১০ বছরে কমেছে ২ হাজার ১শত ৫ হেক্টর জমি
রাজু কুমার দে, মিরসরাই :
মিরসরাই উপজেলা ও এর আশপাশের এলাকায় বিটি বালুর (জমি ভরাটের কাজে ব্যবহৃত) চাহিদা মিটিয়ে থাকে উপজেলার ইজারাকৃত তিনটি বালুমহল। কিন্তু বৈধ ইজারার নামে উপজেলার হিঙ্গুলী, ধুম ও করেরহাট ইউনিয়নের ফেনী নদীর পার্শ্ববর্তী চরগুলোতে বালু উত্তোলনের নামে ফসলি জমি কাটার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে কৃষি জমি কমে যাওয়ার কৃষকরা পড়েছেন বিপাকে। অনেক কৃষক নদীতে জমি হারিয়ে দিন কাটাচ্ছে কষ্টে। তবে ফসলের উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ায় অনেক কৃষক স্থানীয় দালালের খপ্পরে পড়ে স্বেচ্ছায় জমি বিক্রি করছে। আবার অনেকে পাশের জমি বিক্রি করায় বাধ্য হয়ে নিজ জমি বিক্রি করছে বালু সিন্ডিকেটের হাতে। ফসলি জমি কেটে বালু উত্তোলনসহ বিভিন্ন কারণে গত ১০ বছরে মিরসরাইয়ে কৃষি জমি কমেছে ২ হাজার ১শত ৫ হেক্টর।
মিরসরাই কৃষি অফিসের তথ্যমতে, ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভায় কৃষি জমির পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৫শত ৫ হেক্টর। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৪০০ হেক্টরে। অর্থাৎ গত ১০ বছরের কৃষি জমি কমেছে ২ হাজার ১শত ৫ হেক্টর। সবচেয়ে বেশি কৃষি জমি কমেছে বালু উত্তোলনকারী ইউনিয়ন করেরহাটে। ওই ইউনিয়নে ১০ বছরে কমেছে ১ হাজার ৫শত হেক্টর জমি।
কিছু দিন আগেও হিঙ্গুলী ইউনিয়নের দক্ষিণ আজমনগর গ্রামের বর্গাচাষি মিজানুর রহমানের সংসার চলতো চাষাবাদ করে। কিন্তু তার চাষাবাদের জমিতে নজর পড়ে বালু ব্যবসায়ীদের। ফল যা হওয়ার তাই হলো। নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করতে হলো তাদের কাছে। জমি হারিয়ে তিনি এখন সংসার চালান দিনমজুরি করে। শুধু মিজানূর রহমান নন, হিঙ্গুলী ও ফেনী নদীর সংযোগ স্থলে ৪৬ শতক জমি হারিয়ে দিশেহারা কৃষক জাফর উল্লা। যেখানে চাষ হতো ধান, ডালসহ বিভিন্ন ফসল। সেখানে এখন শুধু পানি। এমন অনেকে আছেন বালু সিন্ডিকেটের হাতে জমি হারিয়ে দিন কাটাচ্ছেন কষ্টে।
মিরসরাই উপজেলা ভূমি কার্যলয় সূত্রে জানা গেছে, প্রত্যেক বছরের মতো চলতি বছরও বাংলা ১৪২৭ সালের জন্য উপজেলায় সরকারিভাবে তিনটি বালুমহাল ইজারা দেয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৩৬ লাখ টাকায় করেরহাট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জসিম উদ্দিন ‘লিজা এন্টাপ্রাইজের’ নামে ওই ইউনিয়নের ২ নম্বর সিটে শুভপুর সেতুর দুই পাশে ৫০০ গজের মধ্যে ৮.৮০ একর জায়গা ইজারা নেন। ৩৮ লাখ ৫০ হাজার টাকায় করেরহাট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ সেলিম ‘মেসার্স সেলিম এন্টারপ্রাইজ’ এর নামে একই ইউনিয়নের পশ্চিম অলিনগরের ৬ নম্বর মৌজায় ফেনী নদী সংলগ্ন ২.৫০ একর মোল্লাঘাট নামে আরেকটি বালুমহাল ইজারা নেন। এছাড়া হিঙ্গুলী ইউনিয়নের পূর্ব হিঙ্গুলী মৌজার ৫৯৯ দাগের শেষে ও ২ হাজার ১৯৯ দাগের শুরুতে ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাছির উদ্দিন হারুন ১ লাখ ৮৬ হাজার টাকায় ১.৬২ একর ‘নাছির এন্টাপ্রাইজ’ এর নামে ইজারা নেন। এছাড়া জাফর কোম্পানি, ইব্রাহিম, জসিম তৌহিদসহ আরো ২০-২৫ জনের একটি সিন্ডিকেট বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
অবৈধ বালু উত্তোলনের বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রতিনিধি জানান, ইজারা এলাকার বাইরে গিয়ে বালু উত্তোলনের নামে চর কেটে কৃষকদের সর্বস্বান্ত করা হচ্ছে। চর কেটে কৃষি জমি নষ্টকারীদের আইনের আওতায় আনা উচিত।
এদিকে বালু উত্তোলন করতে গিয়ে গত ১৭ নভেম্বর হিঙ্গুলী খালের সংযোগস্থলে ডুবে ইকবাল হোসেন (২০) নামে এক বালু শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
সরেজমিনে বালু উত্তোলনের তিনটি ইজারা স্থানে দেখা যায়, ইজারাকৃত স্থানে বালু না থাকায় ইজারাদাররা এর ১-২ কিলোমিটার দূরে গিয়ে নামমাত্র মূল্যে চর কিনে শক্তিশালী ড্রেজার দিয়ে বালু তুলছে।
এ ব্যাপারে শুভপুর বালুমহালের ইজারাদার লীজা এন্টারপ্রাইজের মালিক সুলতান গিয়াস উদ্দিন জসিম বলেন, কিছুদিন আগে ইজারা এলাকার বাইরে গিয়ে চর কাটায় প্রশাসন ৭ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। ওই দিন থেকে আমরা আর চর কাটছি না।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বালু ব্যবসায়ীরা সুকৌশলে চর কেটে থাকে। তারা প্রথমে নদীর পাশের বালুযুক্ত জমিগুলোর একটি কিনে নেন। পরে ওই জমিতে খাড়াভাবে ৮০ ফুট গভীর পর্যন্ত বালু তুলে পার্শ্ববর্তী জমির মালিককে জিম্মি করা হয়। এ অবস্থায় ইচ্ছা না থাকালেও বাধ্য হয়ে পাশের জমির মালিক তার জমি বিক্রি করেন বালু ব্যবসায়ীদের কাছে। প্রতি শতক জমি মাত্র ৫-৬ হাজার টাকায় কিনে নেয় তারা।
এ বিষয়ে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সুবল চাকমা জানান, অবৈধ বালু উত্তোলনস্থলে সম্প্রতি একাধিকবার অভিযান চালিয়ে জরিমানা ও মেশিন পুড়ে ফেলা হয়েছে।
মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিনহাজ উদ্দিন বলেন, চর কেটে বালু উত্তোলনের বিষয়টি জানতে পেরেছি। শীঘ্রই অবৈধ বালু মহালগুলোতে অভিযান চালানো হবে।