুশূল। এ নিয়ে নিতেনকে খোঁটা দেয় সব সময়। সেই থেকে নিতেন সকালের ভাত খাওয়াও ছেড়ে দেয়। মামা কিছুটা সহনশীল হলে কী হবে। মামীকে ভয় করতো ভীষণ। মামীর মুখের ওপর মামা কথা বলতে পারতো না। মুখ বুজে সহ্য করতে হতো নিতেনকে।
নিতেন প্রতিদিন খবরের কাগজ দেখে চাকরির দরখাস্ত দিত। টাইপিস্ট পোস্টের কুমিল্লার পিডিবি থেকে একটি ইন্টারভিউ কার্ড আসে। মনে মনে বড় আশা করলো চাকরিটা বোধ হয় এবার হবে। কারণ টাইপের সাথে কম্পিউটারও জানেন নিতেন ।
ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে দেখেন, কেমন যেন লবিং চলছে মনে হলো। এক মেয়ের সাথে পরিচয় হয়। মেয়েটির বাড়ি চট্টগ্রাম হলেও সপরিবারে তারা কুমিল্লা থাকে। সবাই মেয়েটির দিকে হা-করে তাকিয়ে আছে। সে তেমন রূপবতী নয়। নীল সালোয়ার-কামিজের সাথে ম্যাচিং করে নীল টিপ, নীল লিপস্টিক। আর চোখে কাজল না দিলে বোধ হয় আরো বেশি ভালো লাগতো। খেয়াল করলে একটি চোখ লক্ষ্মীট্যারাও। সবকিছু বিধাতা নিজের হাতে তৈরি করেছেন।
কথা কথায় মেয়েটি হাসছে। টোলপড়া হাসি নিতেনের বুকের মধ্যে তিরের মতো বিঁধছে। কৃষ্ণকালো মেয়েটির চোখ দুটি মায়াবী। কিছুক্ষন মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিতেন। কথার ধরন বেশ স্মার্ট। মেয়েটার কথাবার্তায় বুঝতে বাকি ছিল না তারও কেউ এখানে চাকরি করেন। ওর ইন্টারভিউ যেন লোকদেখানো। কয়েকবার নিতেনের চোখে চোখ পড়েছে। কায়দা করে নিতেন জিজ্ঞেস করলো, আপু আপনার নাম। সহজভাবেই উত্তর দিল।
-অপু।
: আপনার এখানে কেউ কী চাকরি করেন?
: হুঁ। বড়বোনের স্বামী।
সবাই মুচকি-মুচকি হাসছে। আর ওর দিকে তাকাচ্ছে। মেয়েটির সাথে নিতেন ভাব জমাতে শুরু করেছে। চাকরি হবে না, সেটা নিশ্চিত হয়ে গেল। ভেতর থেকে একজন সুন্দরী মহিলা এসে অপুর কানে-কানে কী যেন একটা বলে গেছেন।
নিতেন বলল, উনি কে আপু?
