মো. মহসীন »
কাচারি ঘর দেশের অনেক পুরনো ঐতিহ্যকে লালন করে গ্রাম বাংলার রূপকে ঐশ্বর্যম-িত করে রেখেছে। এই কাচারি বা দেউড়ি গ্রামবাংলার প্রতিটি বাড়ির আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ। কালের পরিক্রমায় আজকাল পল্লীতে এই কাচারি বা দেউড়ি তেমন আর দৃষ্টিগোচর হয় না।
এই কাচারি ঘরের অবস্থান ছিলো বাড়ির বাহিরের আঙ্গিনায়। তবে এই কাচারি ঘরের অভ্যন্তরীণ অবয়ব বিশেষভাবে ঐতিহ্যগত প্রথায় সাজিয়ে রাখা হতো। এই কাচারি ঘর ছিলো পুরো বাড়ির এক আড্ডা ও মিলন মেলার চমৎকার একটা স্থান, যেখানে সন্ধ্যার পর প্রায় সময় বাড়ি বা পাড়ার লোকজন বসে বসে মুখরোচক গল্পগুজবে সময় কাটাতো।
আবার সময় সময় বাড়ির বৃদ্ধ লোকজনদের সেখানে বসে বিড়ি হুকা টানতে দেখা যেতো। কোন কোন সময় বাড়িতে মেহমান এলে তারা এই কাচারিতে রাত্রি যাপন করতো। গ্রামাঞ্চলে বাড়ির ছেলেমেয়েরা সেই কাচারি ঘরে তাদের জায়গীর শিক্ষকের কাছে পড়াশোনা চালিয়ে যেতো। যে কোন মাঝারি শ্রেণির পরিবারগুলো কাচারি ঘরেই জায়গীর শিক্ষকদের থাকার ব্যবস্থা করে দিতো। সেই সময়ে প্রতি গৃহস্থ বাড়ির একমাত্র আভিজাত্যের প্রতীকই ছিল বাড়ির বাহিরে অবস্থিত আঙিনায় এই বাংলো ঘর। যা শহরেও সেই সময় অনেক অভিজাত শ্রেণির বাড়ির মধ্যে বাংলো ঘর হিসেবে সমধিক পরিচিত ছিলো। সেই বাংলো ঘরের চৌকির ওপর থাকতো বাড়ির অবিবাহিত ছেলে বা ছাত্ররা।
তাছাড়া গ্রামের বাড়িস্থ কাচারিগুলোতে যে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানও সম্পন্ন করা হতো। গ্রামের মোড়ললা সালিশ বিচার সংশ্লিষ্ট কর্মকা-গুলো এই কাচারি ঘরে বসে সমাধা করতো।
সময় সময় কাচারিতে গানবাজনার মুগ্ধকর আয়োজন চলতো। তখন পরিবারের সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থাও এই কাচারি ঘরে করা হতো। আজ কালতো শহরে বা অধিকাংশ গ্রামে বাড়ির ড্রইং রুমের বিবিধ সাজসজ্জার মাধ্যমে পরিবারের আভিজাত্যপূর্ণ অবয়ব ফুটে উঠে আর এই ড্রইং রুম কাচারি ঘরের আধুনিক বিকল্প হিসেবে বর্তমান সমাজে অধিক সমাদৃত হচ্ছে।
বিশেষ করে এই কাচারি ঘরের অতীত ঐতিহ্যই ছিলো আলাদা প্রকৃতির, যে ক্ষেত্রে কাচারি ঘর একটা সাময়িক বিশ্রামাগারের ভূমিকা রাখতো। অনেক সময় রাতে কাচারি ঘরওয়ালা বাড়িতে আসত অনাত্মীয়-অচেনা কোনো মুসাফির।
গ্রামাঞ্চলের লোকজন কোসনময় রাত-বিরেতে নদী পারাপারের জন্য বিলম্ব হলে তারা তখন পুরা রাত গ্রামের যে কোন কাচারিতে মুসাফির হিসাবে কাটিয়ে দিতো এবং পরের দিন তাদের গন্তব্যের উদ্দেশে রওয়ানা দিতো।
কাচারি ঘরে অবস্থানকালে মুসাফিরদের আপ্যায়নের ক্ষেত্রে কোন ত্রুটিই ছিলো না। এমন কি গ্রামের লোকজন চলাচলকালে, অতি ঝড়ঝাপটার মধ্যে পড়লে, তাৎক্ষণিক তারা কাছাকাছি কোন কাচারিতে গিয়ে আশ্রয় নিতো।
প্রকৃত অর্থে বলা যায়, সে সময় মানুষের মানবিক আচরণ ও মনুষ্যত্বের দিক থেকে অনেক অগ্রগামী ছিলো। কালের পরিক্রমায় আজ এই কাচারি ঘরগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে, আর সেই স্থানে জায়গা করে নিচ্ছে আধুনিক যুগের বিশেষ সাজের ড্রইং রুমগুলো।
লেখক : প্রাবন্ধিক