তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী »
শব্দের পর শব্দ গেঁথে তিনি শুধু লিখেই চলেন। কোথায় থামতে হবে, কোথায় যতিচিহ্ন ‘দাঁড়ি’ বসাতে হবে তার হুঁশ নেই। অদম্য স্বতঃস্ফূর্ততায় তিনি টানা গদ্যে লিখে চলেন মহাসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গের মতো ভিন্ন মাত্রার এক জটিল লিখন কাঠামোয়, যেখানে দীর্ঘ বাক্য, কম অনুচ্ছেদ ব্যবহার করে তিনি পাঠককে দীর্ঘশ্বাসে তাঁর লেখায় নিবিষ্ট রাখতে সচেষ্ট থাকেন। এতে দেখা যায়, তিনি বাক্যকে এত দীর্ঘ করেন যে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা পাতার পর পাতা জুড়ে একক ও অবিচ্ছিন্ন অবস্থায় বিস্তৃত থাকে।
কথাসাহিত্যিক মাসরুর আরেফিনের কথায়, ‘বাক্যগুলো বড় থেকে বড়ই হচ্ছে, বাক্যগঠন ভারী থেকে আরও ভারী, যতক্ষণ না গল্প তার নিজের ভারেই গমনোন্মুখ’। পাঠকের এটা পড়তে, বুঝতে, সংশ্লিষ্ট ভাবনায় স্থির থাকতে অনেক সময় দম বেরুনোর উপক্রম হয়। সিরিয়াস পাঠক ছাড়া অন্যদের জন্য – এ এক দুরুহ সাহিত্য! সাধারণ্যের কাছে ‘অসংগতি ও অতিমাত্রায় অতিরঞ্জনে’র জন্য পরিচিত এ লেখক নিজেই একে মনোযোগী পাঠকের জন্য তার এক ধরনের পাগলামি আখ্যায়িত করে নিজের লিখন শৈলীকে পাগলামির সীমা পর্যন্ত বাস্তবতার পরীক্ষা হিসেবে বর্ণনা করেন। এ ধরনের ব্যতিক্রমী অথচ আপন স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল ভাষাশৈলীর অধিকারী কথাসাহিত্যিকের নাম লাসলো ক্রাসনাহোরকাই, যিনি এ বছরের সাহিত্যের সোনার হরিণ ‘নোবেল’ পুরস্কার জয় করে সাহিত্যবোদ্ধাদের নজর কাড়েন। মূলতঃ তিনি নোবেল পেয়েছেন, ‘তার মনোমুগ্ধকর ও দূরদর্শী শিল্পকর্মের জন্য , যা মহাপ্রলয়ঙ্করী ভয়ের মধ্যেও শিল্পের শক্তিকে প্রতিবিম্বিত করে।’ নোবেল কমিটির মতে, তিনি মধ্য ইউরোপীয় পরম্পরার একজন মহান মহাকাব্যিক লেখক, যার ধারায় রয়েছেন কাফকা থেকে থমাস বার্নহার্ড পর্যন্ত। ক্রাসনাহোরকাই হচ্ছেন দ্বিতীয় হাঙ্গেরিয়ান সাহিত্যিক, যিনি এ পুরস্কার জেতেন। এর পূর্বে ইমরে কের্তেস ২০০২ সালে মর্যাদাপূর্ণ এ পুরস্কার পান।
১৯৫৪ সালের ৫ জানুয়ারি দক্ষিণ- পূর্ব হাঙ্গেরির এক ছোট্ট শহর গিউলায় জন্ম নেয়া ৭১ বছর বয়সী লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, যিনি আইনজীবী পিতা ও সমাজকল্যান মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ‘সামাজিক নিরাপত্তা প্রশাসক’ মায়ের সন্তান এবং নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিলেও এক পর্যায়ে এসে তিনি জীবন বাস্তবতার স্তরকে স্পর্শ করতে নিছক খেয়ালের বশে তিন শ গরুর নাইট ওয়াচম্যান, খনি শ্রমিকের কাজ, জ্যাজ ব্যান্ডে পিয়ানো বাজিয়ে, ৬টি গ্রামের সংস্কৃতি কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক, সামরিক বাহিনীতে যোগদান- ইত্যাকার বিচিত্র