রাজিব শর্মা »
নিত্যপণ্যের চড়া বাজারে প্রায় সব পণ্যের মতো নীরবে বাড়ছে আমিষজাত খাবার শুটকির দাম। গত এক বছরের ব্যবধানে ছুরি, ফাঁইস্যা, লইট্যাসহ প্রায় সকল শুটকিতে কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে ২০০ থেকে ৫০০ টাকার বেশি। ছোট ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ার কথা বললেও বড় ব্যবসায়ীরা বলছেন স্বাভাবিক রয়েছে।
ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা জানান, অনান্য বছরের তুলনায় চলতি মৌসুমে শুটকি উৎপাদন কম হয়েছে। এছাড়া গত বছর জুলাই আন্দোলনকে ঘিরে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো দিয়ে গত কয়েকমাস বাণিজ্যে একটা বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। বর্তমানে ভারতের শুটকি বাজারে আসলেও মায়ানমারের শুটকির চালান কমেছে। ফলে দেশে উৎপাদিত শুটকির কদর বাড়লেও উৎপাদন কম হওয়ায় উৎপাদক পর্যায়ে দাম বেড়েছে। যার প্রভাব নগরীর শুটকির অন্যতম বাজার আছদগঞ্জের দোকানগুলোতে পড়েছে।
গতকাল সোমবার আছদগঞ্জ শুটকির আড়ত ঘুরে দেখা যায়, প্রায় সকল গুদামে আগের তুলনায় এ বছর শুটকি গুদামজাত কম রয়েছে। এছাড়া ভারত ও মিয়ানমার জল ও স্থল বন্দর দিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেক ব্যবসায়ী আমদানি কমিয়েছে। তার মধ্যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে বিভিন্নস্থানে অস্থিরতা বাড়ায় রাজনীতিতে যুক্ত শুটকি ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ আমদানি থেকে সরে আছেন। এতে শুটকির কিছুটা সংকট সৃষ্টি হয়।
তাছাড়া শুটকির দাম বাড়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা আমদানি ও পরিবহন খরচ, শুটকির কোল্ড স্টোরেজ খরচ , শুটকি উৎপাদনের খরচ ও লবণের দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকে চিহ্নিত করেন।
আছদগঞ্জ শুঁটকি ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য ও মেসার্স খাজা গরীবে নেওয়াজ এর পরিচালক নূরুল আলম বলেন, ‘অনান্য বছরের তুলনায় এবছর সমুদ্রের মাছের সরবরাহ কম হওয়ায় উৎপাদন অনেক কমেছে। আর যেসব মাছ বাজারে আসছে তা উৎপাদক পর্যায়ে গত দুইবছর ধরে দাম বাড়তি। আর শুটকি তৈরিতে লবণের প্রয়োজন হয় তার দামও বেড়েছে। যার কারণে শুটকির দাম কমছে না।’
আবার হিমায়িত মাছ রপ্তানিতে লাভ বেশি হওয়ায় শুঁটকি ব্যবসায় দাদন ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতা কমে গেছে। তাই তাদের আগ্রহ বেশি এখন হিমায়িত মাছ রপ্তানির দিকে। যে কারণে কমেছে শুঁটকির উৎপাদন।
শুটকি ব্যবসায়ী আহমেদ জুবায়ের বলেন, ‘দেশে শুটকির চাহিদা প্রায় ৫৫ হাজার টন। বাজারের প্রায় ৬০ শতাংশ শুটকি মিয়ানমার, ভারত ও পাকিস্তান থেকে আমদানি করা হয়।’
আছদগঞ্জ শুঁটকির আড়তে পাইকারি পর্যায়ে ছোট সাইজের ছুরি শুটকি কেজিপ্রতি ৩৫০ থেকে ৯০০ টাকা আর বড় সাইজের ৯৫০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা, চিংড়ির মধ্যে লাল চিংড়ি ১ হাজার ৪০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা, ভোলা চিংড়ি ২০০ থেকে ৪০০ টাকা, লইট্যা ৬০০ থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকা, মইল্যা ৬৫০ থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকা, পোঁয়া ৬০০ থেকে ১ হাজার টাকা, ছটি পোয়া ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা ফাইস্যা ৪৫০ থেকে ৮০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
এছাড়া চাপা শুটকি ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা, কামিলা ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা, কামড়াকামড়ি শুটকি ৮০০ টাকা, রূপচাঁদা ও লাক্ষা শুঁটকির কেজি ৩ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা। এসব শুটকি আবার খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের কাছে দ্বিগুণ বেশি দরে বিক্রি করছে নগরীর বাজারগুলোতে।
