রেবা হাবিব »
গ্রামের নাম ভোলাবাড়ি। বাঁশঝাড়ের পাশে মাটির দেয়াল ঘর, উঠোনে সিম গাছের ছায়া, আর ছোট্ট টিনের চালের নিচে বসবাস করে মকবুল সাহেবের পরিবার।
মকবুল সাহেব একসময় স্কুলশিক্ষক ছিলেন। এখন বয়স হয়েছে, হাঁপানির জন্য বেশি হাঁটতে পারেন না। বড় ছেলে রাশেদ শহরে থেকে গার্মেন্টসে কাজ করে। ছোট ছেলে রাইহান দশম শ্রেণিতে পড়ে, আর মেয়ে মাহিরা সপ্তমে।
এই বছর ঈদের আগে থেকেই বাতাস ভারী। বাড়ির পাশের প্রতিটা ঘরে গরু বাঁধা, খুন্তি দিয়ে পা চুলকায়, কলা খায়। আর মকবুল সাহেব প্রতিদিনই ঘরের উঠোনে বসে দেখে সেই দৃশ্য। চুপচাপ।
রাশেদ ফোন করে জানিয়েছে, এইবার কুরবানির গরু আনার মতো টাকা নাই আব্বা। ছয় মাস পরে অগ্রিম কিছু দেবে অফিস থেকে, তখন কিছু হবে।
মকবুল সাহেব ‘আচ্ছা’ বলে ফোন কেটে দেন।
রাইহান ধীরে এসে পাশে বসে।
আব্বা, আমরাও পারি না গরু কিনতে?
মকবুল হেসে বলেন, মানুষ কি শুধু গরু দিলেই কুরবানি হয় রে? মন থেকে কাটা লাগে।
ছেলেটা চুপ করে যায়, কিছু বলে না। তবু তার চোখে অভিমান ঝুলে থাকে।
ঈদের দিন সকাল।
পূর্ব দিকে চাঁদের আলোর মতো আলো ছড়িয়ে আছে। চারপাশে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি। মসজিদের মাঠে ভিড়। নামাজ শেষে সবাই বাড়ি ফিরছে কুরবানির প্রস্তুতিতে। কেউ কেউ বলছে, মকবুল সাহেব কি গরু আনেননি?
না রে ভাই, ওর ছেলেটা শহরে আছে। কেমনে আনবে?
কেউ গা করেনি, কেউ গা করে।
রাইহান মুখ গোমড়া করে বসে। মাহিরা নতুন জামা পরে বসে আছে, কিন্তু হেসে উঠতে পারছে না।
রাহিমা খালা এসে বলে, ভাবি, একটু মাংস পাঠাবো?
মকবুল সাহেব বলেন, না না, নিজেরটা নিজে খাও। আমরাও আছি আল্লাহর রহমতে।
তার কণ্ঠ নরম, কিন্তু চোখে কষ্ট লুকানো যাচ্ছে না।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। রাহিমা খালা আরেকবার আসে। এবার হাতে একটা ঠোঙা।
এইটা মাহিরার জন্য। কুড়িরা কষ্ট করে জামা বানায় না, ভাবি। এইটা শহরের শাড়ির দোকান থেকে এনেছি।
মাহিরা চেয়ে থাকে। মকবুল সাহেব এবার কিছু বলেন না। শুধু মাথা নিচু করেন। রাইহান টিনের চালার দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ উঠে চলে যায় মাঠের দিকে।
গভীর রাত। চারপাশে নিস্তব্ধতা। মকবুল সাহেব উঠোনে বসে আছেন। তাঁর পাশে রাইহান চুপচাপ এসে বসে।
আব্বা?
হুম।
আমি বড় হয়ে কুরবানির জন্য গরু কিনবো। কিন্তু গরু কাটবো না।
কেন?
কারণ আমি আগে খুঁজে দেখবো, আমাদের মতো আর কেউ আছে কিনা যারা কাঁদে কিন্তু দেখায় না।
মকবুল সাহেব ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নেন। তার মনে হয়, ভাঙা খামারেই যেন ঈদের পূর্ণতা এসেছে।
সকালে গ্রামের মানুষ দেখে, মকবুল সাহেবের উঠোনে ছোট একটা দুধের প্যাকেট। আধা কেজি চাল আর কিছু শুকনো খেজুর রাখা। পাশে একটা চিরকুট- ‘এই কুরবানি, সবার জন্য।’
রাইহান কাউকে বলে না, সে গভীর রাতে পাশের গ্রামে গিয়েছিল। একটা মাদরাসা থেকে ছোট্ট সাহায্য নিয়ে এসেছে, যেটা এক আত্মীয় পাঠিয়েছিল ওখানে।
গ্রামের এক বৃদ্ধ ফিসফিস করে বলে, আসল কুরবানি তো এইটাই। গরু না, মন।