মোহীত উল আলম »
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “কর্ণকুন্তী সংবাদ” কবিতাটির আমি চিরকালের ভক্ত। বিশেষ করে সে জায়গায়টায় যেখানে কুন্তী পুত্র কর্ণকে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরুর আগের রাতে নিভৃত এক সাক্ষাৎকারে ডেকে তাঁকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বলেন। কর্ণ হচ্ছে কুন্তীর আগের ঘরের ছেলে। আগের ঘরের ছেলে বলতে সাধু দুর্বাশার আশীর্বাদে কুন্তী বরপ্রাপ্ত হয়ে সূর্যদেবের ঔরসে কর্ণের জন্ম দেন। তারপরে তিনি কর্ণকে ফেলে হস্তিনাপুরের রাজা পন্ডুকে বিয়ের করেন। কিন্তু দেবতার অভিশাপের কারণে রাজা পন্ডু সন্তান জন্মদানে সক্ষম ছিলেন না। তখন কুন্তী তাঁর প্রাপ্ত বরের সৌভাগ্য ব্যবহার করে দেবতাদের ঔরসে যুধিষ্ঠির (ধর্মদেব), ভীম (বায়ুদেব) এবং অর্জুনের (ইন্দ্র) জন্ম দেন। তিনি তাঁর বর ব্যবহার করে পন্ডুর অপর স্ত্রী মাদ্রির ঘরে জমজ ছেলে যথাক্রমে নকুল এবং সহদেবের জন্ম দিতে সহায়তা করেন। এই পাঁচ ভাইকে মহাভারত কাব্যে পঞ্চপান্ডব নামে অভিহিত করা হয়।
অন্য দিকে কুন্তীর ফেলে যাওয়া সন্তান কর্ণকে একটি নদীর ধারে কুড়িয়ে পায় অধিরথ এবং রাধা নামক এক দম্পতি। অধিরথ ছিলেন রথচালক, যাদের গোত্রীয় নাম ছিল সূত। কর্ণ কালক্রমে বিরাট যোদ্ধা হিসেবে নাম করেন, এবং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে রাজা দুর্যোধনের সেনাবাহিনীর অন্যতম সেনানায়ক হন। কিন্তু তাঁর মাতা কুন্তী যে স্বপ্নে দেখলেন তাঁর বড় ছেলে, যাঁকে তিনি প্রকাশ্যে কখনও স্বীকার করেননি, তিনি মাঠে অর্জুনের শরাঘাতে মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন, তাই তিনি আড়ালে কর্ণকে ডেকে পাঠালেন যাতে তাঁকে তিনি যুদ্ধে অংশ নিতে বারণ করতে পারেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠিক এই অংশটাই তাঁর কবিতার বিষয় করলেন, যেটার মূল বিষয় হলো কর্ণের বীরত্ববোধ, যাঁর কারণে তিনি মায়ের সনির্বন্ধ অনুরোধ পর্যন্ত রাখলেন না। কেন রাখলেন না। কারণ তাঁর মাতা কুন্তী কেন তাঁকে জন্মক্ষণে ফেলে চলে গিয়েছিলেন!
অভিমান তাঁর প্রকট:
“কেন তবে আমারে ফেলিয়া দিলে দূরে অগৌরবে
কুলশীলমানহীন মাতৃনেত্রহীন
অন্ধ এ অজ্ঞাত বিশ্বে?”
কুন্তী বলছেন, তুমি আমার জ্যেষ্ঠ সন্তান, কাজেই “রাজ্য আপনার / বাহুবলে করি লহো, হে বৎস, উদ্ধার।”
উত্তরে কর্ণ বলেন, আমাকে সিংহাসনের লোভ দেখাচ্ছো মা?
“সিংহাসন! যে ফিরালো মাতৃস্নেহপাশ
তাহারে দিতেছ, মাত: রাজ্যের আশ্বাস!
