ডেস্ক রিপোর্ট »
পর্যটন মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। অথচ যেতে পারছেন না ভ্রমণপিয়াসী মানুষ নয়নাভিরাম সেন্ট মার্টিন দ্বীপে। নানা বিধিনিষেধে এবার মৌসুম শুরু হয়ে গেলেও যেতে পারছেন না কেউ।
দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে সরকারের তরফে যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তাতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, দিনে গিয়ে দিনে ফিরে এসে সৌন্দর্য উপভোগ সম্ভব কি না। এতে ধস নামতে পারে পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসায়। কর্মহীন হওয়ার শংকায় উদ্বিগ্ন দ্বীপবাসী।
সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে দৈনিক দুই হাজার করে পর্যটক সেন্টমার্টিন যেতে পারবেন যার প্রতিবাদে নিয়মিত বিক্ষোভ আন্দোলন ও মানববন্ধন কর্মসূচি চলছে সেন্টমার্টিনে।
বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমার সীমান্তের কাছে সাগরের বুকে ৮ দশমিক ৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন। কক্সবাজার জেলা শহর থেকে এর দূরত্ব ১২০ কিলোমিটার।
বিস্তৃত জলরাশি আর মোহনীয় সৌন্দর্য্যের জন্য এই দ্বীপটিতে পর্যটকরা বেড়াতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি এই দ্বীপের জীববৈচিত্র্য ও প্রাণ-প্রতিবেশের সুরক্ষায় সেখানে পর্যটক সীমিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পর্যটক যে এলাকাগুলোয় ভ্রমণ করে সেন্ট মার্টিন সেগুলোর একটি। ভরা মৌসুমে দিনে গড়ে পাঁচ থেকে আট হাজার পর্যটক এই দ্বীপ বেড়াতে যান।
বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে পর্যটন মৌসুম নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। তবে উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতি বছর কেবল নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত দ্বীপটিতে ভ্রমণ করা যাবে। ফেব্রুয়ারিতে ভ্রমণ নিষেধ থাকবে।
এর মধ্যে নভেম্বরে দিনে গিয়ে দিনে চলে আসতে হবে, রাত কাটানো যাবে না। বাকি দুই মাস রাত্রি যাপনে বাধা নেই, তবে দিনে দুই হাজারের বেশি পর্যটক যাওয়া যাবে না।
সরকারের এমন সিদ্ধান্তের পরপর পর্যটন ব্যবসায় জড়িত ও ভ্রমণ পিপাসুরা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
তারা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে দ্বীপটির বাসিন্দারা যেমন কর্মহীন হবেন, তেমনি সেখানে পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসায়ও ধস নামতে পারে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে ঘিরে সরকারের নানা সিদ্ধান্তের পর ছড়িয়েছে নানা গুজব। পর্যটন ব্যবসায়ী এবং দ্বীপের স্থানীয়রা বলছেন, সেন্টমার্টিন ভ্রমণে এমন কড়াকড়ি কখনোই ছিল না যেটি গুজব সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি করেছে। পর্যটন শুরু করা নিয়ে একটা অনিশ্চয়তাও কাজ করছে সবার মধ্যে।
এবার নভেম্বর চলে এলেও এখনও ভ্রমণ শুরুই হয়নি। তিনটি জাহাজ চলাচলের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে প্রশাসনের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী নভেম্বর মাসে সেন্টমার্টিন ভ্রমণে বাধা থাকার কথা নয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেখানে বেড়াতে যাওয়া যাচ্ছে না। স্থানীয় বাসিন্দাদেরকেও জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে নিজ এলাকায় প্রবেশ করতে হচ্ছে।
এবার নভেম্বর চলে এলেও এখনও ভ্রমণ শুরুই হয়নি। তিনটি জাহাজ চলাচলের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে প্রশাসনের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে।
যাতায়াতের জন্য এখনো সেন্টমার্টিন রূটে পর্যটকবাহী একটিও জাহাজ চলাচল শুরু হয়নি। স্পিডবোট চলাচলও বন্ধ। যাত্রীবাহী ট্রলার বা সার্ভিস বোট চলাচল করলেও ভ্রমণ করতে লিখিত অনুমতি লাগছে। সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা ছাড়া কাউকে ভ্রমণ করতে দেয়া হচ্ছে না। দ্বীপের অধিবাসী কিনা নিশ্চিত করতে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে ট্রলারের টিকেট বিক্রি হচ্ছে। দফায় দফায় কোস্টগার্ড যাত্রীদের এনআইডি যাচাই করছে।
গত ২২ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর সরকারের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেন। এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, “নভেম্বর মাসে পর্যটকরা যেতে পারবেন, কিন্তু রাতে থাকতে পারবেন না। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে ২ হাজার পর্যটক প্রতিদিন যেতে পারবেন, রাতেও থাকতে পারবেন।
“আর ফেব্রুয়ারিতে কোনো পর্যটক সেন্ট মার্টিনে যেতে পারবেন না, তখন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হবে।”
সেই দুই হাজার পর্যটককে কীভাবে নির্বাচন করা হবে, সেটি এখনও প্রকাশ করা হয়নি।
এমন সিদ্ধান্তের কারণ ব্যাখ্যা করে পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজাওয়ানা হাসান বলেন, “বলা হচ্ছে যে ৪১ ভাগ কোরাল ক্ষয় হয়ে গেছে। এটা জাতীয় পরিসংখ্যান। আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্য জার্নালে বলা হচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে ২০৪৫ সালের মধ্যে সকল কোরাল ক্ষয় হয়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপটা ডুবে যাবে। তখন পর্যটনটা থাকবে কোথায়? আজকে যার বয়স এক, ২০৪৫ সালে আপনি তাকে সেন্ট মার্টিনটা কোথা থেকে দেখাবেন?”
“যে প্রবাল সেন্টমার্টিন থেকে ক্ষয় হয়ে গেছে। প্রবাল আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব যদি আমরা সেখানকার কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করি। পুরো প্রবাল ক্ষয় হলে সেন্টমার্টিন ডুবে যাবে। তখন স্থানীয়রা কী করবে?”, বলেন তিনি।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) এবং পরিবেশ অধিদপ্তর আয়োজিত ‘সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সম্ভাবনা: একটি প্লাস্টিকমুক্ত স্বর্গের সূচনা’ শীর্ষক ওয়েবিনারে সৈয়দা রিজওয়ানা বলেন, “সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে একটি টেকসই পর্যটনের মডেল ও পরিবেশ সংরক্ষণের আদর্শ স্থানে রূপান্তর করতে পারি। এই প্রচেষ্টা সফল করতে সকল ক্ষেত্রের সহযোগিতা এবং পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন।”