আছদগঞ্জ শুটকি ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওসমান হায়দার রানা বলেন, ‘কয়েকবছর ধরে শুটকির বাজার আমদানির ওপর নির্ভর করছে। গতবছর আমদানি স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকলেও এবছর মায়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় সরবরাহ বেশ কমেছে। আগে আমরা প্রতিদিনই শুটকি সরবরাহ করতাম, বর্তমানে মাঝে মাঝে একটা দুইটা শুটকির চালান আসছে। ফলে বাজারে শুটকির কিছুটা সংকট রয়েছে। তাই দাম কিছুটা বাড়তি।’
এদিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ থেকে ২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই থেকে ডিসেম্বর) দেশ থেকে প্রায় ২৫ লাখ ৪৫ হাজার ৫১৪ মার্কিন ডলারের সমমূল্যের শুটকি রপ্তানি হয়েছে। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ প্রায় ২৮ কোটি টাকা (প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ১১০ টাকা হিসাবে)। এর মধ্যে শুধু গত ডিসেম্বর মাসেই রপ্তানি হয়েছে প্রায় ১৪ লাখ ২৭ হাজার ডলারের সমমূল্যের শুটকি। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়ায় শুটকির একটা বড় অংশ গেছে হংকং, সিঙ্গাপুর, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও থাইল্যান্ডে।
আর চলতি বছর দেশে ৫৪ হাজার ৭৫০ টন শুটকির চাহিদা রয়েছে। যার মধ্যে ২২ হাজার টন দেশীয় উৎপাদন, বাকি ৩৩ হাজার টন আমদানি। চট্টগ্রাম থেকে রপ্তানি হওয়া শুটকির প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ আসে আছাদগঞ্জ ও চাক্তাই বাজার থেকে। ২০২১ থেকে ২২ অর্থবছরে ৪৭ লাখ টন মাছ ধরা হয়, যার ৭ লাখ টন শুটকি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।
শুটকির আড়তে শুটকি কম থাকার কারণ হিসেবে আছদগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবু নাছের বলেন, ‘গত বছর বঙ্গোপসাগরে পর্যাপ্ত মাছ ধরা পড়েছে। এবছর তেমন মাছ ধরা পড়ছে না। যার কারণে সরবরাহ সংকট তৈরি হয়েছে। আর ভারত থেকে সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও এলসি বুকিং খরচসহ বাড়তি দরে কিনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। যার কারণে শুটকির দাম আংশিক বাড়তি রয়েছে। আর দেশীয় পর্যায়ে যেসব শুটকি বিক্রি হচ্ছে তার দাম তেমনটা বাড়েনি।’
চট্টগ্রামের শুটকি উৎপাদন কেন্দ্রগুলো দক্ষিণ ও পশ্চিম বঙ্গোপসাগর, কর্ণফুলী নদীসহ বিভিন্ন এলাকার তীরে গড়ে উঠেছে। বাকলিয়া, ইছানগর, ডাঙ্গারচর, চাক্তাই, রাজাখালী, মইজ্যারটেক, জুলধাসহ ২ শতাধিক অঞ্চলে শুঁটকির আড়ত রয়েছে। যেখানে প্রতিদিন শত শত শ্রমিক কাজ করেন। আর দেশে কক্সবাজারের নাজিরারটেক, সোনাদিয়ার চর, মহেশখালী, সুন্দরবনের দুবলার চর, সুনামগঞ্জের ইব্রাহীমপুরসহ বিভিন্ন উপক‚লবর্তী এলাকায় শুটকি তৈরি করা হয়।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে উৎপাদিত মাছের অন্তত ১৫ শতাংশ শুকিয়ে শুটকিতে রূপান্তর করা হয়। মৎস্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২২ অর্থবছরে দেশে সমুদ্র উপক‚ল ও অভ্যন্তরীণ জলাধার থেকে প্রায় ৪৭ লাখ ৫৭ হাজার টন মৎস্য আহরিত হয়েছে। তার মধ্য থেকে ওই বছর ৭ লাখ টনের বেশি মাছ শুটকি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তারা জানান, ‘জলবায়ু পরিবর্তন, নদী ও খালবিলে পানি কম থাকায় এবার মাছ কম পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া নিরাপদ শুটকি উৎপাদন ও সংরক্ষণে শ্রমিক-ব্যবসায়ীদের নিয়ে আমরা কাজ করছি।’