মোহাম্মদ অংকন :
বনের ভেতর এক শেয়াল বাস করতো। সে ছিল চালাক-চতুর আর দুষ্টুপ্রকৃতির। যে কাউকে এক নিমিষে বোকা বানাতে পারতো। এভাবে অন্যকে বোকা বানিয়ে কতোবার সে কতো কী যে করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। সবাইকে বিপদে ফেলে ‘হো’ ‘হো’ করে হেসেছেও। শেয়ালকে কেউ কখনও শাস্তি দিতে পারেনি।
সেই বনের পাশে একটা ছোট্ট গ্রাম ছিলো। সে গ্রামে বাস করতো এক মোরগ পরিবার। তাদের ছিল বারোটা বাচ্চা। ওরা দেখতে খুব সুন্দর আর মোটাতাজা। ওদের জন্য খাবার সংগ্রহ করতে রোজ বনের ভেতর আসতো মোরগ। শেয়াল এটি লক্ষ করে। আর ভাবে, এই মোরগকে বোকা বানিয়ে কিছু করা যায় কিনা।
শেয়াল যা ভাবে, তাই করে। একদিন মোরগকে দেখে সে এগিয়ে যায়। বলে, ‘মোরগভাই, তুমি তো রোজ-রোজ বনে আসো। অনেক-অনেক খাবার নিয়ে যাও। এতো খাবার কী করো?’
‘আর বলো না। আমার অনেক বাচ্চা আছে। ওদেরকে খাওয়াতে হয়। নইলে বেশ কান্নাকাটি করে ওরা।’
‘তোমার বাচ্চাদের সঙ্গে করে নিয়ে আসলেই তো পারো।’
‘না, ওরা তো অনেক ছোটো। বনের ভেতর হারিয়ে যাবে।’
মোরগের কথা শুনে শেয়াল ভাবে, ইশ্! মোরগ যদি তার সঙ্গে করে বাচ্চাগুলো আনতো, একটা না একটা বুদ্ধি বের করে ওদের খাওয়া যেতো। তখন কী যে মজা হতো। আমাকে অন্য কিছু ভাবতে হবে। যে করেই হোক, বাচ্চাগুলো আমার চাই।
পরের দিন বনের ভেতর মোরগের সাথে শেয়ালের আবারও দেখা হয়। বেশ সখ্য গড়ে তোলে। শেয়াল বলে, ‘মোরগভাই, তোমার বাচ্চাগুলো কেমন আছে?’
‘এই তো বেশ ভালো আছে।’
‘তা, ওরা কি লেখাপড়া কিছু শিখছে? নাকি তোমার খাবার খেয়ে শুধু বড়ো আর মোটাতাজা হচ্ছে?’
‘এখনও লেখাপড়া শুরু করেনি কেউ।’
‘এটা বললে তো হবে না, মোরগভাই। আমি শেয়ালপ-িত থাকতে তোমার বাচ্চাগুলো মূর্খ থেকে যাবে, তা তো কিছুতেই হতে পারে না। এতে আমারই দুর্নাম। আমি বনের কতোজনকে শিক্ষিত করেছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এজন্যই তো সবাই আমাকে শেয়ালপ-িত বলে ডাকে।’
‘এ বিষয়ে আমি কোনো কিছু বলতে পারবো না। আমার বউকে বলতে হবে।’
‘ঠিক আছে। তুমি তোমার বউকে আজ গিয়ে বলো আমার কথা। আগামীকাল এসে আমায় জানাবে কী বলেছে তোমার বউ। আমার বিশ^াস, তোমার বউ বুদ্ধিমতি। সে নিশ্চয় রাজি হবে।’
মোরগ সেদিনের মতো বন থেকে খাবার নিয়ে বাড়ি ফেরে। বাচ্চাগুলোকে খাবার খেতে দিয়ে মুরগি বউকে ডাকে। সে ‘কক্কর’ ‘কক্কর’ করতে-করতে মোরগের কাছে এগিয়ে আসে। তারপর মোরগ বলে, ‘হ্যাঁ গো, আমাদের এই সুন্দর বাচ্চাগুলোকে বনের শেয়ালপ-িত পড়াতে চায়। সে আজ আমায় বললো, সে নাকি আমাদের বাচ্চাগুলোকে শিক্ষিত করে তুলবে। সে এক মস্ত বড়ো প-িত। বনের সবাইকে সে পড়ায়। বনের রাজাও নাকি তাকে মান্য করে।’
মোরগের কথা শুনে মুরগি ভীষণ খুশি হয়। সেও ভাবে, আমার বাচ্চাগুলো পড়াশোনা শিখলে, শিক্ষিত হলে তো বেশ ভালোই হয়। তাই মোরগকে তৎক্ষণাৎ বলে, ‘ঠিক আছে। আগামীকাল থেকে শেয়াল প-িতকে আসতে বলিও। সে যেনো বাচ্চাগুলোকে পড়ায়।’
‘ঠিক আছে। আমি আগামীকাল বনে খাবার আনতে গেলে বলে আসবো।’
পরের দিন মোরগ বনে খাবার আনতে গিয়ে শেয়ালপ-িতের সাথে দেখা করে। আর বলে, ‘শেয়ালপ-িত, আগামীকাল থেকে তুমি আমার বাচ্চাগুলোকে পড়াবে। আমার বউ তোমার কথা শুনে খুশি হয়েছে। রাজি হয়েছে।’
‘বাহ্! বেশ ভালো হলো। আমি একটা কাজ পেলাম। বনের ভেতর থাকতে থাকতে কেমন যেনো লাগছিলো। তোমার বাচ্চাগুলোকে পড়ানোর জন্য হলেও তোমার গ্রামে যাওয়া হবে। আমার একটু বেড়ানোও হবে।’
‘তা তুমি বেশ বলেছো। তাহলে আগামীকাল থেকে আমার বাড়িতে চলে আসো।’