– আমার দিভাই।
ও! আপনার দিভাই আপনার চেয়েও অনেক সুন্দরী। একটুখানি দুষ্টুমির ছলে নিতেশ বলল। আহা! এমন দিদি-আর দুলাভাই সবার ঘরে যেন থাকে।
একটি পোস্টের জন্য একুশজন প্রার্থী। সবাই নামে মাত্র অংশগ্রহণ করলো। রেজাল্ট দিতে দিতে সেই পাঁচটা বেজে গেল। অপুর চাকরিটা হয়ে যায় সেখানে। সবাই ওকে উইশ করলো। ৬টা বাজে ট্রেন। অপুকে ছেড়ে আসতে নিতেনের কষ্ট হচ্ছে। ঘণ্টাচারেকের আলাপ। মনে হলো দুজনের যেন হাজার বছরের পরিচয় ছিল।
নিতেন আসার সময় অপুকে কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারল না। ঘুরিয়ে বললো, যদি কিছু মনে না একটা কথা বলি। অপুর দুচোখ যেন ছানাবড়া হয়ে গেল। সে বুঝতে পারে, নিতেন কিছু বলতে চায় ।
: আপনার ঠিকানাটি আমি ব্যবহার করতে পারবো? আর কোনো কিছু গুছিয়ে বলতে পারলো না নিতেন ।
অপু কিছু যখন বলছে না বোঝা গেল সম্মতি আছে। একটি কাগজে নিতেনকে অপু ঠিকানা লিখে দেয়।
নিতেন স্টেশনে এসে দেখে রেল চলে যাচ্ছে। দৌড়ে কোনো রকমে ওঠে। আর একটু হলেই ট্রেন মিস হতো। রেলের ঝিকঝিক আওয়াজ যেন বুকের ভেতর ভাঙনের সুর তুলছে। না-চেনা মানুষের জন্য এ কেমন অনুভূতি নিতেন বুঝতে পারলো না। মনে হয় এটাই ভালোবাসা। জানালা দিয়ে মুখটা লাগিয়ে বসেছে নিতেন। মনে-মনে ভাবে কিসের জন্য আসলো আর কী বা হলো।
সূর্যের আলো আর নেই। অন্ধকার নেমে আসে প্রকৃতির নিয়মে। কালকের সূর্য ওঠার আগেই নিতেনের আবার বের হতে হবে চাকরির খোঁজে। বাসায় এসে নিতেনের মনের মধ্যে ছটফট করতে লাগলো অপুকে আরেকটিবার দেখার জন্য।
সাহস করে একটি চিঠি লিখল। অপু দেখা করার জন্য অনুমতি দেয়। কুমিল্লা বিশ্ব রোডের মাথায় যখন নামে, বেলা বারোটা। অপু নিতেনের সাথে দেখা করে শহর থেকে একটু দূরে গিয়ে। রিকশায় ওঠে নিতেন অপুর হাতটা শক্ত করে ধরে। অপুর চোখ ছলছল করছে। খাবার দোকানে গিয়ে বসল দুজনে।
অপুর চোখে-মুখে মধ্যে একটা ভয়-ভয় ভাব। সে দোকানে বসেও স্বস্তিবোধ করছে না।
অপু বললো তার বোনের স্বামীটা নাকি তেমন সুবিধার নয়। একটু সন্দেহপ্রবণ। অপুকে যদি দেখে ফেলে বোনকে গিয়ে অত্যাচার করবে। অপুর ইঙ্গিতে বোঝা যায় সে এখন অপুর দিকে হাত বাড়াতে চায়।
অপুকে নিতেন যে কতটুকু ভালোবাসে নিতেনের চোখ দেখেই বোঝা যায়। অপুর বুঝতে বা বলার বাকি থাকে না। সেদিন নিতেন একরকম শূন্য হাতে ফিরে আসে।
এভাবেই কেটে যায় ছয় মাস। আরও কয়েকবার নিতেন অনেক কষ্ট করে কুমিল্লা গিয়ে সরাসরি দেখা করে। নিতেন এবার সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। অপু বিয়ের জন্য আগায় না। উত্তর একটা, ধর্ম দুজনের দুটো।
অপুকে নিয়ে নিতেনের মনে সন্দেহ জেগে বসে। মোম আগুনের ছোঁয়া পেয়ে গলে যাচ্ছে না তো। শালি নাকি, বোনের স্বামী কে কার প্রতি দূর্বল! অনেক প্রশ্নের উত্তর সহজে মিলছে না আজ।
একটা সময় অপু নিতেনকে একটি শেষ চিরকুট দেয়। আপনি এখনো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেন নাই। আমার দায়িত্ব নেবেন কী করে? আর দুজনের ধর্মও তো আলাদা। আপনি এভাবে আমার অফিসের সামনে না আসলে আমার জন্য মঙ্গল হয়। এরপর চিঠি আদানপ্রদান বন্ধ করে দেয় অপু। দেখা করতে কুমিল্লায় গিয়েও কয়েকবার ব্যর্থ হয়। অপু আর নিতেনের সাথে দেখা করে না। হাজারও চিঠি জ্বলন্ত আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কয়েক বছর চলে যায় এভাবে।
