বেড়েছে শিশুধর্ষণ ও হত্যা

রাজিব শর্মা »

অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যাসহ কন্যাশিশুদের প্রতি যৌন হয়রানির ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলছে নগরীতে। ঘটনার বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আপনজনেরাই শিশুদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে। অনেক সময় মুক্তিপণ না পেলে এসব শিশুর ওপর চলে নানা পাশবিক নির্যাতন।

নগরীর ইপিজেডে শিশু আয়াতকে ছয় টুকরা করে হত্যা, জামালখানে প্রথম শ্রেণির ছাত্রী বর্ষাকে ধর্ষণের পর হত্যা, পাহাড়তলীতে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী আবিদা সুলতানা আয়নী অপহরণ ও হত্যা, চান্দগাঁও থানার মোহরায় শিশু রহিম অপহরণ ও হত্যার পর পুলিশ ও প্রশাসনের কড়া নজরদারিতেও থেমে নেই এ ধরনের অপহরণ ও হত্যার ঘটনা। গত রোববার (২৭ আগস্ট) ফুচকার লোভ দেখিয়ে বন্দর থানায় প্রথম শ্রেণির এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হয়।

জানা যায়, আট বছর বয়সী ওই মাদ্রাসাছাত্রী পরিবারের সঙ্গে ইপিজেড কলসী দিঘির পাড় পকেট গেট এলাকার মহসিন কলোনিতে বসবাস করে। পাশের বাসায় থাকে মিরাজ নামের এক লোক। তার স্ত্রী পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। রোববার বিকেলে শিশুটিকে ফুচকা খাওয়ানোর কথা বলে তার বাসায় ডেকে নেন মিরাজ। এ সময় মিরাজের স্ত্রী বাসায় ছিলেন না। এ সুযোগে মেয়েটিকে বাসায় নিয়ে মিরাজ ধর্ষণ করেন। মেয়েকে খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে মিরাজের বাসার সানসেটে মেয়েকে দেখতে পান শিশুটির মা। এ সময় শিশুটি ভয়ে কাঁপছিল। সানসেট থেকে তাকে নামিয়ে জিজ্ঞাসা করলে মিরাজের অপকর্মের বর্ণনা দেয় সে। এ ঘটনায় মো. মিরাজ খলিফাকে (৩৩) গ্রেফতারের পর আদালতে প্রেরণ করে পুলিশ।

যেখানে স্কুলশিক্ষকই অপহরণকারী
এদিকে গত ১২ আগস্ট নন্দনকাননে পঞ্চম শ্রেণির ১১ বছরের এক কন্যাশিশু অপহরণের পর তাকে ১৪ আগস্ট বিকালে উদ্ধার করা হয় বান্দরবান থেকে। অপহরণকারী ছিলেন ওর স্কুলেরই এক শিক্ষক মঞ্জুরুল ইসলাম (৩৪)। এমন ঘটনায় শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নন্দনকানন এলাকাবাসী।

এখনও খোঁজ পাওয়া যায়নি সাঈমা-রাফির
প্রায় দুমাস পার হতে চললেও এখনো সন্ধান পাওয়া যায়নি তাজবীদ হোছাইন সাইমার (১৬)। সে ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ছাত্রী। গত ১৩ জুলাই জামালখান এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়। অন্যদিকে গত ১১ আগস্ট রাত সাড়ে ১১টার দিকে আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের তনজিমুল মোছলেমীন এতিমখানা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয় খাইরুল আল ইসলাম রাফি নামে ১০ বছরের এক শিশু। সাইমার পরিবার জানায়, পশ্চিম ষোলশহর খতিবেরহাট এলাকা থেকে সে প্রতিদিন একাই বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করতো। নিখোঁজের ঘটনার প্রায় দেড় মাস পার হয়ে গেলেও সন্ধান মেলেনি সাইমার।

বাসায় ফিরেছে ইনান
এদিকে নাসিরাবাদ সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের ১৭ বছরের কিশোর মোহাম্মদ ফারহান ইশরাক (ইনান) গত ১৬ আগস্ট বিদ্যালয়ে যাওয়ার নাম দিয়ে চলে গিয়েছিল কক্সবাজার। তার বাসা বায়েজিদ নগর আবাসিক এলাকায়। সন্তানকে না পেয়ে বায়েজিদ বোস্তামি থানায় সাধারণ ডায়েরি করে তার পরিবার। ঘটনার তিনদিন পর গত ১৯ আগস্ট রাতে সে বাসায় ফিরেছে বলে নিশ্চিত করেছে তার পরিবার।

তাছাড়া গত কয়েক মাসে নগরীতে মেয়েশিশু অপহরণ ও হত্যার বেশ কয়েকটি আলোচিত ঘটনা ঘটেছে।

গত ২৮ মার্চ নগরীর পাহাড়তলী থানার মুরগির ফার্ম আলমতারা পুকুরপাড় এলাকার একটি ডোবা থেকে ১০ বছরের শিশু আবিদা সুলতানা আয়নীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। গত ২১ মার্চ থেকে নিখোঁজ ছিল আয়নী। পুলিশের ধারণা, ধর্ষণের পর আয়নীকে হত্যা করে লাশ ডোবায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এ ঘটনায় মো. রুবেল নামের এক সবজি বিক্রেতাকে গ্রেফতার করা হয়।

