রাজিব শর্মা »
বছরের শুরুতেই সরকারি ছাপানো পাঠ্য বইয়ের একটু ‘সংকট’ থাকে। এবছরও জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে এসে নগর ও জেলা পর্যায়ের বিদ্যালয়ে পাঠ্যবইয়ের একটু ‘সংকট’ রয়েছে। স্কুল পর্যায়ে বই পৌঁছাতে কয়েকদিন দেরি হওয়ার কারণ হিসেবে প্রেসকে দায়ী করছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
এদিকে নগরীর বিভিন্ন লাইব্রেরিতে টাকা দিলেই মিলছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শাখার এসব পাঠ্যবই। আর শিক্ষা প্রতিযোগিতায় যাতে সন্তানরা পিছিয়ে না পড়ে তার জন্য লাইব্রেরি থেকে চড়া দামে এসব বই কিনছেন অভিভাবকরা।
সরেজমিন নগরীর আন্দরকিল্লা, চকবাজারসহ নগরীর প্রায় লাইব্রেরিতে দেখা যায়, বিক্রয়ের জন্য নিষিদ্ধ জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তক ছাপানো বই অর্থ দিলে পাওয়া যাচ্ছে। শ্রেণি ও বিষয়ভেদে প্রতিটা বই বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বইও সেট প্রতি ৪০০ থেকে ১ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে।
আন্দরকিল্লা, চকবাজার ও জিইসি মোড়ের বিভিন্ন লাইব্রেরিতে আসা অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবছরের শুরুতেই নতুন বই বের হলেও স্কুলে সংকট থাকে। এবছরও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে এসব বই কিনছেন তারা।
পটিয়া থেকে আন্দরকিল্লা বই বাজারে বই কিনতে আসা মো. মাসুদ বলেন, বিদ্যালয়ে সব বই পাওয়া যায়নি। তাই লাইব্রেরিতে আসতে হলো। প্রতিটা বইয়ের মূল্য রাখছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। আমি অষ্টম শ্রেণির দুটো বই কিনি ৪২০ টাকা দিয়ে।
কাপাসগোলা থেকে চকবাজারে বই কিনতে আসেন ফরিদুল আলম। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা পাঠ্যপুস্তকের দাম হাঁকাচ্ছে চড়া। যে বই ৫০ থেকে ৬০ টাকায় পাওয়া যেত তা এখন ২০০ থেকে ২৭০ টাকা বলছেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে আন্দরকিল্লার একাধিক লাইব্রেরিতে বই বিক্রেতাদের কাছে নতুন বছরের এনসিটিবি পাঠ্যপুস্তক বই আছে কি না জানতে চাইলে তারা প্রথমে অস্বীকার করেন। পরে তারা ক্রেতার উপস্থিতি, কেনার আগ্রহ এবং গতিবিধি দেখে গোপনে বই বিক্রির কথা জানান।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আন্দরকিল্লার শাহী জামে মসজিদ এলাকা, জিএ ভবন, জেনারেল হাসপাতালের সামনে ও তার আশেপাশের এলাকা, চকবাজারের গুলজার মোড় এলাকা, স্টেশন রোডের নূপুর মার্কেট এলাকা, জিইসি মোড় সেন্ট্রাল প্লাজা এলাকা, নাসিরাবাদ গার্লস কলেজের মোড় এলাকাসহ নগরীর আনাচে-কানাচে লাইব্রেরিগুলোতে বিক্রি নিষিদ্ধ সরকারি এনসিটিবি কর্তৃক ছাপানো বিনামূল্যের বই গোপনে বিক্রি করতে দেখা গেছে।
জানতে চাইলে আন্দরকিল্লার এক লাইব্রেরির ম্যানেজার আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমরা যে এনসিটিবির বই বিক্রি করছি, তা এবছরের নয়। এ বছরের নতুন বই এখনো আমাদের হাতে আসেনি। এখন যা বিক্রি করছি তা গতবছরের পুরোনো বই।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাহী জামে মসজিদ মার্কেটের আরেক বই বিক্রেতা বলেন, ‘ক্রেতাবিমুখ না করতে এবং সকল বই বিক্রির জন্য, আমাদের কয়েকটা এনসিটিবি’র বই রাখতে হয়। না হয় একটা বইয়ের জন্য অন্যান্য ক্রেতারা আসেন না।
