রায়হান আহমেদ তপাদার »
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রারম্ভিককালে বিশ্বের ব্যস্ততম শহর, শিল্পনগরী, বিনোদন কেন্দ্রগুলো যখন জনশূন্য হয়ে মানবসভ্যতাকে এক অজানা শঙ্কার সতর্কবার্তা দিয়ে প্রতিমুহূর্তে আসন্ন বিপদের বাণী শোনাচ্ছিল, ঠিক সেসময়েই বেজে উঠল প্রকৃতির জয়গান। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্বজুড়ে আরোপিত লকডাউনে একদিকে মানবসমাজের অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়েছে, অপরদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশ স্বমহিমায় জেগে উঠতে শুরু করেছে। নতুন করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সজ্জিত হয়েছে পৃথিবী। এ সময় গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে বেশ কিছু চমক জাগানিয়া দৃশ্য আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সাগরে, সমুদ্রতীরে ডলফিনের মনোরম নৃত্য যেমন চোখে প্রশান্তির ঢেউ তুলেছে, তেমনিভাবে শহরের রাস্তায় বন্যপ্রাণীর স্বাধীন চলাফেরাও আমাদের আলোড়িত করেছে। এ দৃশ্য শুধু আমাদের দেশ বা কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতেরই নয়, সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এ ধরনের দৃশ্য চোখে পড়েছে। মানুষের দীর্ঘ অবসর, কর্মবিরতির ফাঁকে প্রকৃতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে নিয়েছে। এই দৃশ্যগুলো আমাদের একটি শিক্ষণীয় বার্তা দেয়। আর তা হলো, প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় আমাদের আরো বেশি সচেতন হতে হবে। এমনকি ক্রমাগত অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে বায়ুম-লে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। শিল্প-কারখানা, যানবাহন ও আধুনিক যন্ত্রপাতি থেকে নির্গত বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাস যেমনÑ কার্বন মনো-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন প্রভৃতি ওজোনস্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এসব গ্যাসের কারণে পৃথিবীর উষ্ণতাও দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার প্রভাবে পৃথিবীর মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি করছে; যা মানুষের অস্তিত্বের জন্য বিরাট হুমকি। আবার নতুন শহর তৈরি ও শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য নির্বিচারে বনাঞ্চল ধ্বংস ও বৃক্ষ নিধনও চলছে সমানতালে। পৃথিবীর ওপর এ ধরনের স্বেচ্ছাচারিতার ফলাফল অত্যন্ত ভয়াবহ।
বর্তমান পৃথিবী যেসব ভয়াবহতম বিষয় মোকাবেলা করছে, পরিবেশগত সংকট এর অন্যতম। আমরা এরই মধ্যে মানবসৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবের মধ্যেই বেঁচে আছি। এ অবস্থায় যখন জলবায়ু তৎপরতা নিয়ে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি দরকার, তার পরিবর্তে বিনাশ ও ঝুঁকি প্রত্যাখ্যান-দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে সব আলোচনা। বৈশ্বিক উষ্ণতাকে সুনির্দিষ্ট মাত্রার নিচে রাখার কথা বলা হচ্ছে। অথচ বিজ্ঞানের ভাষ্য হচ্ছে, জলবায়ুর বিষয়গুলো প্রকৃতপক্ষে একটু হেরফের হবে। আমরা যখন ভবিষ্যতে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রক্ষেপণ তৈরির চেষ্টা করি, তখন তিনটি বড় অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হই।
আর এগুলো হচ্ছে, মানুষ কী পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করবে, এর ফলে পৃথিবীর বায়ুম-লে কী পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড জমা হবে এবং এর প্রতি বায়ুম-লীয় তাপমাত্রা কী পরিমাণ সংবেদনশীল হবে।
এগুলোর মধ্যে প্রথমটি নিয়ে আমাদের সীমিত পরিমাণে আশাবাদী হওয়ার কারণ রয়েছে। গত দশকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমণ বাড়ার গতি কমাতে বিশ্ব ধীরগতিতে অগ্রসর হয়েছে। এর মধ্যে বৈশ্বিক কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন বেড়ে যাচ্ছে। গত শতাব্দীর শেষের দিকে বৈশ্বিক নির্গমণ তিন গুণ হয়ে গেলে একটা দুঃস্বপ্নের পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, যদিও পরে তা কমে আসে। কিন্তু এখন বর্তমান বাস্তবতা ও নির্গমণ কমানোর বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ব্যবধানটি ক্রমে বাড়ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুম-লে জমা হচ্ছে। অথচ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বন্ধ করতে দরকার ছিল নির্গমণ শূন্যে নামিয়ে আনা।এখন জলবায়ু সংক্রান্ত খবরাখবর আরো বেশি মিশ্র। একদিকে বায়ুম-লে কার্বন ডাই-অক্সাইড দ্বিগুণ হলে পৃথিবী কতটা উষ্ণ হবে তা নির্ণয় করতে বিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিনের লড়াইয়ে কিছু সাফল্য এসেছে। আরেক দিকে আমরা উষ্ণায়নের মাত্রাও বাতিল করে দিচ্ছি। আমরা কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরির সুযোগ দিয়ে উষ্ণায়নও কম হবে এমন আশাবাদও ব্যক্ত করি।
সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়াগুলো নিয়ে আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে। বর্তমানে আমাদের নির্গমণ করা কার্বন ডাই-অক্সাইডের অর্ধেকই সমুদ্র ও স্থলভাগের গাছপালা শুষে নিচ্ছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটাও দুর্বল হয়ে পড়বে যদি মহাসাগরগুলো উষ্ণ হয়ে ওঠে, ভূমি শুকিয়ে যায়, অগ্নিকা-গুলো আরো বেশি নিয়মিত হয়ে ওঠে।
তবে আমাদের দ্রুত অভিযোজন সক্ষমতা, পরিবেশকে বদলে দেওয়ার সক্ষমতা নির্ভর করে আমাদের প্রযুক্তি সুবিধা ও সম্পদ কতটা থাকবে তার ওপর। আমাদের এটাও স্বীকার করতে হবে যে প্রাকৃতিক বিশ্বে আমাদের অভিযোজনের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে নেই। জলবায়ু সংকট এরই মধ্যে প্রবালদ্বীপগুলোর মতো ভঙ্গুর ইকো সিস্টেমের ওপর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিশোধ চালাচ্ছে এবং তাপমাত্রা পরিবর্তন করে বেঁচে থাকতে পারে না এমন অনেক প্রজাতির বিলোপ সাধন করছে। জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রশমিত না করে বনাঞ্চল ধ্বংস, দূষণ ও অন্যান্য পরিবেশগত ক্ষতিকর তৎপরতা প্রাকৃতিক বিশ্বকে আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। এ বিষয়গুলো ঠিক করতে পারলে প্রকৃতিকে আরো প্রাণবন্ত করা যেত। এই সংকট খুব দ্রুত কিংবা সহজে মিটবে না। আর উত্তপ্ত বিতর্কও আমাদের সহযোগিতা করবে না।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ঝুঁকিগুলো যথেষ্ট গুরুতর এবং আমাদের দরকার ঝুঁকিগুলোকে প্রতিরোধ করতে জরুরি প্রয়োজনের একটা অভিন্ন বোঝাপড়া। আমাদের দেশের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র এবং প্রাকৃতিক দর্শনীয় স্থান যেমন কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত, জাফলং, সুন্দরবনে একটি সাধারণ দৃশ্য সব সময়ই চোখে পড়ে। এই স্থানগুলোতে পর্যটকদের ব্যবহৃত খাবারের প্যাকেট, পানির বোতল, বর্জ্য যত্রতত্র পড়ে থাকতে দেখা যায়। এটি কেবলমাত্র পরিবেশের জন্যই ক্ষতিকর নয়, বরং দৃষ্টিকটুও বটে এবং এ জাতীয় কর্মকা-ের ফলে বিদেশি পর্যটকদের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়। আইন করে বা এখানে ময়লা ফেলা নিষেধ জাতীয় সাইনবোর্ড লাগিয়ে এগুলো দূর করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন পর্যটকদের সচেতনতা, উন্নত মানসিকতা এবং কর্তব্যবোধ। আমরা যাতে প্রাকৃতিক নিদর্শনগুলোর পরিবেশ নষ্ট না করি, সেজন্য ব্যক্তিপর্যায়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। প্রতিনিয়ত বেড়ে চলা জনসংখ্যা এবং যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির ফলে এই স্থানগুলোতে অতিরিক্ত পর্যটকের সমাগম ঘটে; এর চাপ পড়ে স্থানগুলোর স্বাভাবিক পরিবেশের ওপর। এ ধরনের সমস্যা দূর করতে হলে একটি নির্দিষ্ট মৌসুমে নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে বেশি পর্যটক সমাগম যাতে না ঘটে, সে রকম পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। প্রকৃতিরও বিশ্রামের প্রয়োজন রয়েছে; আমরা সাম্প্রতিক সময়ে দেখেছি প্রকৃতিকে বিশ্রাম দেওয়া হলে সে নতুনরূপে আমাদের মোহিত করতে জানে।
তাই বছরের কিছু নির্দিষ্ট সময়ে প্রাকৃতিক নিদর্শন গুলোকে বিশ্রামের সুযোগ করে দিতে হবে। এ সময়ে সেখানে যাতে জনসমাগম না ঘটে এবং স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘিœত না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। পরিবেশ এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। পরিবেশের ওপর অত্যধিক নির্যাতন চালালে, তা আমাদেরই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
লেখক : কলামিস্ট