একদিন যে সম্পদে করেছ বঞ্চিত
সে আর ফিরায়ে দেওয়া তব সাধ্যাতীত।
মাতা মোর, ভ্রাতা মোর, মোর রাজকুল
এক মুহূর্তেই মাত:, করেছ নির্মুল
মোর জন্মক্ষণে। সূতজননীরে ছলি
আজ যদি রাজজননীরে মাতা বলি,
কুরুপতি কাছে বদ্ধ আছি যে বন্ধনে
ছিন্ন করে ধাই যদি রাজসিংহাসনে
তবে ধিক মোরে।
কুন্তী বুঝতে পারেন সদ্যপ্রসূত শিশুকে নদীর ধারে ফেলে এসে তিনি যে পাপ করেছিলেন তারই অভিশাপে সে পুত্রকে তিনি আর নিজের কাছে ফিরে পাবেন না। বলেন:
“ . . . হায় ধর্ম, একি সুকঠোর
দণ্ড তব! সেইদিন কে জানিত, হায়,
ত্যজিলাম যে শিশুরে ক্ষুদ্র অসহায়
সে কখন বলবীর্য লভি কোথা হতে
ফিরে আসে একদিন অন্ধকার পথে,
আপনার জননীরে কোলের সন্তানে
আপন নির্মম হস্তে অস্ত্র আসি হানে!
একি অভিশাপ!”
তখন মায়ের মনের শংকার কথা বুঝতে পেরে পুত্র মা’কে অবোধ দেন এ বলে যে:
“মাত:, করিও না ভয়।
কহিলাম, পান্ডবের হইবে বিজয়।
[তারপরও]
. . . যে পক্ষের পরাজয়
সে পক্ষ ত্যাজিতে মোরে করো না আহ্বান।
শুধু এ আশীর্বাদ দিয়ে যাও মোরে,
জয়লোভে যশলোভে রাজ্যলোভে, অয়ি,
বীরের সদগতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই।”
যে পক্ষের পরাজয় সে পক্ষ ত্যাগ করার মধ্যে বাঁচার কৌশল আছে, কিন্তু বীরত্ব নেই। একজন সেনাধর্মী বীর কখনও নিজের বীরত্বের মর্যাদাবোধের সঙ্গে আপস করতে পারেন না।
রবীন্দ্রনাথের প্রায় সাড়ে তিনশ বছর আগে শেক্সপিয়ারের একটি ট্র্যাজিকধর্মী কমেডি “ট্রয়লাস অ্যান্ড ক্রেসিদা”য় এ ধরনের একটি দৃশ্য আছে যেখানে ট্রোজান বীর হেক্টর পিতা প্রায়াম, স্ত্রী আন্দ্রোম্যাকি এবং ভবিষ্যতদ্রষ্টা বোন ক্যাসেন্দ্রার সম্মিলিত অনুরোধকে শুধু বীরত্বের কারণে উপেক্ষা করতে দেখা যায়, যেমনটি কর্ণ কুন্তীর অনুরোধ রাখলেন না।
হেক্টর পরিপূর্ণ যোদ্ধার আবরণ পরে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে প্রস্তুত। তাঁর সঙ্গে গ্রীক বীর একিলেসের দ্বন্দ্বযুদ্ধ নির্ধারিত হয়েছে। কিন্তু “জুলিয়াস সিজার” নাটকে যেমন সিজারের স্ত্রী কালপুর্নিয়া রোমান সিনেট হাউজের মিটিংএ যেতে নিষেধ করেন, কারণ তিনি রাত্রিবেলায় দু:স্বপ্ন দেখেছেন যে। কিন্তু বীর সিজার তাঁর বিখ্যাত উক্তি “কাওয়ার্ডস ডাই মেনি টাইমস অ্যান্ড দ্য ভ্যালিয়েন্ট নেভার টেইস্ট অব ডেথ” (কাপুরুষেরা বারবার মরে, কিন্তু বীরেরা একবারই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে) বলে স্ত্রীকে উপেক্ষা করার অবকাশ পান, তদ্রুপ হেক্টরও আন্দ্রোম্যাকিকে প্রায় ধমকে দেন যখন আন্দ্রোম্যাকি কালপুর্নিয়ার মতো স্বামীকে বলেন যে তিনি খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন, কাজেই হেক্টর যেন যুদ্ধক্ষেত্রে না যান।