‘এ নিয়ে তুমি মোটেও ভেবো না। আমি যথাসময়ে হাজি হবো। তুমি তোমার বাচ্চাদের রেডি রেখো।’
‘ঠিক আছে, শেয়ালপ-িত।’
শেয়ালপ-িত মোরগকে যে এতো সহজে বোকা বানিয়ে ফেলবে তার এমন ধারণা ছিলো না। সে ভাবে, মোরগটাকে বোকা বানিয়ে ফেললাম। এবার বাচ্চাগুলোকে খেয়ে ফেলার পালা। আহ্! এতো বাচ্চা আমি একসাথে খাবো, ভাবতেই আনন্দ লাগছে।
মোরগের কথা মতো শেয়ালপ-িত মাস্টার সেজে মোরগের বাড়িতে হাজির হয়। মোরগ ও মুরগি শেয়ালকে দেখে ভীষণ খুশি হয়। তাকে বারান্দায় বসতে দেয়। তারপর মোরগ ও মুরগি তাদের বাচ্চাদের এনে শেয়ালের কাছে পড়তে দেয়। শেয়ালপ-িত বাচ্চাগুলো দেখে মুখ চটকাতে থাকে। মনে-মনে ভাবে, কীভাবে বাচ্চাগুলো খাওয়া যায়? মোরগ ও মুরগিকে এখান থেকে সরাতে হবে। সে কৌশল খুঁজতে থাকে।
শেয়ালপ-িতের মাথায় বুদ্ধির কোনো অভাব নেই। সে মোরগ ও মুরগিকে বলে, ‘আমি তোমাদের বাচ্চাদের পড়াতে আসলাম। আমার জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করো। বনের ভেতর অন্যদের যখন পড়াই, ওরা আমায় কতো কিছু খেতে দেয়। পেটটা ভরে যায়।’
‘নিশ্চয় তোমাকে খেতে দিবো, শেয়ালপ-িত।’ মোরগ বলে।
তারপর মোরগ ও মুরগি শেয়ালের জন্য নাস্তা খুঁজতে বাড়ি থেকে বাইরে যায়। বাড়ির পাশে নদী ছিলো। সেই নদীর দিকে ছোটে ওরা। তারা দুজন ভাবে, শেয়ালের প্রিয় খাবার তো কাঁকড়া। কয়েকটা কাঁকড়া ধরে নিয়ে গেলে নিশ্চয়ই সে খুশি হবে। আর তাদের বাচ্চাগুলোকে বেশ যতœ করে পড়াবে।
এভাবেই মোরগ ও মুরগি নদীর ধারে কাঁকড়া খুঁজতে থাকে। ওদিকে শেয়াল ফাঁকা বাড়ি পেয়ে সুযোগ আর হাতছাড়া করে না। লোভও সামলাতে পারে না। একে একে বারোটা বাচ্চা সে খেয়ে ফেলে। খেয়ে বাচ্চাগুলোর হাড় ও পাখনা বারান্দায় ফেলে রাখে। তারপর কয়েক মিনিট বিশ্রাম নেয়। আর ভাবে, এতো সহজে যে আজকের খাবারটা পেয়ে যাবো আমি ভাবতেই পারিনি। যাক গা, কয়েকদিন আর না খেলেও চলবে। এখন বনের ভেতর গিয়ে গুহায় ঘুমাতে হবে। যাতে মোরগ আমাকে খুঁজে না পায়।
শেয়ালপ-িত মোরগ ও মুরগির বাড়ি থেকে সোজা তার বনের ভেতর চলে যায়। একটু পর মোরগ ও মুরগি শেয়ালের জন্য কাঁকড়া নিয়ে হাজির হয়। এসে দেখে যে শেয়াল নেই, তাদের বাচ্চাগুলোও নেই। মোরগ ও মুরগি ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। এদিক-ওদিক খুঁজতে থাকে। কিন্তু পায় না আর। অতঃপর বারান্দায় চোখ মেলতেই দেখে হাড় ও পাখনা পড়ে আছে। দুজনের বুঝতে আর বাকি থাকে না শেয়াল তাদের সর্বনাশ করে পালিয়েছে। তখন যেনো তাদের মাথায় বাজ পড়ে।
অতঃপর মোরগ ও মুরগি বসে-বসে কাঁদতে থাকে। বাচ্চাগুলোর জন্য বড্ড আফসোস করতে থাকে। আর একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকে। মুরগি বলে, ‘তোমার জন্য আজ এই সর্বনাশ হলো। তুমি যে এতো বোকা, তা আমি বুঝতে পারিনি।’
‘সত্যি, আমি অনেক বোকা। নচেৎ এতো বড়ো ভুল কি কখনও হয় আমার?’
‘তুমি যেখান থেকে পারো, আমার বাচ্চাগুলো এনে দাও।’
‘তাকি আর সম্ভব? তুমি কেঁদো না।’
মোরগ তার মুরগি-বউকে সান্ত¡না দিতে থাকে। আর নিজেকে মনে মনে বলে, ‘আমি এতোটাই বোকা হলাম যে শেয়ালের কাছে বাচ্চাগুলোকে পড়তে দিলাম। আমি তো আর জানতাম না যে ধূর্ত শেয়াল প-িত সেজে এসে এতো বড়ো সর্বনাশ করবে। ওকে বিশ^াস করা আমার চরম ভুল হয়েছে।’
শিক্ষণীয় : শিক্ষিত ভেবে অপরিচিত কাউকে সহজে বিশ^াস করতে নেই। সে যে তোমাকে বোকা বানিয়ে তার কাজ উদ্ধার করে নিবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।