কাজেরও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, যার ফলশ্রুতিতে তার লেখায় দুঃস্বপ্ন ও বিষন্ন মানব জীবনের নানা বিষয়-আশয় অন্বেষণ মুখ্য হয়ে ওঠে। তিনি মানব জীবনের কঠোরভাবে রক্ষিত গোপনীয়তা, দার্শনিক জিজ্ঞাসা, অস্তিত্বের অস্বস্তি, ভয় তথা অন্ধকার দিককে অনন্য লিখন কৌশলে আলোর পাদপ্রদীপে এনে অসহায় মানুষগুলোকে আলোর ঝরনাধারায় অবগাহন করাতে চেয়েছেন। ‘প্যারিস রিভিউ’ এ ডাস্টিন ইলিংওয়ার্থ বলেছেন, ‘লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এর নেশা বা আচ্ছন্নতা গোপন জিনিসের প্রতি, যেগুলো মানুষের জীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিক হিসেবে বিবেচিত।’
ক্রাসনাহোরকাই দুই ডজনেরও বেশি বই লিখেছেন। প্রবন্ধ ও ছোট গল্পও লিখেছেন অনেক। তবে উপন্যাস তাঁকে এনে দিয়েছে খ্যাতির গৌরব এবং তা সম্ভব হয়েছে তার অভাবনীয় লিখন কৌশলের কারণে, যা পাঠককে তার লেখায় নিবিষ্ট থাকতে বাধ্য করে। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো— সাতান্তঙ্গ, দ্য মেলান্কলি অব রেজিস্ট্যান্স, ওয়ার এণ্ড ওয়ার, সেইয়োবো দেয়ার বিলো, ব্যারন হেন্কহেইমস হোম কামিং, ডেসট্রাকশন এণ্ড সরো বিনিথ দ্য হেভেন্সঃ রিপোর্টাজ, দ্য ওয়াল্ড গোজ অন, স্পেডওয়ার্ক ফর আ প্লেস, চেজিং হোমার, আ মাউন্টেইন টু দ্য নর্থ, হারশট ০৭৭৬৯ ইত্যাদি ।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস সাতান্তাঙ্গো (শয়তানের নাচ)। এতে তুলে ধরা হয়েছে, প্রত্যন্ত গ্রামীন অঞ্চলের একটি পরিত্যক্ত সমবায় খামারে দরিদ্র সীমার নীচে বসবাস করা নিঃস্ব কিছু মানুষের জীবন চিত্র, যারা সমাজতন্ত্র পতনের ঠিক পূর্ব-মুহূর্তে স্বপ্নভঙ্গ, অনিশ্চয়তা ও হতাশার মধ্যে দিনাতিপাত করছিল। অবশ্য তাদের সাথে ছিল এস্তিকে (Estike) এর মতো ছোট মেয়ে, নির্মমতা তাকে পরাভূত করলেও তার ভেতর রয়ে যায় নিস্পাপ দৃঢ়তা। বেকথ্রু উপন্যাস হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এ উপন্যাসটি প্রকাশের পর পরই এটি হাঙ্গেরি সাহিত্য জগতে আলোড়ন তোলে। এ উপন্যাসকে ভিত্তি করে ১৯৯৪ সালে ৭ ঘন্টা দৈর্ঘেও একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন হাঙ্গেরির খ্যাতিমান পরিচালক বেলা তার। পরবর্তীতে ইংরেজিতে অনুদিত হলে ‘সাতান্তাঙ্গা’ ২০১৩ সালে ‘বেস্ট ট্রান্সলেটেড বুক অ্যাওয়ার্ড (ফিকশন)’ ও ২০১৫ সালে ‘ম্যানবুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ’ অর্জন করে। শয়তানে ট্যাঙ্গো নাচের উপন্যাস তার মনোবল এতোই বাড়িয়ে দেয় যে, এটি প্রকাশের সময় থেকেই তিনি স্বাধীন লেখক জীবন বেঁচে নেন।