নিতেনের সরকারি চাকরি হয়। অফিসের কাজে নিতেন ঢাকা যাওয়ার জন্য চট্টগ্রাম রেল স্টেশনে বসে আছে একদিন। হঠাৎ চোখ আটকে যায় অনেক দিনের চেনা একটি মুখ দেখে। ছোট ফুটফুটে একটি বাচ্চা কোলে নিয়ে রেল থেকে নেমে আসছে। অপুর সাথে যে পুরুষটি ট্রলি নিয়ে নেমেছে তার কোলেও একই কালারের জামাপরা একটি ফুটফুেেট বাচ্চা। বুঝতে বাকি নেই টুইন বেবি।
অপুকে দেখে নিতেনের বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কেন চোখের কোণে এতো জল, নিতেন বুঝতে পারলো না। ইচ্ছে হলো অপুর হাতখানা ছুঁয়ে দিতে। একটুখানি কথা বলতে। নারীরা তো পানির মতো। যে পাত্রে থাকে তখন তার রূপধারণ করে।
ইচ্ছে হলো কিছু বলতে। চাকরি তো আমি পেয়ে গেছি। কিন্তু কী হবে? এই ভেবে পা দুটো আর বাড়ালো না নিতেন। অপু তুমি কী করে পারলে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিতেন মনে মনে বলল, তুমি সুখী হও। নিতেন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে সিটে বসলো। সৃষ্টিকর্তা ওদেরকে ভালো রাখো। চোখ বেয়ে আসা নোনাজল হয়তো প্রথম ভালবাসার। মনে মনে ভাবলো বিয়ে আর নয়।
নিতেন ভালো সরকারি চাকরি পেল। কিন্তু পুরাতন একটা টিউশনি করতে বাধ্য হয়। মাঝপথে টিউশনিটা ছাড়তে পারে নাই।
ঝিলিকের ভাই মেট্রিকের ছাত্র। ঝিলিক কলেজে পা রাখার পর আর পড়ায় না। তবুও ঝিলিক সব সময় নিতেনের ওপর খবরদারি শুরু করে। নিতেন টিউশনটি কয়েকবার ছাড়তে চেয়েছিলেন। দিনে দিনে ঝিলিকের আচরণ সুবিধা মনে হচ্ছে না। লাজ-লজ্জা না রেখে সরাসরি বলল, আমি তোমাকে ভালোবাসি। নিতেন হতভম্ব। কী সাহস!
আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসে। নিতেন মনে মনে ভাবলো ঝিলিকের ভালোবাসা নিতান্তই কমবয়সের রোগ। অনেক বোঝানোর পরও ঝিলিক সে জায়গা থেকে সরলো না। নিতেন শেষমেশ বললো, হিন্দু আর বড়ুয়ার মধ্যে বিয়ে নাই। ঝিলিক অপুর কথা টেনে নিয়ে আসে। নিতেনের বাসায় গিয়ে সে সুইসাইড করতে চায়। নিতেন শেষমেশ ঝিলিকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়।
প্রথম ভালবাসা হারিয়ে নিতেন আর বিয়ে করবে না চিন্তা করেছিল। ঝিলিক যে এত কিছুর পরও নিতেনকে মেনে নিয়েছে তা-ও কম কিসের।
অন্ধকার রাতে দুজন পালায় সিলেটে। ঝিলিকের বাবার জন্য চাকরিতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে নিতেনকে। বিয়ের পর বন্ধুরা সাহায্য না করলে নিতেনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে যেত। নানা ধরনের চাপে চাকরিটা যায় যায় অবস্থা। ঝিলিক প্রাইমারি স্কুলের চাকরি পায়। ছেলেটি হবার পর নিতেন ঝিলিককে চাকরি ছেড়ে দিতে বলে। মা চাকরি করলে সন্তান মানুষ হয় না।
ঝিলিকের এক কথা সরকারি চাকরি ছাড়া যাবে না। বাড়াবাড়ি অনেক হয়েছে। ছেলে বড় হচ্ছে দেখে নিতেনও
বুঝতে পেরে হাল ছেড়ে দিলেন।
নিতেন ঝিলিককে দুঃখ প্রকাশ করে বলে, একটি মাত্র সন্তানকে যদি আমরা মানুষ করতে না পারি, আমাদের এই জীবন তাহলে ব্যর্থ।