চকবাজার গুলজার মোড় এলাকার বই ব্যবসায়ী মো. ইয়াসিন বলেন, ‘স্কুলে সব বই দেওয়া হয় না, অনেকসময় প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অনেক অভিভাবক গাইড বই কিনতে আসেন কিন্তু তাদের দু’একটি পাঠ্যপুস্তকের সংকট থাকে। তাছাড়া অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ কেনার সময় তারা পাঠ্যপুস্তক কেনেন। এসব বই সরকারি ও নিষিদ্ধ আমরা জানি। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার কথা ভেবে বইগুলো বিক্রি করছি।
জিইসি মোড়ের সেন্ট্রাল প্লাজা এলাকার একটি লাইব্রেরিতে জানতে চাইলে এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘স্কুলে বই দেরিতে আসলে অভিভাবকরা দুয়েকটি এনসিটিবির পাঠ্যপুস্তক কিনতে চায়। লাইব্রেরির মাধ্যমে সহজেই নামমাত্র দামে বই পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা।’
নাসিরাবাদ মহিলা কলেজের সামনে একটি লাইব্রেরি থেকে এনসিটিবি বই কিনে ফেরার পথে এক অভিভাবকের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘লাইব্রেরিতে সহজে পাঠ্যপুস্তক বিক্রির বিষয়টি স্বীকার করবে না। আপনার সঙ্গে নানা কথা বলবে, ব্যস্ততা দেখিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখে আপনার বই কেনার আগ্রহ ও ও গতিবিধি লক্ষ্য করবে, তারপর গাইড বই ও অনান্য শিক্ষা উপকরণ কেনার ফাঁকে পাঠ্যপুস্তক বিক্রির কথা প্রকাশ করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্কুলে কখন বই দেবে, তা বলা যায় না। হয়তো কিছুদিন পর দেখা যাবে পরীক্ষার সময় চলে এসেছে। কাজেই পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কায় বাধ্য হয়ে বই কিনতে হচ্ছে।’
পাঠ্যপুস্তক বাজারে পাওয়ার বিষয়ে জানতে রোববার বিকালে চট্টগ্রাম বিভাগীয় শিক্ষা অফিসার (প্রাথমিক) উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালক বরাবর একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে প্রতিষ্ঠানটির কেউ ফোন রিসিভি করেননি।
এরপর জেলা শিক্ষা অফিসার উত্তম খীসা’র সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতিটা স্কুলে এখনো সব বিষয়ের বই আসেনি। বইয়ের সংকট হবে না। তবে পরিবহনের কারণে জেলা পর্যায়ে দুয়েকটি বই আসেনি।’
এদিকে বিনামূল্যে বিতরণের এসব পাঠ্যবই বাজারে বিক্রির বিষয়টি উঠে এসেছে খোদ এনসিটিবির তদন্তেও। এ ব্যাপারে তারা দায়ী করছেন অসাধু প্রেস ব্যবসায়ী, শিক্ষা প্রশাসনের অফিসে জড়িত পিয়ন ও কর্মকর্তাদের। খোলা বাজারে বই বিক্রি বন্ধে এনসিটিবির মনিটরিং টিম কাজ করছে বলে জানান এ সংস্থার সংশ্লিষ্টরা।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘চলতি বছর বইয়ের কোন সংকট নেই। আমাদের তিনটি বিষয়ের বই ছাপানোর কাজে একটু দেরি হয়েছে। ১৭ ডিসেম্বর তিনটি বিষয় ছাপানোর জন্য আমরা প্রেসে অর্ডার করি। শনিবার আমাদের একটি প্রেস বই বুঝিয়ে দিয়েছে। আর বাকি দুটি বিষয়ের বই এখনো বুঝিয়ে দিতে পারেনি।’
বাজারে পাঠ্যপুস্তক পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা বাজারে সরকারি পাঠ্যপুস্তক বিক্রি হওয়ার বিষয়ে অবগত রয়েছি। যেখানে বিনামূল্যে সরকার বই দিচ্ছে, সেই বই কেনা থেকে অভিভাবকদের বের হয়ে আসতে হবে। আমরাও এ ব্যাপারে তদন্ত করছি।’
বিনামূল্যের সরকারি বই মিলছে লাইব্রেরিতে!
ছাপানোয় দেরি হওয়ায় তিনটিবিষয়ের বই পৌঁছাতে বিলম্ব হচ্ছে : এনসিটিবি চেয়ারম্যান