মুহিতুল ইসলাম মুন্না »
গ্রামের শেষ প্রান্তের কুঁড়েঘরে থাকত বেণু আর তার মা। দিনমজুরির টাকায় কোনোমতে চলে যেত তাদের দিন। মা ছিল অসুস্থ, আর বেণুর কাঁধে সংসারের সব ভার। শীতকাল তখন, রাতের কুয়াশা চারদিকে ঢেকে দিয়েছে। চুলার আগুন নিভু নিভু। বেণু মা-কে লেপমুড়ে শুইয়ে দিয়ে বের হলো খেজুরের রস আনতে। পাশের জমিদারের বাগানে তার পরিচিত রাখাল রস সংগ্রহ করে। বেণু ঠিক করল, সকালে মায়ের জন্য পিঠে বানাবে। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেণুর গায়ের কাঁথা ভিজে গেল কুয়াশায়। কিন্তু সে থামল না। সে জানে, মা সকালে উঠে রস খেতে চাইবে। জমিদারের বাগানে পৌঁছে দেখে, রাখাল নেই। হিমেল হাওয়ার মধ্যে একাকী দাঁড়িয়ে সে অপেক্ষা করতে লাগল।
বেলা যত বাড়ে, ততই ঠান্ডা বেড়ে যায়। বেণুর মনে হলো, রাখাল হয়তো আসবে না। কিন্তু মা-কে খালি হাতে ফিরতে হবে এই ভেবে সে সরে যেতে পারল না। প্রায় ঘন্টাখানেক পর রাখাল এল। সঙ্গে নিয়ে এল রসের কলস। বেণুর চোখে তখন আনন্দের ঝিলিক। সে কলস নিয়ে দ্রুত বাড়ি ফিরল। মায়ের গায়ে লেপটা টেনে দিয়ে নিজের হাত-পা গরম করল চুলার ধারে। তার মন তখন খুশি মায়ের মুখে হাসি দেখার অপেক্ষায়।
সকাল হলে, মা সত্যিই আনন্দে বলল, ‘তুই না থাকলে আমার আর কে থাকত, বেণু!’ বেণুর চোখ ভরে উঠল ভালোবাসার আলোয়। সকালটা ভালোই কেটেছিল। বেণুর আনা খেজুরের রসে পিঠে বানিয়ে মা খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু পরের দিন সকাল থেকেই মায়ের জ্বর উঠল। শরীর একদম ভেঙে পড়েছে। গ্রামে ডাক্তার নেই। বেণু জানত, পাশের বাজারে এক ডাক্তার আসেন, তবে তাঁর কাছে যেতে হলে টাকা লাগবে।
বেণুর কাছে টাকা নেই। সারা দিন কাজ করে যে পয়সা জোগাড় করত, তা শেষ হয়ে গেছে মায়ের ওষুধে। কিন্তু সে হাল ছাড়ল না। বেলা না গড়াতেই গ্রামের পাশের খেতে কাজ খুঁজতে বের হলো। শীতের কুয়াশায় জমে যাওয়া ফসল কাটতে গিয়ে হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। তবুও সে থামল না। দিন শেষে সামান্য টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরল।
মায়ের দিকে তাকিয়ে বেণু বলল, ‘মা, আমি ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছি। তুমি চিন্তা করো না।’ মা কাঁপা গলায় বললেন, ‘তুই এত দৌড়ঝাঁপ করিস না, রে! আমিই তোকে নিয়ে বাঁচি।’ বেণু গ্রামের পথে ছুটল। বাজারে গিয়ে ডাক্তারকে বোঝাল তার মায়ের অবস্থা। ডাক্তার বেণুর মুখের দিকে তাকালেন। দরিদ্র কিশোরটির চোখে ছিল অসীম মায়া আর দায়িত্ব। তিনি বললেন, ‘চল, আমি তোর মাকে দেখে আসি। পয়সার চিন্তা করিস না।’
