অরূপ পালিত »
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে যখন অবিভক্ত বাংলা সামাজিক ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতার পুরু দেয়ালে আচ্ছন্ন, নতুন আশার প্রতীক হয়ে তখনই এক নারী অন্ধকার ভেদ করে আবির্ভূত হন। তিনি হচ্ছেনবেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, যিনি নারীশিক্ষা, নারীঅধিকার, আত্মমুক্তি ও স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এক বিপ্লবী অধ্যায় রচনা করেছেন। তাঁর সাহিত্য, সমাজভাবনা ও সংগঠন, সবসময় প্রমাণ করে তিনি কেবল একজন লেখিকা নন, তিনি ছিলেন নবজাগরণের দিশারী, প্রতিরোধের কণ্ঠস্বর এবং নারী-মানবিকতার মূর্ত প্রতীক।
তাঁর জীবনযাপন, সংগ্রাম, আত্মশিক্ষা ও ত্যাগ নারীর অবস্থান সম্পর্কে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে সমাজকে। তাই তাঁর অনন্য ব্যক্তিত্ব, সমাজদৃষ্টি ও নারীবাদী চিন্তা আজও গবেষণার মূল আলোচ্য।
১৮৮০ সালে রংপুর জেলার মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দ গ্রামে জমিদার পরিবারে জন্ম বেগম রোকেয়ার । তাঁর পিতা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হাদার সাবের ছিলেন বহু ভাষায় দক্ষ ও জ্ঞানানুরাগী। কিন্তু কন্যাশিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন কঠোর রক্ষণশীল। এই দ্বৈততা-জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ ও নারীর প্রতি সংরক্ষণবাদ, রোকেয়ার মনকে গভীরভাবে ব্যথিত করেছিল। পরবর্তীতে তিনি সমাজের এই বৈপরীত্যকেই প্রশ্ন করতে শিখেছিলেন।
তাঁর বড় দুই ভাই ইব্রাহীম ও খলিলুর রহমান আধুনিক শিক্ষা শিক্ষিত হওয়া রোকেয়ার প্রতি তাঁদের উৎসাহ ছিল অপরিসীম। বোন করিমুন্নেসার সাহিত্যরুচিও তাঁর মনের গঠন ও বোধের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পর্দাবন্দি নারীর অভিজ্ঞতা, স্বাধীনচেতা ভাই-বোনের বহির্বিশ্ব জ্ঞান এবং ঘরোয়া শিক্ষার অনন্য মিশ্রণই রোকেয়াকে গড়ে তোলে দূরদর্শী সমাজচিন্তক হিসেবে।
শৈশবে কলকাতার একজন ইউরোপী শিক্ষিকার কাছে কিছুদিন পড়ার সুযোগ পেলেও সামাজিক বিরাগের কারণে তা থেমে যায়। রোকেয়া তবু তিনি দমে যাননি। আত্মশিক্ষার কঠিন পথে হেঁটে বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফার্সি ও আরবি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন জ্ঞানের দীপশিখা হিসেবে।
রোকেয়ার সাহিত্যপথ শুরু হয় ১৯০২ সালে নবপ্রভা পত্রিকায় প্রকাশিত গল্প “পিপাসা” দিয়ে। তাঁর লেখার ভিতর ছিল সমাজের ভূমিকম্প-সৃষ্টি করা সত্য; নারীজীবনের অবদমন, অবহেলা ও বঞ্চনা তিনি তুলে ধরেছিলেন নিঃসংকোচে।
১৯০৫ সালে প্রকাশিত ইংরেজি গল্প “ঝঁষঃধহধ’ং উৎবধস” তাঁকে আন্তর্জাতিক ভাবে পরিচিত করে তুলে। এখানে তিনি নারীশাসিত লেডিল্যান্ড-এর স্বপ্নরাজ্য রচনা করেন, যেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শান্তি ও প্রগতির সর্বোচ্চ শিখরে নারী অবস্থান করছে। আর পুরুষরা আবদ্ধ-এক প্রতীকী প্রতিবাদ, সামাজিক শিকল ছিন্ন করার এক চমৎকার কল্পসাহিত্যিক কৌশল। এই রচনা নারীবাদী ইউটোপিয়ান সাহিত্যের প্রথম দিককার অসামান্য উদাহরণ।
১৮৯৮ সালে রোকেয়ার বিবাহ হয় ভাগলপুরের প্রগতিশীল ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তাঁর স্বামী ছিলেন চমৎকার একজন মানুষ এবং আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। রোকেয়ার প্রতিভার প্রতি ছিল গভীর শ্রদ্ধা। স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় রোকেয়া সাহিত্যচর্চার পূর্ণ সুযোগ লাভ করেন। তিনি দেশি-বিদেশি বিভিন্ন লেখকের রচনা পড়ে নিজের দৃষ্টিকে আরো প্রসারিত করেন, ইংরেজি ভাষার ওপরে দক্ষতা অর্জন করেন এবং সমাজের তুলনা বহুগুণ অগ্রসর মনোভাব গড়ে তোলেন। কিন্তু ১৯০৯ সালে স্বামীর মৃত্যু এবং এর আগেই দুই কন্যার অকালমৃত্যু তাঁকে হতাশাগ্রস্ত করে তোলে।