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের দ্বিতীয় উপন্যাস দ্য মেলান্কলি অব রেজিস্ট্যান্স (প্রতিরোধের বিষন্নতা) ১৯৮৯ সালে হাঙ্গেরিয়ান ভাষায় প্রকাশিত হয়, যার ইংরেজি অনুবাদ বেরুয় ১৯৯৮ সালে। ৩০০ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির পুরোটাই একটি মাত্র বাক্যে লেখা, ভাবা যায়!! খ্যাতনামা সিনেমা নির্মাতা বেলা তার এটিকে Werckmeister Harminies নামে ২০০০ সালে চিত্ররুপ দেন। পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত হাঙ্গেরিয়ান ছোট শহর কার্পাথিয়ান ঘিরে ভৌতিক কল্পকাহিনি ও নাটকীয়তায় ভরা এ উপন্যাসে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের চিত্র আঁকা হয়েছে। এতে দেখা যায়, শহরে একটা ভৌতিক সার্কাস পার্টি ঢুকে পড়ে, যাদের সাথে রয়েছে একটি বিশালদেহী মৃত তিমি এবং এক রহস্যময় প্রিন্স- যাকে কেউ দেখেনি, তবে ভয় পায়। একে উপলক্ষ করে অনেকে প্ররোচিত হয়ে নৈরাজ্য- সহিংসতা শুরু করে। নৈরাজ্য, সহিংসতা, অরাজকতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, সেনাবাহিনীও ব্যর্থ হয়। ফলতঃ স্বৈরাচারী অভ্যুত্থানে পথ তৈরি হয়। এ উপন্যাসের একটি চরিত্র Valuska (ভালুশকা)- সে বিশ্বাস করে পৃথিবীর বিশৃঙ্খলার মধ্যেও এক ধরনের শৃঙ্খলার বন্ধন আছে, যদিও সেই বিশ্বাসই শেষ পর্যন্ত তাকে শেষ করে দেয়। এই উপন্যাসে লেখক চমৎকারভারে দীর্ঘ বাক্যের গদ্য ফর্মেটে শৃঙ্খলা- বিশৃঙ্খলার নৃশংস দ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তুলেছেন, যা থেকে কেউই মুক্ত নয় ; যদিও মানুষই একমাত্র সত্তা- যে বিশৃঙ্খলার মাঝেও অর্থ তৈরি করে, ভাষা ও চিন্তায় মহাবিশ্বকে বোঝার চেষ্টা করে। এতে দেখা যায়, সার্কাস দল একপর্যায়ে শহর ছেড়ে চলে গেলেও তিমিটা ওখানে রয়ে যায় এবং তিমিটা এখনও পচছে, এ যেন চিন্তা বহু আগে মরে গেলেও লেখকের ব্যতিক্রমী লিখনশৈলী দীর্ঘ বাক্য গঠন চলছে।
ক্রাসনাহোকাইয়ের তৃতীয় উপন্যাস ‘ওয়ার এণ্ড ওয়ার’ ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয়। এটি ইংরেজিতে অনুদিত হয় ২০০৬ সাল। এই উপন্যাসের মূল চরিত্রে আছেন এক আর্কাইব কর্মচারী, যিনি জীবনের অন্তিম পর্যায়ে নিউইয়র্কে পাড়ি জমাতে মনস্হির করেন। এই উপন্যাসটি লেখার সময় এক পর্যায়ে তিনি লক্ষ করেন, এতে তিনি নিজেকে উপস্থাপন করে আত্মবিধ্বংসী পথে অগ্রসর হচ্ছেন, তখন তিনি উপন্যাসটির কাঠামোই বদলে ফেলেন।
২০০৮ সালে প্রকাশিত হয় লাসলোর উপন্যাস ‘সেইবো দেয়ার বিলো’। এতে তিনি নিবিড় নৈকট্যে যুক্ত হন এশীয় শিল্প ও দর্শন তথা বৌদ্ধ ভাবনার সাথে। তিনি বলেন, শিল্প হলো আমাদের নিয়তিস্বরুপ হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতির প্রতি মানবিকতার অসাধারণ প্রতিক্রিয়া। এটি এমন এক সীমানার অপর প্রান্তে রয়েছে, যেখানে আমাদের অবিরাম থমকে যেতে হয়।
