নিজস্ব প্রতিবেদক, রাঙামাটি »
তারা যেনো যুদ্ধজয়ী পাঁচটি নীল অপরাজিতা। জীবনে বহুবার কারণে বা অকারণে আসতে হয়েছে যে শহরে, আর দশজন নাগরিকের মতোই, নিতান্তই প্রয়োজনে কিংবা প্রাত্যহিকতায়, সেই শহরেই এমন বীরোচিত সংবর্ধনায় আরেকবার আসাটা যে কতটা সুন্দর হতে পারে তারই যেনো বর্ণিল প্রদর্শনী হলো পার্বত্য শহর রাঙামাটিতে।
পার্বত্য তিনকন্যা রূপনা-ঋতুপর্ণা-মনিকা-আনাই-আনুচিং এর বুধবার রাতের প্রথম প্রহরে মগাছড়িতে ঋতুপর্ণার বাড়ি প্রবেশ করার সময় এলাকাবাসীর মশাল জ্বালিয়ে ঘরে ফেরানোর বিরল দৃশ্যটিকেও যেনো ছাড়িয়ে গেছে বৃহস্পতিবারের সকাল। যে স্কুলে পড়ে এবং খেলে তারকা হয়েছে পাঁচ মেয়ে সেই স্কুলের আয়োজনটি স্বাভাবিক কারণেই তাদের কাছে ছিলো অনেক বেশি আবেগের, ভালোবাসার।
প্রিয় প্রধান শিক্ষিকা তন্দ্রা দেওয়ানের নেতৃত্বে সকালেই তাদের ঢাকঢোল বাজিয়ে বরণ করে নেয়ার আয়োজনটি তাদের পাঁচজনের কাছে অন্য সবকিছুই, সব আয়োজনের চেয়েই আলাদা। তাই তাদের চোখে মুখে তৃপ্তি আর উচ্ছাসও ছিলো দেখার মত। স্কুলের প্রিয় শিক্ষক-শিক্ষিকা, সেই প্রিয় খেলার মাঠ আর অনুজদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে দুপুর গড়ানোর পর পুরো জেলাবাসির আয়োজনে যেনো সামিল পাঁচ চ্যাম্পিয়ন। পাঁচ কন্যাকে খোলা গাড়িতে রাঙামাটি শহর ঘুরিয়ে এনে সংবর্ধনা দেয়া হয়, বৃহস্পতিবার বিকালে শহরের চিং হ্লা মং চৌধুরী মারি স্টেডিয়ামে।
ঘাগড়া থেকে রূপনা চাকমা, ঋতুপর্ণা চাকমা, মনিকা চাকমা, আনাই মগিনী ও আনুচিং মগিনীকে ফুল সজ্জিত ট্রাকে করে জেলার প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে শহরের মানিকছড়ি, ভেদভেদী, কলেজ গেইট, রাজবাড়ি হয়ে চিং হ্লা মং মারী স্টেডিয়ামে তাদেরকে আনা হয়। প্রায় দুই শতাধিক মোটরসাইকেলের বহর আর অর্ধ শতাধিক অন্যান্য গাড়ির বহর নিয়ে বিশাল সুসজ্জিত ট্রাকে যখন শহরে প্রবেশ করছিলো পাঁচ পার্বত্য কন্যা, যখন যেনো উৎসবের আমেজে রঙিন হয়ে উঠে রাঙামাটির নীল আকাশ, সবুজ পাহাড়। উচ্ছাস যেনো আঁচড়ে পড়ছিলো ধীরস্থির কাপ্তাই হ্রদের নীল জলরাশিতে। এসময় সড়কের দুইপাশে শত শত মানুষ হাত নাড়িয়ে অভিনন্দন জানায় বাঘিনীদের।
এ সময় শুভেচ্ছা বক্তব্যে ঋতুপর্ণা চাকমা বলেন, রাঙামাটিবাসীর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। আমি আসার আগে কল্পনা করিনি, এভাবে সকলের ভালোবাসা পাবো। এ ভালোবাসা পেয়ে আমি অনেক আনন্দিত। রাঙামাটিবাসীকে অনেক অনেক ভালোবাসা। আপনারা আমাদের পাশে ছিলেন এবং আপনাদের অনুপ্রেরণায় আমরা আরও এগিয়ে যাবো।’
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংসদীয় খাদ্য মন্ত্রাণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার এমপি বলেন, আমাদের মেয়েরা আজ সাফজয়ী, এটি আমাদের গর্ব। তাদের দেখাদেখি অন্যরাও অনুপ্রেরিত হয়ে খেলাধুলায় এগিয়ে আসবে বলে আশা করি।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংসদীয় খাদ্য মন্ত্রাণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার এমপি। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ, পৌর মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরী।
অনুষ্ঠানে দীপংকর তালুকদার এমপি, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ, বিজিবি সেক্টর কমান্ডার, রাঙামাটি সেনাজোন, রাঙামাটি পৌরসভা, জেলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে ক্রেস্ট ও ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়। পুরো আয়োজনে নেতৃত্ব দিয়েছে রাঙামাটি জেলা প্রশাসন ও রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ।
বিকাল পাঁচটায় শুরু হওয়া সংবর্ধনা আলোচনায় উচ্ছাসে যখন শেষ হয়েছে তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে পশ্চিমাকাশে। চিংহ্লামং চৌধুরী মারি স্টেডিয়ামে উপস্থিত হাজার দুয়েক মানুষ এক অসাধারণ অনুভূতি নিয়ে যেনো বাড়ি ফিরেছেন, এমন বিরল উপলক্ষ শেষে।
পুরো আয়োজনে তৃপ্ত রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। তিনি বলছেন, ‘আমাদের মেয়েদের এই অর্জন আমাদের জন্যই গর্বের। তাই আমরা মিলে চেষ্টা করেছি সেই মেয়েদের জন্য কিছু করতে। এটা অন্যরকম একটা অনুভূতি, বলে বোঝানো যাবে না।’