এর আগে গত বছরের ১৫ নভেম্বর ইপিজেড এলাকার নয়ারহাট বিদ্যুৎ অফিসের সামনে থেকে নিখোঁজ হয় পাঁচবছরের শিশু আয়াত। এ ঘটনায় শিশুটির বাবা সোহেল ইপিজেড থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন। ঘটনার তদন্তে নেমে আয়াতদের বাসার সাবেক ভাড়াটিয়া আবিরের সম্পৃক্ততা পায় পুলিশ। জানা যায়, আয়াতকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করাই ছিল আবিরের লক্ষ্য। কিন্তু ঘটনার দিন তার মোবাইল ফোনের সিম কাজ না করায় আয়াতের পরিবারকে সে ফোন দিতে পারছিল না। একপর্যায়ে শিশুটি কান্নাকাটি শুরু করলে আবির তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। আবিরের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী পরবর্তী সময়ে আয়াতের লাশের খ-িত অংশ উদ্ধার করে পুলিশ।

এর আগে গত বছরের ২৪ অক্টোবর নগরীর জামালখান এলাকায় বর্ষা নামের প্রথম শ্রেণির এক ছাত্রী নিখোঁজ হয়। তিনদিন পর পাশের নালা থেকে বর্ষার বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয়। বর্ষাকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় এক দোকান কর্মচারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

এদিকে চলতি বছরের ২৯ এপ্রিল বিকালে টাকার জন্য চান্দগাঁও থানার পশ্চিম মোহরা এলাকার নির্মাণাধীন এক ভবন থেকে রহিম নামে ১১ বছর বয়সী পঞ্চম শ্রেণির শিশু রহিমকে অপহরণ করা হয়। অপহরণকারীদের চিনে ফেলাতে শিশুটিকে নির্মাণাধীন ভবনে নিয়ে গিয়ে হত্যার পর মাটিচাপা দেওয়া হয়। থানায় অভিযোগের ভিত্তিতে (৩ মে) আজম খান ও হৃদয় নামক দুই ব্যক্তিকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তাদের তথ্যের ভিত্তিতে দিবাগত রাত ৩টার দিকে শিশু রহিমের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

অপহরণ বাড়ছে উপজেলাতেও
অপহরণের ঘটনা শুধু নগরীতেই সীমাবদ্ধ নেই, বেড়েছে উপজেলাগুলোতেও। গত ৯ আগস্ট ফটিকছড়িতে বাড়ির পাশে পূজার ফুল তোলার সময় এক কিশোরীকে অপহরণ করা হয়। এ ঘটনায় ১২ আগস্ট র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছে দুই সহোদর মিনহাজুল ইসলাম রাহী (১৯) ও বড়ভাই মিরাজুল আলম (৩৩)।

অন্যদিকে গত ১৫ জুলাই পটিয়ার চরকানাই গ্রামের বাড়ি থেকে সন্ধ্যায় ৬ টায় বের হলে নিখোঁজ হন হালিমাতুছ সাদিয়া (২৫) নামের এক তরুণী। এ ঘটনায় থানায় জিডি করেছেন তার অভিভাবক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।

এছাড়া এ সময়ে শিশুদের ওপর যৌননিগ্রহ, হত্যা, নানা ধরনের নির্যাতন বাড়ছে বলে জানায় বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)। সংস্থাটির সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে শিশুহত্যার ঘটনা প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। ২০২১ সালে ১৮৩টি শিশু হত্যার খবর প্রকাশিত হয়, আর ২০২২ সালে এ সংখ্যা তিনগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯৭টিতে।

এমজেএফের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়কারী (গণমাধ্যম ও যোগাযোগ) শাহানা হুদা বলেন, শিশুধর্ষণের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। শিশুরা প্রতিহত করতে জানে না, ভয়ে ঘটনা গোপন করে। ফলে তারা প্রতিবেশী ও স্বজনদের দ্বারা বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

চট্টগ্রাম জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বলেন, মানুষের রুচির বিকৃতি যখন সর্বশেষ পর্যায়ে চলে যায়, তখনই শিশুর ওপর এমন ঘৃণ্য আচরণ বেড়ে যায়। তাছাড়া পারিবারিক বিশৃঙ্খল জীবনে শিশুরা অনেকটা আক্রমণের শিকার হচ্ছে। পরিবারের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতাও শিশুদের ওপর প্রভাব ফেলছে।

সিএমপি (উত্তর ও দক্ষিণ) গোয়েন্দা বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার নিহাদ আদনান তাইয়ান বলেন, ‘নগরীতে যে কয়েকটা শিশু অপহরণ, হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, প্রত্যেকটির সাথে জড়িতদের গ্রেফতারে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। এ বিষয়ে সিএমপি কমিশনারের কড়াকড়ি নির্দেশনা রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘অনেক সময় এ ধরনের ঘটনা দেরিতে জানানোর কারণে উদ্ধার তৎপরতা চালানো বা তদন্তে বেগ পেতে হয় পুলিশের।’