রোকেয়া বিশ্বাস করতেন শিক্ষা হচ্ছে নারীসমাজের মুক্তির প্রথম চাবিকাঠি। তাই ১৯০৯ সালে ভাগলপুরে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। পরে তিনি কলকাতা এসে ১৯১১ সালে স্কুলটি আবার নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। সমাজের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি নিরলস পরিশ্রমে বিদ্যালটিকে প্রসারিত করেন। ১৯১৬ সালের স্কুলটির ছাত্রীসংখ্যা শতাধিক হয়, যা সে সময়কার রক্ষণশীল সমাজে এক বিপ্লবী ঘটনা।
নারীর সামাজিক উনয়œনের স্বার্থে সাংগঠনিক কাজও তিনি গুরুত্ব সহকারে শুরু করেন। ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’, যার উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম নারীদের শিক্ষাদীক্ষা, সামাজিক সচেতনতা, দায়িত্ববোধ ও আত্মরক্ষার মানসিকতা তৈরি করা।
১৯২৬ সালে নারীশিক্ষা সম্মেলনে সভাপতিত্ব এবং ১৯৩০ সালে বঙ্গী মুসলিম সম্মেলনে বাংলা ভাষার পক্ষে দৃপ্ত অবস্থান নেওয়া তাঁর ব্যক্তিত্বের দুঃসাহসী দিককে প্রকাশ করে।
রোকেয়ার নারীবাদ কোনো এক পাশ্চাত্য তত্ত্বের অনুকরণ নয়; ছিল তাঁর নিজের জীবন, অভিজ্ঞতা, সমাজযাত্রা ও বোধ থেকে উৎসারিত। তাঁর দৃষ্টি ছিল সমাজতাত্ত্বিক, যুক্তিনিষ্ঠ এবং মানবিক।
১. নারীর অবস্থান সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি:
তিনি লিখেছেন “আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ। আমরা পড়ে থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে?”
নারীর অধিকারবঞ্চনার জন্য তিনি যেমন পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকে দোষারোপ করেন, তেমনই নারীর নিজের অচেতনতা, ভীরুতা ও অলসতাকেও দায়ী করেন।
২. স্বাধীনতা ও আর্থিক স্বনির্ভরতা:
তিনি আরো বলেন “পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। প্রয়োজনে আমরা লেডি কেরানি, লেডি ম্যাজিস্ট্রেট, লেডি ব্যারিস্টার-সবই হইব।” তিনি চেয়েছিলেন নারী যেন নিজের শ্রম, মেধা ও জ্ঞান দিয়ে অর্থ উপার্জন করে নিজের মর্যাদা রক্ষা করে।
৩. নারীর আত্মশক্তিতে বিশ্বাস:
রোকেয়া বলেছিলেন-“সৃষ্টিকর্তা তাকেই সাহায্য করেন, যে নিজেকে নিজে সাহায্য করে।” তিনি নারীদের শিখিয়েছিলেন-স্বপ্ন দেখতে হবে, চেষ্টা করতে হবে, নিজের অধিকার আত্মস্থ করতে হবে।
১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর নিজ জন্মদিনের সকালে ‘নারীর অধিকার’ শীর্ষক প্রবন্ধ লিখতে-লিখতেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। কলম হাতে নিয়ে বিদায় নেওয়া যেন তাঁর সারা জীবনের সংগ্রামের প্রতীকচিহ্ন।
পরবর্তীতে তাঁর স্মৃতিকে অমর করে রাখতে’ প্রতিষ্ঠিত হয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালসহ বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রোকেয়া হল, প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর উদ্যাপিত হয় ‘বেগম রোকেয়া দিবস’, প্রতিবছর প্রদান করা হয় বেগম রোকেয়া পদক, ডাক বিভাগ স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। এবং গুগল তাঁর জন্মদিনে ডুডল প্রদর্শন করে তাঁকে আন্তর্জাতিকভাবে সম্মান জানায়।
বেগম রোকেয়া ছিলেন এক অনন্য আলো, যে আলো অন্ধকারের ভিতর থেকে উঠে এসেছিল এবং অন্যদের আলোকিত করেছিল। তাঁর রচনার জ্যোতি, সাহসী কণ্ঠস্বর, সংগঠনিক দক্ষতা ও নারীর মর্যাদার স্বপক্ষে দৃঢ অবস্থান তাঁকে বিশ্ব ইতিহাসে এক বিরল ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।
তিনি বুঝেছিলেন নারী যদি অগ্রসর না হয়, সমাজ এগোবে না, নারী যদি শিক্ষিত না হয়, মানবসভ্যতা জাগ্রত হবে না, নারী যদি স্বনির্ভর না হয়, স্বাধীনতা কখনও পূর্ণ হবে না।
তাই তাঁর সংগ্রাম আজও আমাদের পথ দেখায়। তিনি ইতিহাসে নক্ষত্রের মতো দীপ্ত।সমাজে তিনি জাগরণের আলোকস্তম্ভ। আর নারীজীবনে তিনি অটল প্রেরণা অবিনশ্বর।





















