ক্রাসনাহোরকাই উপন্যাসগুলোর মধ্যে ব্যারন হেন্কহেইমস হোম কামিং ( Baron Wenckheim’s Home coming) একটা গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস, যা ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে । তিনি এটিকে তার জীবনের সর্বোত্তম ও সবচেয়ে রসাত্মক কাজ হিসেবে বিবেচনা করেন। এতে তিনি সাহিত্যের প্রথাগত ঐতিহ্যকে তুলে ধরেন। এতে দেখা যায়, ব্যারন আর্জেন্টিনা থেকে বাড়ি ফিরে তার শৈশবের প্রণয়ীর সঙ্গে মিলিত হতে চাইলেও বিশ্বাসঘাতক দান্তের কারণে তা দূর-আস্ত হয়ে ওঠে।
লাসলোর সর্বশেষ কাজ হলো ২০২১ সালে প্রকাশিত ‘হারশট ০৭৭৬৯’। একে জার্মান সাহিত্যের একটা অনন্য উপন্যাস হিসেবে গণ্য করা হয়। এর গল্পে জার্মানীর ছোট্ট শহর থুরিঙ্গেনের সামাজিক অরাজকতা, জ্বালাও- পোড়াও ও হত্যা ঘটনা পরম্পরা তুলে ধরা হয়েছে। এটি মূলতঃ এক গ্রাফিতি পরিস্কারককে নিয়ে লেখা, যে তখনকার জার্মান চ্যান্সেলর মের্কেলেকে বিশ্বের পরিণতি বিষয়ে একটি চিঠি লিখে সতর্ক করেছিল। চারশ পৃষ্ঠার এ বইটিও একটি মাত্র যতিচিহ্ন ‘দাড়ি’ দিয়ে শেষ করা হয়। চলতি বছর (২০২৫) বইটি সুইডিশ ‘কুলতুরহুসেট সিটি থিয়েটার আন্তর্জাতিক পুরস্কার’ লাভ করার পর তার নাম নোবেল শর্টলিস্টের শীর্ষে চলে আসে।
লাসলো ক্রাসনাহোরকাইর তার দীর্ঘ জটিল পর্যবেক্ষণধর্মী বাক্য শৈলী সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘এই বাক্যগুলির সঙ্গে কোনো ভাষাতত্ত্ব, তত্ত্ব কিংবা হাঙ্গেরীয় বা অন্য কোনো ভাষা সংক্রান্ত চিন্তার সম্পর্ক নেই, এর জন্ম হয়েছে আমার উপন্যাসের ‘উন্মত্ত’ চরিত্রগুলোর কাছ থেকে। এই বাক্যগুলো আমি লিখি না ; এরা নিজেরাই উচ্চারিত হয়, আমি কেবল তা লিখে রাখি। আমি নিজে সম্পূর্ণ নীরব- একেবারে নিঃশব্দ। আর সেই নীরবতার মধ্যেই আমি শুনি, তারা কী বলছে। আমার কাজ কেবল সেই কথাগুলোকে লিখে ফেলা।’ তার প্রায় প্রতিটি লেখা অ্যাবসার্ডিটি এবং অদ্ভুত বিষয়বস্তু ও শিখন কৌশলের ঘেরাটোপে আঁটসাঁট বাঁধা হলেও পরিশেষে তা মানব জীবনের অনিবার্য পরিণতির দিকে ধাবমান। তাকে আপাতদৃষ্টিতে অপ্রাকৃত বিষয়বস্তু, একই কথার পুনরাবৃত্তি, ধৈর্যচ্যুতি, অতিরঞ্জন দুষ্ট মনে হলেও গভীর চিন্তা, নিঃসঙ্গ অনুসন্ধানে তিনি বাক্য গড়েন নীরব মাত্রা গুনে, যা প্রার্থনার মতো দীর্ঘ, আবেদনময়ী, ছায়াময় ও সুশৃঙ্খল এবং অনিবার্য ভাবে সৃজনশীলতা নীরব প্রদীপ জ্বালানো। সাহিত্যে তিনি আসলে ‘একটি একেবারে মৌলিক শৈলী গড়ে তুলতে চেয়েছেন’- ২০১৪ সালে নিউইয়র্ক টাইমসে এক সাক্ষাৎকারে তিনি তার এ ইচ্ছার কথা জানানও। ক্রাসনাহোরকাইর লেখা যতই দুর্বোধ্য, জটিল ও বিরক্তিকর দীর্ঘ হোক না কেন- সাহিত্য সন্ধিৎসু পাঠকদের জন্য তিনি এক পরম আরাধ্য ‘উত্তর- আধুনিক’ সাহিত্যিক— যিনি নিজে এক গভীর অস্তিত্ববাদী দ্বন্ধের মধ্যে অবস্থান করেন। তবে তিনি বলেন, আমাকে যদি ‘কাঠামোবিহীন মহাবিশ্ব ও কাঠামোবদ্ধ মানবজাতি মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বলা হয়, তবে আমি নিঃসন্দেহে মানবজাতিকেই বেছে নেব।