ডাক্তার বাড়ি ফিরে এসে মায়ের অবস্থা দেখে ওষুধ লিখে দিলেন। তিনি চলে যাওয়ার সময় বেণুর মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘তোর মতো সাহসী ছেলে কম। তোকে দেখে মনে হচ্ছে, এই মায়ের আশীর্বাদেই তুই বড় হবি।’ বেণু নতুন উদ্যম পেল। বাজার থেকে ধার করে ওষুধ নিয়ে এল। সেই রাতটাও ছিল শীতের রাত। কিন্তু এবার আর বেণুর মনে কুয়াশার শীতলতা ছোঁয়া লাগল না। তার মনে জ্বলছিল মাকে ভালো করার অঙ্গীকারের আগুন। বেণুর মা ধীরে ধীরে সুস্থ হলেন। তাদের অভাবের সংসারেও সুখের আলো ফিরল। মা বারবার বলতেন, ‘তুই আমার জীবন, বেণু। তোর জন্য আমি বেঁচে আছি।’ আর বেণু বুঝল, জীবনের সব শীতে তার একটাই লড়াই- মায়ের হাসি ধরে রাখা। বেণুর মায়ের শারীরিক অবস্থা ধীরে ধীরে ভালো হচ্ছিল। কিন্তু অভাব তাদের পিছু ছাড়েনি। শীতের দিনগুলোতে খাওয়া-পরার টানাটানিতে বেণুর কিশোর জীবনের আনন্দগুলো হারিয়ে গিয়েছিল। মায়ের মুখের হাসি ছিল তার জীবনের একমাত্র সম্পদ। কয়েকদিন পর, গ্রামের বড় জমিদারের বাড়িতে এক উৎসব হবে বলে সবাইকে কাজ দেওয়ার ঘোষণা এলো। বেণু কাজের সুযোগ পেয়ে আনন্দে মাতল। কিন্তু উৎসবের সকালে মায়ের জ্বর আবার বেড়ে গেল। এবার সে ভয় পেয়ে গেল। বেণু বুঝতে পারছিল না, মাকে রেখে কাজে যাবে কী না। তখনই মা বললেন, ‘তুই যাস, বাপ। আমি ঠিক আছি। তোর কষ্টে পাওয়া কাজ ছেড়ে দিলে আমাদের রান্না উঠবে না। মায়ের কথায় সাহস পেল বেণু। সে মাকে একটুকরো লেপে মুড়িয়ে কাজ করতে গেল।
জমিদারের বাড়ির কাজ ছিল কঠিন, কিন্তু পারিশ্রমিক ভালো ছিল। শীতের দুপুর থেকে সন্ধ্যা অবধি সে কাজ করল। রাতে কাজ শেষে হাতভর্তি খাবার আর ক’টা পয়সা নিয়ে বাড়ি ফিরল। কিন্তু ঘরে ঢুকে বেণু দেখল, মা গভীর ঘুমে। তার মনে একটু ভয় জাগল, মাকে না জাগানোই ভালো।
পরের দিন সকালে মা জেগে উঠে হাসিমুখে বললেন, ‘তুই ফিরে এলি দেখে বাঁচলাম, রে বেণু।’ বেণু মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘মা, তোর জন্য অনেক কিছু আনব। তুই সুস্থ হলে আমি তোর সব ইচ্ছা পূরণ করব।’
সেই দিন থেকে বেণু আরও বেশি কাজ শুরু করল। শীতের দিনগুলো পেরিয়ে যখন বসন্ত এল, তাদের কুঁড়েঘরে নতুন আশার আলো ফুটল। গ্রামের মানুষ দেখল, বেণুর নিষ্ঠা আর মায়ের ভালোবাসা অভাবকে জয় করে দিয়েছে।মা একদিন বেণুর মাথায় হাত রেখে বললেন, বেণু, তুই আমার ছেলে না, আমার জীবন। তুই থাকলে সব শীত মিষ্টি মনে হয়।’ বেণু মায়ের দিকে তাকিয়ে শুধু হাসল। সেই হাসিতেই ছিল শীতার্ত জীবনের সব জয়ের গল্প।