‘শুধু নির্দেশনা দিয়ে দায় সেরেছে স্বাস্থ্য বিভাগ’
শুভজিৎ বড়ুয়া :
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য ১২টি বেসরকারি হাসপাতাল নির্বাচিত করে ৪ এপ্রিল প্রজ্ঞাপন জারি করে চট্টগ্রাম স্বাস্থ্য বিভাগ। প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ ছিলো, ভেন্টিলেটর সুবিধাসহ ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হবে। কিন্তু বাস্তবে এ প্রজ্ঞাপনের কোনো আদেশ মানা হচ্ছে না। ফলে সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ সংকটে করোনা উপসর্গের রোগীদের বেসরকারি হাসপাতাল নিয়ে গেলেও ভর্তি নেয়া হচ্ছে না। ভর্তি নিলেও রোগী ও তার স্বজনদের পড়তে হচ্ছে নানা বিড়ম্বনায়।
আকবর শাহ এলাকার এক ভুক্তভোগী বীরবাহু বলেন, ‘আমার মায়ের প্রেশার ও ডায়াবেটিস বেড়ে গিয়ে খুব সমস্যা হয়েছিল। শারীরিকভাবে দুর্বল ও গায়ে জ্বর এসেছিলো। আমরা ইউএসটিসির একজন ডাক্তারকে কল করে বিষয়টি জানালে তিনি আমার মাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেন। উনার পরামর্শ অনুযায়ী ইউএসটিসি নিয়ে যাই। সেখানে ভর্তি করা নিয়ে তারা অনেক গড়িমসি করে। অনেক অনুরোধ করে ভর্তি করাই। কিন্তু কোনো ডাক্তার মাকে দেখতে আসেনি। ওখানে স্টাফ না থাকায় বাথরুমের অবস্থাও খুব বাজে। পরবর্তীতে সেই ডাক্তারও আর আমাদের ফোন ধরেননি, হাসপাতালে আমার মায়ের কোনো খোঁজও নেননি। চিকিৎসা না পেয়ে তাই বাধ্য হয়ে দুইদিন পর আমরা মাকে বাসায় নিয়ে আসি।’
এ বিষয়ে কথা বললে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউএসটিসি’র এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ইউএসটিসি’তে কর্মী ছাঁটাইয়ের কারণে হাসপাতালের পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। তাই এখন নানা অনিয়ম হচ্ছে। করোনা সংকটের সুযোগ নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নানা অনিয়ম করে রোগী সেবা বন্ধ করে দিয়েছে। পাশাপাশি স্টাফদের প্রতি আইন ও নিয়ম বহির্ভূত আচরণ করছে।’
বেসরকারি হাসপাতাল ও ল্যাব মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী খান বলেন, ‘সরকারিভাবে নির্দেশনা থাকলেও আমরা করোনাভাইরাসের উপসর্গ থাকা রোগী ভর্তি নিচ্ছি না। কারণ এখানে এমন রোগী ভর্তি করা হলে অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ হতে পারে। তাছাড়া আমাদের হাসপাতাল চালু রাখার একটি ব্যাপার আছে। করোনা রোগী শনাক্তের পর ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের বেসরকারি ম্যাক্স হাসপাতাল ও ন্যাশনাল হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে সাধারণ রোগীরা ভোগান্তিতে পড়েছেন। তাই নির্দিষ্ট গাইডলাইন না পেলে আমরা করোনাভাইরাসের রোগী ভর্তি করাবো না।’ চট্টগ্রাম স্বাস্থ্য বিভাগ শুধু নির্দেশনা দিয়ে দায় সেরেছে বলে অভিযোগ করছে বেসরকারি হাসপাতাল ও ল্যাব মালিক সমিতি।
স্বাস্থ্য দপ্তরে এ অভিযোগ জানালে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোস্তফা খালেদ আহমেদ বলেন, ‘সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী বেসরকারি হাসপাতালগুলোর আলাদা ভবনে বা ফ্লোরে কোভিড ও নন-কোভিড রোগী চিকিৎসা করতে হবে। গতকাল (শনিবার) বেসরকারি হাসপাতাল মালিকদের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। তারা পার্কভিউ ও রয়েল হাসপাতাল কোভিড রোগীদের জন্য ডেডিকেইটেড (বিশেষায়িত) করবে। আর বাকিগুলোতে কোভিড ও নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা করতে হবে। অন্যথায় হাসপাতালের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের গঠিত মোকাবেলা কমিটির চট্টগ্রাম বিভাগের সমন্বয়ক ডা. আ ন ম মিনহাজুর রহমান বলেন, ‘চট্টগ্রামে করোনা চিকিৎসায় এখনো আইসিইউ ব্যবস্থা হয়নি। ১২টি হাসপাতালের তালিকা করা হলেও সেগুলো অধিগ্রহণ করা হয়নি। এজন্য ওই হাসপাতালগুলো সেবা দিচ্ছে না। নির্দেশনা না মানার দায়ে কোনো ধরনের ব্যবস্থাও নিচ্ছে না স্বাস্থ্য বিভাগ। মূলত চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়হীনতার কারণে এমনটা হচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া ১০টি আইসিইউ বেড জেনারেল হাসপাতালে পৌঁছালেও এখনো স্থাপনের কাজ শেষ হয়নি। এছাড়া জেনারেল হাসপাতালের গোডাউনে পড়ে থাকা ৮টি আইসিইউ বেড সংযোজনের জন্য সরকার অনুমতি দিলেও সেগুলো এখনো সেখানে পড়ে আছে। আমরা ৭ দিনের মধ্যে আইসিইউ স্থাপন করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু কর্তৃপক্ষ নিজেরাই করবে বলে জানিয়েছে।’
এ ব্যাপারে জেলা করোনা মোকাবেলা কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াছ হোসেন বলেন, ‘১২টি হাসপাতাল নির্বাচন করা হয়েছে। তাদেরকে সেবা দিতে বলা হয়েছে। যদি তারা সেবা না দেয়, তাহলে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে স্বাস্থ্য বিভাগ।’
অন্যদিকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) এ সমস্যা নিরসনে হাসপাতালে রোগী সেবা না পাওয়ার তথ্য সংগ্রহ করছেন ও রোগী সেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন। এ বিষয়ে কথা বললে সিএমপি জনসংযোগ শাখার অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (জনসংযোগ) আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘এটি মূলত আমাদের দায়িত্ব না। কিন্তু চট্টগ্রামের জনগণ এখন হাসপাতালে গিয়ে সেবা পাচ্ছে না। ফলে অনেকে জীবন হারাচ্ছে। আমরা আমাদের দায়িত্ববোধ থেকে জনগণের পাশে থাকার চেষ্টা করছি। আমরা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের সাহায্যে এমন তথ্য সংগ্রহ করছি এবং তা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি।’
এ মুহূর্তের সংবাদ