আন্দ্রোম্যাকি : “আন আর্ম, আন আর্ম, ডু নট ফাইট টুডে।” (হে পতি, আপনার সমরাস্ত্র খুলে রাখুন, আজকে যুদ্ধে যাবেন না।)
হেক্টর: তুমি আমাকে তোমাকে শাস্তি দিতে বাধ্য করছ। “গেট ইয়ু ইন / বাই অল দ্য এভারলাস্টিং গডস, আইল গো।” (দেবতাদের দোহাই দিয়ে বলছি, আমি যুদ্ধে যাবই।)
বোন ক্যাসেন্দ্রা (যাঁর বর হলো তিনি ভবিষ্যৎবাণী করতে পারবেন, কিন্তু যাঁর ওপর দেবতার অভিশাপ হলো তাঁর ভবিষ্যৎবাণী কেউ বিশ্বাস করবে না) এসে বলেন, “নো নোটস অব স্যালি, ফর দ্য হেভেনস, সুইট ব্রাদার।” (স্বর্গের দোহাই দিয়ে বলছি, আজ কোন যুদ্ধ নয়, লক্ষ্মী ভাইটি আমার।”
হেক্টর প্রত্যুত্তরে বলেন:
“হোল্ড ইয়ু স্টিল, আই সে।
মাইন অনার কিপস দ্য ওয়েদার অব মাই ফেইট।
লাইফ এভরি ম্যান হোল্ডস ডিয়ার, বাট দ্য ডিয়ার ম্যান
হোল্ডস অনার ফার মোর প্রেসাস-ডিয়ার দ্যান লাইফ।”
(চুপ কর ভগ্নী, আমি বলছি। আমার সম্মানবোধই আমার ভাগ্যকে নির্ধারণ করবে। প্রত্যেক মানুষের কাছেই তার জীবন প্রিয়, কিন্তু একজন বীরের কাছে তাঁর জীবনের চেয়ে তাঁর সম্মানটাই অনেক বড়।)
স্ত্রী এবং বোন মিলে হেক্টরকে যুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে না পেরে পিতা ট্রয়ের রাজা প্রায়ামকে ডেকে নিয়ে আসেন, এই আশা যে পিতার কথা অন্তত পুত্র শুনবে।
রাজা প্রায়াম বলেন:
“কাম হেক্টর কাম। গো ব্যাক।
দাই ওয়াইফ হাথ ড্রেম্ট, দাই মাদার হাথ হ্যাড ভিঝনস,
ক্যাসান্দ্রা ডাথ ফোরসি, অ্যান্ড আই মাইসেলফ
অ্যাম লাইক আ প্রফেট সাডেনলি এনর্যাপ্ট
টু টেল দি দ্যাট দিস ডে ইজ ওমিনাস
দেয়ারফর কাম ব্যাক।”
(হেক্টর ফিরে আসো। তোমার স্ত্রী খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। তোমার ভগ্নি ক্যাসেন্দ্রা ভবিষ্যৎ দেখতে পায়, আমি নিজেও যেন ধর্মপুরুষের মতো উজ্জীবিত হয়ে গিয়ে বলতে পারি যে, আজকের দিনটি খারাপ, কাজেই ফিরে আসো।)
এর প্রত্যুত্তরে কর্ণ যেভাবে কুন্তীর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ঠিক সেভাবে হেক্টর পিতার কাছে জানু পেতে বসে জবাব দেন:
”আই মাস্ট নট ব্রেক মাই ফেইথ।
ইয়ু নো মি ডিউটিফুল; দেয়ারফর, ডিয়ার সাইয়ার,
লেট মি নট শেইম রেসপেক্ট, বাট গিভ মি লিভ
টু টেইক দ্যাট কোর্স, বাই ইয়োর কনসেন্ট এ্যান্ড ভয়েস,
উইচ ইয়ু ডু হিয়ার ফরবিড মি, রয়্যাল প্রায়াম।”
(আমি আমার বিশ্বাস ভাঙবো না। আপনি আমাকে খুবই কর্তব্যনিষ্ঠ হিসেবে জানেন। সুতরাং, হে রাজন্য, একজন পিতার প্রতি আমি যেন কর্তব্যে অবহেলা না করি, কিন্তু আপনিই আমাকে অনুমতি দিন সেই পথটি নিতে যেটিতে সবসময় আপনার সম্মতি ও সাড়া পেয়েছি, সেই পথ থেকে আপনি আমাকে বিচ্যুত হতে বলতে পারেন না, রাজন্য প্রায়াম।) ঠিক যেমন কর্ণ কুন্তীর কাছে বলেছিলেন, শুধু প্রার্থনা কর মা, বীরের সদগতি হতে ভ্রষ্ট যেন না হই, তেমনি