বুলেট

শ্যামল বণিক অঞ্জন »

এ্যাই চা গরম! চা গরম! হাঁক ছাড়তে ছাড়তে বুলেটগতিতে এগিয়ে এসে গরম চা ভর্তি ফ্লাক্সটা উঁচু করে ধরে বললো, চা লাগবো কি স্যার?
খুব একটা ইচ্ছা না থাকলেও মায়াবী চেহারার ছোট্ট ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে আর না করতে পারলাম না। বললাম, দাও এক কাপ। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে বললাম, বাহ, চা তো খুব ভালো হয়েছে!
আমার কথা শুনে বুলেটের মুখটাতেও বেশ তৃপ্তির ছায়া লক্ষ্য করলাম। বললো, হ স্যার, বেচাও ভালাই হয়, হগলেই কয় খুব ভালা চা আমার!
আমি : তো কেমন বেচাকেনা হয় প্রতিদিন?
বুলেট : অয় তিন-চাইর শ।
আমি : লেখাপড়া জানো কিছু?
বুলেট : না, আমরা গরিব মানুষ পড়ালেহা করুম ক্যামনে?
আমি : কেন তোমার বাবা নেই?
বুলেট : হুনছি আছে কিন্তু দেহি নাই কুনুদিন।
আমি : মানে?
বুলেট : হুনছি আমার জন্মের আগেই আমার মায়েরে ফালাইয়া চইলা গ্যাছে।
আমি : কোথায়?
বুলেট : ঢাহায় থাহে, আরেকটা বিয়াও করছে।
আমি : তোমার মা কি করে?
বুলেট : মাইনসের বাড়িত কামকাজ করে।
আমি : থাক কোথায়?
বুলেট : নদীর হেই পাড়ে।
কোমলমতি ছোট্ট শিশু বুলেটের জীবনের করুণ কাহিনি আমাকে আপ্লুত করে তুলছে ক্রমান্বয়ে। ওর সম্বন্ধে আরো অনেক কিছু জানবার আগ্রহটাও আমার বেড়ে যাচ্ছে।
আমি : তোমার নামটি তো খুব সুন্দর, তা নামটি কে রেখেছে?
বুলেট : ওস্তাদে রাখছে।
আমি : এই ওস্তাদটা কে?
বুলেট : আগে যেইহানে কাম করতাম, হেই ওস্তাদ।
আমি : কোথায় কাজ করতে?
বুলেট : গ্যারেজে। আমি খুব তাড়াতাড়ি কইরা সব কাজকাম কইরা ফালাইতাম বুইল্লা ওস্তাদে আমারে বুলেট কইতো আর হেই নামডাই এহন চালু হইয়া গ্যাছে গা।আমারো খুব ভালা লাগছিলো নামডা।
আমি : এমনিতে তোমার আসল নাম কি?
বুলেট : আমার ভালা নাম রাব্বি। আমি কিছু জিগ্যেস করার আগেই বুলেট ওর মোটর গ্যারেজে কাজ করাকালীন সময়ের কষ্টের, অভিজ্ঞতার কথাগুলো আমাকে নির্দ্বিধায় অনর্গল বলে যাচ্ছিলো। কথাগুলো শুনতে শুনতে কখন যে আমার চোখের পাতা দুটো ভিজে উঠেছে বুঝতেই পারিনি।
বুলেট : এহন যাইগা স্যার, চা বেচতে হইবো
আমি : আচ্ছা যাও। তোমার অনেকটা সময় নষ্ট করলাম, খুব ভালো লাগলো তোমার সাথে কথা বলে। বুলেট বিনয়ের সাথে বললো, না স্যার অসুবিদা নাই। আমারো ভালো লাগলো অনেক কতা কইতে পাইরা।
পকেট থেকে একটা পাঁচ শত টাকার নোট বের করে বুলেটের হাতে ধরিয়ে দিতে চাইলাম। প্রথমে নিতে চাইলো না কিছুতেই আত্নসম্মানী ছেলেটি। অনেক জোরাজুরির পরে হাতে নিলো। আমি বললাম, তোমার যেটা মনে চায়, এটা দিয়ে কিনে নিও।
ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসির ঝিলিক দিয়ে বুলেট বললো, ঠিক আছে।
সালাম দিয়ে একরাশ খুশি নিয়ে জীবিকার তাগিদে বুলেটগতিতে পথ হাঁটা শুরু করলো বুলেট। জানি না এই তপ্ত মরুর পথ হাঁটা ওর মতো শত-সহস্র বুলেটের কবে কোথায় গিয়ে শেষ হবে! কবে পাবে অধিকার, আশ্রয় খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষার নিরাপদ জীবনের সন্ধান! এই রকম আরো অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো চলতে চলতে পথে।