ঝিলিক চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করে পড়ে রইলো। কাকে কি বলার মত। হঠাৎ করে ছেলে শোভন ঘরের ভেতর থেকে এসে নিতেনকে চুপ করতে বলে। নিতেন রাগের মাথায় থাপ্পড় মেরে দেয়।
তারপর দিন স্কুলে যাবার সময় শোভন বাবার সাথে আর কথা বলে না। নিতেনের কাছে দুপুর বারটার দিকে একটা ফোন আসে ছেলের স্কুল থেকে। আপনার ছেলে মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। নিতেন গিয়ে দেখে ছেলের গায়ে বেতের আঘাতে রক্ত ঝরছে। হেড টিচার নিতেনকে বলে, আপনার এই বেয়াদব ছেলেকে আমরা স্কুলে রাখতে পারবো না। কাল এসে টিসি নিয়ে যাবেন। ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা কখনো মিথ্যাকথা বলে না। শোভন দুষ্ট ছিল, তবে মারপিট করতো না। টিফিন নিতে গেলে হেড টিচারের ছেলে শোভনকে ধাক্কা মারে। সেটি হেড টিচার স্বাভাবিকভাবে না নিয়ে শোভনকে মারেন। বলেন, জাতের ঠিক নাই এদের।
নিতেনের সাথে টিচারের কথা কাটাকাটি হয়। ছেলেকে কোলে তুলে নিতে গিয়ে ওর ঘাড়ে হাত পড়ে। দেখেন ছেলের ঘাড় কালো হয়ে গেছে। আঘাতটি বেশ লেগেছে। ছেলেকে নিতেন মেডিকেলে নিয়ে যায়। দুদিন ছেলে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে সবার অগোচরে চলে যায়। নিতেন পাগলের মতো আচরণ শুরু করে। স্কুলে দৌড়ে এসে হেড টিচারকে লাঠি দিয়ে আঘাত করাতে টিচারের মাথা ফেটে যায়। হেড টিচার আবার সরকারি দলের নেতা। সরকারও টিচারের পক্ষে। টিএনও’রও এক কথা। মহিলার ওপর উনি হাত তুলতে পারেন না। আইন-আদালত তবে কিসের জন্য? ছেলের মৃত্যুর বিচার তো পায়নি, উল্টো পুলিশ এসে নিতেনকে ধরে নিয়ে যায়। পাঁচবছরের জেল হয়ে যায় নিতেনের ।
নিতেনের পক্ষে রাজসাক্ষী হিসেবে দাঁড়ায় জনগণ। সরকার সাজা কমিয়ে তিন বছর করে। ঝিলিক এবং নিতেনের মাঝখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় ঝিলিকের হেড টিচার। পাড়ার সবার মুখে-মুখে রটে গেছে দুজনের মধ্যে কিছু একটা চলছে। কোনো দিন নিতেনকে জেলে দেখতে যায়নি। জেল থেকে মুক্তি পেতে ইচ্ছে হলো না নিতেনের।
ভালোবাসা বলে একটা কথা। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর নিতেন বাসায় ফিরে রাতে। দরজা খোলা ছিল। নিতেন মনে মনে খুশি হয়। ঝিলিকের সবকিছু তিনি স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছেন।
ঘরের ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কয়েকবার ঝিলিককে ডাকার পরও কোনো সাড়া আসে না ভেতর থেকে। লাইটগুলো জ্বালিয়ে দিল। আলোয় নিতেনের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। ঝিলিকের নিথর দেহটি পাখার সাথে ঝুলছে। চিৎকারে আশপাশের লোকজন হাজির। পাড়া-প্রতিবেশী কেউ নিতেনের কথায় বিশ্বাস করলো না। পাড়া-প্রতিবেশী সবাই ঝিলিকের খুনি বলে নিতেনকে চিহ্নিত করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এটি যে তার বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র, কেউ বিশ^াস করতে চায় না। এইবার যাবজ্জীবন।
সৃষ্টিকর্তার এমনি ইচ্ছে ছিল মনে হয়। সাদাসিধে মানুষটিকে শেষ জীবনে সঙ্গীছাড়া কেন একা একা কাটাবে। তাই জেল হাজতে।