বৈষম্য থেকে মুক্তির প্রেরণা

কামরুল হাসান বাদল »

বায়ান্ন থেকে একাত্তর, মাত্র ঊনিশ বছরের মধ্যে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো। যার নাম হলো তার ভাষার নামে বাংলাদেশ। যে নীতি ও মতের ভিত্তিতে পাকিস্তানি রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছে তার বিপরীত মেরু অর্থাৎ একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের বিপরীতে জাতীয়তাবাদ ও ভাষাভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ একটি রাষ্ট্র ।
কাজেই বলা যায়, একুশের চেতনার একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
বায়ান্ন তথা একুশের ভাষা আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে ছিল একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন। ভাষা যেহেতু একটি সংস্কৃতির প্রধান বাহন সেহেতু ভাষা বিকৃত হলে কিংবা ভাষা হারিয়ে গেলে সংস্কৃতির বিলুপ্তি ঘটবে, জাতির অস্তিত্ব ও স্বকীয়তা বিপন্ন হবে সে কথা বা বাস্তবতা পূর্ববাংলার মানুষ ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছিল সেদিন।
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বিভক্ত হওয়া পাকিস্তানে তখন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও জাতীয়তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। আর বাঙালির ওপর অপর ভাষা উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা যে বাঙালিকে চিরতরে দাবিয়ে রাখার কৌশল তা খুব সহসাই উন্মোচিত হয়ে পড়েছিল। যে কারণে ভাষা আন্দোলনের গতি ও ব্যাপ্তি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল সমগ্র পূর্ববাংলা জুড়ে।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন সফল হওয়ার পর তার ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া আমরা পরবর্তীতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করি। বিশেষ করে রাজনীতিতে তা দ্রুত প্রভাব বিস্তার করে। এর ফলে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের শোচনীয় ভরাডুবি হয়। জয়লাভ করে যুক্তফ্রন্ট। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের কারণে পরবর্তীতে যুক্তফ্রন্ট সরকার টেকেনি বটে তবে ততদিনে বাঙালির মানসে জাতীয়তাবোধের স্ফূরণ ঘটেছে।
বায়ান্নের আন্দোলন এভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জাগরণ ঘটায়। গড়ে ওঠে সাংস্কৃতিক চেতনা। পুরো ষাট দশক জুড়ে রাজনীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক জাগরণও ঘটতে থাকে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দল। রবীন্দ্রনাথকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নিষিদ্ধ করে সরকার। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনায় যে উন্মেষ ঘটে তা ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে অসাম্প্রদায়িক, উদার ও গণতান্ত্রিক চেতনা।
সকল অনিয়ম, অন্যায্য ও বৈষম্য থেকে পরিত্রাণের আশায় আমরা একুশের চেতনার শরণাপন্ন হচ্ছি। কারণ একুশের চেতনাই পারে এই সমাজকে মানবিক করে তুলতে। সাংস্কৃতিক করে তুলতে। একুশের চেতনাই পারে সমাজ থেকে সকল কূপমণ্ডূকতার অবসান ঘটাতে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, আমরা এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সফল হতে পারছি না।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র ঠিক রাখতে না পারলে এর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা দুরূহ হয়ে পড়বে।
সমাজে আজ যে বৈষম্য, অনাচার, দুর্নীতি প্রাত্যহিক হয়ে উঠছে তা থেকে মুক্তি দিতে পারে পঞ্চাশ-ষাট দশকের মতো সাংস্কৃতিক জাগরণ। যখনই সমাজে অন্যায্য কিছু ঘটে, যখন বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠে তখন যে প্রতিবাদের দাবানল জ্বলে ওঠে তা একুশেরই প্রেরণা। বাঙালির হাজার বছরের যে সংস্কৃতি তার লালন ও চর্চাই পারে আমাদের সকল অশুভ শক্তি থেকে মুক্ত রাখতে। দুঃখ হয় তখন যখন দেখি সাইনবোর্ড বাংলায় লেখার জন্য নোটিস জারি করতে হয়। বাংলাকে প্রাধান্য দেওয়ার তাগিদ দিতে হয়। তাই এ কথাও আমাদের স্মরণ রাখা জরুরি যে, ভাষার অমর্যাদা করে, তাচ্ছিল্য করে জাতির স্বকীয়তা রক্ষাও সম্ভব নয়।