রবীন্দ্রনাথের আগে শেক্সপিয়ার একই কথা বলাচ্ছেন পুত্র হেক্টর দ্বারা পিতা রাজা প্রায়ামের কাছে। বলা বাহুল্য, যে তিনজনের প্রসঙ্গ এখানে এনেছি প্রত্যেকেই মায়ের, স্ত্রীর এবং পিতার বারণকে উপেক্ষা করে তথা বীরত্বের অনুপম সংজ্ঞার কাছে নিজেদেরকে সমর্পন করে যারঁ যাঁর প্রাণ হারান। কিন্তু ভারতীয় পুরাণ আর গ্রীক পুরাণের দুই মহাবীর যথাক্রমে কর্ণ ও হেক্টর এবং রোমান ইতিহাসের বীর জুলিয়াস সিজার কিন্তু মৃত্যুর সময় প্রতিজনই ঠিক প্রতিপক্ষের বীরত্বের কাছে পরাজিত হন নি, হয়েছিলেন প্রতিপক্ষের কাপুরুষতার কাছে। যেমন হেক্টরকে একিলেস বধ করার সময় হেক্টর ছিলেন নিরস্ত্র। সারাদিন যুদ্ধ করে তিনি একটু বিশ্রাম নেবার ফুরসতে সমরাস্ত্র খুলে রাখেন, আর সে সময়ে একিলিসের প্রবেশ।
হেক্টর: “আই অ্যাম আনআর্মড। ফরগো দিস ভ্যান্টেজ, গ্রিক।” (গ্রীক, দেখতেই পাচ্ছো, আমি এখন নিরস্ত্র। কাজেই যুদ্ধটা পরে হোক।)
কিন্তু একিলেস (হোমারে নয়, শেক্সপিয়ারে) এই অসম্মানজনক পথটাই বেছে নিলেন। তিনি তাঁর বশ্য মিরমিদন সেনাদেরকে বল্লেন নিরস্ত্র হেক্টরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে।
একিলেস: “স্ট্রাইক ফেলোস, স্ট্রাইক! দিস ইজ দ্য ম্যান আই সিক।” (ঝাঁপিয়ে পড়, হে বন্ধুরা, এই লোকটাকেই আমি খুঁজছিলাম। )
আর “মহাভারত”-এ কর্ণ-এর শকটের চাকা কাদায় আটকে গেলে তিনি সেটিকে উদ্ধার করার কাজে যখন ব্যস্ত ছিলেন তখন অর্জুন তাঁর শকট নিয়ে সেখানে হাজির। কর্ণকে দুরবস্থার মধ্যে দেখে অর্জুন ভাবছিলেন আক্রমণ প্রত্যাহার করবেন কিনা। কিন্তু তাঁর রথের সারথী ভগবান কৃষ্ণ তাঁকে কর্ণের পূর্বে সংঘটিত বিভিন্ন অপকর্মের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কর্ণকে বধে উৎসাহ দেন। অর্জুনের শরাঘাত কর্ণের পায়ে লাগলে তাঁর মৃত্যু হয়।
আর জুলিয়াস সিজারের হত্যাকান্ডের সময় সিনেট ভবনে তিনি তেত্রিশজন সিনেটর দ্বারা ছুরিকাঘাতে নিহত হোন। প্লুটার্কে আছে সিজার,তাঁর পঞ্চান্ন বছর বয়সেও প্রবল আত্মরক্ষা করছিলেন, কিন্তু যখন শেষ আঘাতকারী ব্রুটাস স্বয়ং, যাঁকে সিজার ছেলের মতোই ভালোবাসতেন, (একটা অপ্রতিষ্ঠিত ধারণা হলো, ব্রুটাস সিজারেরই অবৈধ সন্তান ছিলেন।) তিনি যখন এগিয়ে এলেন, সিজার তখন আত্মরক্ষা থেকে বিরত হয়ে বিখ্যাত উক্তিটি করলেন, এট্টু ব্রুটি! (তুমিও ব্রুটাস!) শেক্সপিয়ার তাঁর নাটক “জুলিয়াস সিজার”-এ প্লুটার্কের প্রতি সম্মান রেখে (শেক্সপিয়ার প্লুটার্ক পড়েছিলেন টমাস নর্থর অনুবাদে) “এট্টু ব্রুটি” শব্দগুচ্ছ রেখে দেন, দাউ টু ব্রুটাস করেননি।
বীরত্বের এই গভীর সংজ্ঞাটি যদিও উত্তরাধুনিক যুগের ব্যবসায়িক বিনিময় প্রথার কাছে ধোপে টেকে না, কিন্তু এটির আবেদন মানবকল্পনায় সবসময় শ্রদ্ধেয়।