এস ডি সুব্রত
বিপ্লবী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখনি গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল তাঁর সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির অভিজ্ঞতা থেকে। চারপাশের মানুষকে নিয়ে সুকান্তের যে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি ছিল, তাই তিনি ঢেলে দিয়েছেন কলমে ও কাগজে। তাঁর অনুভূতি এতই প্রখর ছিল যে, তা প্রকাশ করতে গিয়ে কলম হয়ে উঠতো তীক্ষè হাতয়ার। ‘ছাড়পত্র’ কাব্যগ্রন্থের ‘হে মহাজীবন’ কবিতাটিতে সুকান্ত ভট্টাচার্য পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটির সাথে তুলনা করেছেন, এ যেন আপামর জনতার ক্ষুধারই আক্ষরিক রূপ। বাংলা কবিতায় বৈপ্লবিক ভাবধারা যাঁদের রচনায় প্রতিভাত হয়েছে, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁদের মধ্যে অন্যতম নিঃসন্দেহে। মানুষের মর্যাদার জন্য মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় লক্ষণীয়। তাঁর কবিতা মানুষকে সাহসী হতে উদ্দীপ্ত করে। তাঁর কবিতার ভাষা বলিষ্ঠ ও নিখুঁত। তাঁর বয়সের তুলনায় তাঁর রচনা ছিল বিস্ময়করভাবে পরিণত। সুকান্তের কবিতা সবধরনের বাধা-বিপত্তিকে জয় করতে শেখায়। তাঁর সাম্যবাদী রচনা মানুষকে নতুন জীবনের সন্ধান দেয়। যাপিত জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণাকে মোকাবিলা করার দুরন্ত সাহস পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়। উচ্চতর মানবিক চেতনায় উজ্জীবিত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য পার্টি বা সংগঠনের কাজে অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে সেকালের দুরারোগ্য যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪৭ সালে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
সুকান্ত ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট কলকাতার ৪৩ মহিম হালদার স্ট্রিটের মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা নিবারণ ভট্টাচার্য কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে বইয়ের ব্যবসা করতেন এবং মা সুনীতি দেবী ছিলেন গৃহিণী। তাঁদের পৈতৃক নিবাস ছিল তৎকালীন ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানার উনশিয়া গ্রামে। কবির জন্মের পূর্বেই তাঁর পূর্বপুরুষেরা এদেশ থেকে ভারতে চলে যান। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সুকান্তের ভ্রাতুষ্পুত্র। রানি দিদির উৎসাহে লেখালেখিতে সুকান্তের হাতেখড়ি। সাধারণমানের ছাত্র ছিলেন তিনি। লেখাপড়ায় খুব একটা আগ্রহ দেখাতেন না। তদুপরি ভারতীয়দের ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কারণে লেখাপড়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল তাঁর। এ সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মকা-ে যুক্ত হওয়ায় ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।
কৈশোর থেকেই সুকান্ত যুক্ত হয়েছিলেন সাম্যবাদী রাজনীতির সঙ্গে। শোষণমুক্ত স্বাধীন সমাজের স্বপ্ন, শোষিত মানুষের কর্মজীবন এবং সুন্দর ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্য সংগ্রাম তাঁর কবিতার মূল প্রেরণা ।
