বিচিত্র কুমার »
সবুজপুর নামের ছোট্ট একটি গ্রাম। নামেই বোঝা যায়, এখানকার মানুষ গাছ ভালোবাসে। গাছের ছায়ায় বসে গল্প করে, গাছের ফল খেয়ে মুখ মিঠে করে। এই গ্রামেই থাকে খোকা, বয়স মাত্র আট। ওর সবচেয়ে প্রিয় কাজ গাছ লাগানো আর পাখির ডাক শোনা। খোকার দাদু একদিন বলেছিলেন, “গাছ লাগালে বর্ষা হাসে, পৃথিবী খুশি হয়।” খোকা কথাটা বুকের মধ্যে রেখে দিয়েছে।
বর্ষা আসতে আর কয়েকদিন বাকি। আকাশে মেঘ জমছে, বাতাসে ছুটে চলেছে পাখির দল। এমন সময় খোকার স্কুলে এক নতুন খবর এল। প্রধান শিক্ষক ঘোষণা করলেন, “এবার বর্ষবরণ হবে একটু অন্যরকম। পান্তা-ইলিশ নয়, পটকা নয়, আমরা বর্ষাবরণ করবো বৃক্ষরোপণ দিয়ে! প্রতিটি শিশু একটি করে গাছ লাগাবে স্কুল মাঠে।”
শিশুরা আনন্দে হাততালি দেয়। খোকা বলে ওঠে, “আমি আমগাছ লাগাবো!” ওর বন্ধু মুনা বলে, “আমি কদম! বর্ষার ফুল!” সবাই মিলে ঠিক করে এই বর্ষা হবে সবুজের উৎসব।
পরদিন সবাই গাছ খুঁজতে ব্যস্ত। খোকা দাদুর পুরোনো বাগানে গিয়ে ছোট্ট এক আমগাছের চারা পায়। মা বলেন, “গাছ লাগানো মানে সন্তানের মতো যত্ন নিতে হয়।” স্কুলের মাঠ যেন পরদিন রঙিন বাগান! কেউ এনেছে জাম, কেউ লেবু, কেউ আবার বেলগাছ। প্রধান শিক্ষক সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, “এই গাছগুলো একদিন আমাদের ছায়া দেবে, ফল দেবে, আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে। আজকের এই বর্ষবরণ হবে প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্বের দিন।”
শুরু হয় বৃক্ষরোপণ। খোকা মাটি খুঁড়ে আমগাছটা বসায়। একমুঠো জল ঢেলে বলে, “তুই বড় হ, আমগাছ। তোর ছায়ায় আমি ঘুমাবো, খেলবো, কবিতা লিখবো।”
সবাই মিলে মাটি দেয়, পানি দেয়, ছোট ছোট ফিতে দিয়ে চারা বেঁধে দেয় বাঁশে। তারপর একসঙ্গে সবাই মিলে গান গায়,
“বর্ষা এলো গাছে পাখি,
আমরা গাই সুখের সুর।
গাছ লাগাই, প্রাণ বাঁচাই,
সবুজ হোক আমাদের ঘর।”
খোকা প্রতিদিন স্কুলে এসে তার গাছের খোঁজ রাখে। পানি দেয়, আগাছা তুলে ফেলে। বন্ধুদের বলে, “শুধু গাছ লাগালেই চলবে না, যত্নও নিতে হবে।” কয়েক সপ্তাহ পরে বর্ষা জোরে নামে। গাছগুলো যেন চোখের সামনে বড় হতে শুরু করে। খোকার আমগাছে দেখা যায় ছোট্ট কুঁড়ি। খোকা দৌড়ে গিয়ে দাদুকে খবর দেয়, “দাদু! আমার গাছে কুঁড়ি এসেছে!”
দাদু হেসে বলেন, “দেখিস, একদিন তোকে সে আম দিয়ে ধন্যবাদ জানাবে!”
গাছটা যেন খোকার বন্ধু হয়ে ওঠে। ঝড়-বৃষ্টিতে সে চিন্তা করে গাছটার কথা, গরমে পানি দিয়ে ভাবে, ‘আমার মতোই ওরও তো তৃষ্ণা পায়।’
একদিন স্কুলে সবাই আবার জড়ো হয়। এবার তারা দেখে সব গাছই বেড়ে উঠছে। কেউ ফুল দিয়েছে, কেউ কচি ডাল। শিক্ষক বলেন, “এই গাছগুলো শুধু গাছ নয় তোমাদের উপহার, আগামী পৃথিবীর প্রাণ। তোমরা যেমন বড় হচ্ছ, ওরাও বড় হচ্ছে। তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে ওদেরও যত্ন নিতে হবে।”
খোকা আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে মেঘেরা হাসছে, পাতায় পাতায় বৃষ্টির টুপটাপ। আর তার ছোট্ট আমগাছটা মাটির বুক চিরে মাথা তুলছে।
সে মনেই মনে বলে
“এই হোক আমার বর্ষবরণ সবুজ দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে, জীবনের গল্প দিয়ে।”
পাখিরা ডেকে ওঠে। ঝিরঝির বৃষ্টিতে মাঠ ভিজে যায়। আর সবুজপুরের মাঠে জন্ম নেয় এক নতুন স্বপ্ন
বৃক্ষরোপণের মধ্যে দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে মেলবন্ধনের বর্ষবরণ।