সুকান্ত ভট্টাচার্য ওই বয়সেই লিখেছিলেন কবিতা ছাড়াও গান গল্প নাটক এবং প্রবন্ধ। তাঁর ‘ছন্দ ও আবৃত্তি’ প্রবন্ধটি পাঠে বেশ বোঝা যায়, ওই বয়সেই তিনি বাংলা ছন্দের প্রায়োগিক দিকটি কতটা আয়ত্তে এনেছিলেন। ১৯৪৫ সালে সুকান্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীনতার ‘কিশোরসভা’ বিভাগ সম্পাদনা করতেন।
মাত্র আট ন-বছর বয়স থেকেই সুকান্ত লিখতে শুরু করেন। স্কুলের হাতেলেখা পত্রিকা ‘সঞ্চয়ে’ একটি ছোট্ট হাসির গল্প লিখে আত্মপ্রকাশ করেন। তার দিনকতক পরে বিজন গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিখা’ কাগজে প্রথম ছাপার মুখ দেখে তাঁর লেখা স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী। মাত্র এগার বছর বয়সে ‘রাখাল ছেলে’ নামে একটি গীতিনাট্য রচনা করেন। এটি পরে তাঁর ‘হরতাল’ বইতে সংকলিত হয়। সুকান্ত ভট্টাচার্য ভাল অভিনয় করতেন। পাঠশালায় পড়বার কালেই ‘ধ্রুব’ নাটিকার নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাল্যবন্ধু লেখক অরুণাচল বসুর সঙ্গে মিলে হাতেলেখা কাগজ ‘সপ্তমিকা’ সম্পাদনা করেন।
সুকান্তকে বলা হয় গণমানুষের কবি। সর্বহারা মানুষের সুখ-দুঃখ তাঁর কবিতার প্রধান বিষয়। যাবতীয় শোষণ-বঞ্চনার বিপক্ষে সুকান্তের ছিল দৃঢ় অবস্থান। তিনি কবিতার মাধ্যমে দূর করতে চেয়েছেন শ্রেণিবৈষম্য। মানবতার জয়ের জন্য তিনি লড়াকু ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। অসুস্থতা ও অর্থাভাব তাঁকে কখনো দমিয়ে রাখতে পারেনি ।
মানবিকচেতনায় উদ্বুদ্ধ কবি বাংলা কাব্যধারার প্রচলিত প্রেক্ষাপট আমূল বদলে দিতে পেরেছিলেন। বয়সের তুলনায় তাঁর কবিতার সংখ্যা অবিশ্বাস্য। তাঁর রচনাবলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো : ছাড়[পত্র (১৯৪৭), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫)।
পরবর্তীকালে উভয় বাংলা থেকে ‘সুকান্তসমগ্র’ নামে তাঁর রচনাবলি প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, জীবনানন্দ দাশসহ সে সময়ের বড় বড় কবির ভিড়ে তিনি হারিয়ে যাননি। যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন নিজ প্রতিভা ও মেধার।
জীবনের প্রতিটি অংশেই সুকান্ত যেন অনিয়মকে নিয়ম করে নিয়েছিলেন। একদিকে পার্টির কাজ, অন্যদিকে কলমযুদ্ধ, অভাব-অনটন। সব মিলিয়ে অনিয়মের স্রোত তার রুগ্ন শরীর মেনে নিতে পারেনি। যক্ষ্মারোগ বাসা বাঁধে এই অনিয়মের ফাঁকে। বিপ্লব ও স্বাধীনতার আপোষহীন সংগ্রামী কবি শরীরের ওপর যে অত্যাচারটুকু করলেন তাতে তাঁর শরীরে প্রথমে ম্যালেরিয়া ও পরে দুরারোগ্য যক্ষ্মারোগ বাসা বাঁধে। আর সে রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৩ মে মাত্র ২১ বছর বয়সে কলকাতার রেডএড কিওর হোমে মৃত্যুবরণ করেন।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের জীবন মাত্র ২১ বছরের আর লেখালেখি করেন মাত্র ৬/৭ বছর। সামান্য এই সময়ে নিজেকে মানুষের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন তিনি। সুকান্ত ভট্টাচার্য কানে একটু কম শুনতেন ঠিকই, কিন্তু সর্বহারার আর্তচিৎকার শুনতে একদম ভুল করেননি। সুকান্তের কবিতার সহজ ও সরল বাণী অনেককে আশ্চর্য ও মুগ্ধ করেছে। তবে সেই সরলতার সমগ্র তাৎপর্য সকলে অনুভব করতে পারেননি।