আলম তৌহিদ »
ঝাউগাছের শাখায়-শাখায় নিঃশব্দে নেমেছে সন্ধ্যা। বাতাসের মায়াবী দোলায় দোল খেতে-খেতে ঝাউয়ের চিরল পাতারা তাকিয়ে আছে আকাশের গোধুলির লালে। সমস্ত দিনের ক্লান্তি ছড়িয়ে জলের বুকে ডুবে যাচ্ছে ম্লান সূর্য। এই দৃশ্য প্রতিদিনের। এখন পর্যটন মওসুম নয় বলে কক্সবাজার সৈকতে টুরিস্টদের উপচে পড়া ভিড় নেই। তবু দূরে দেখা যায় আবছা অন্ধকারে ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুয়েকজন মানুষ। তাদেরকে দৃষ্টি সীমানার বাইরে রেখে নাতিউশার মনে হলো বিস্তৃর্ণ বেলাভূমিতে সে দাঁড়িয়ে আছে একা।
নাতিউশা মিশে আছে সঘন অন্ধকারে। কেন জানি সন্ধ্যার অন্ধকার তাকে টেনে আনে সমুদ্রের তীরে। সে নিবিষ্ট হয়ে শুনে যেতে থাকে ঢেউয়ে-ঢেউয়ে শত-শতাব্দীর ক্রন্দন। এ তো জলের কান্না নয়, তারই অন্তরাত্মার অব্যক্ত আবেগ। নাতিউশার বাদামি চোখ ভিজে আসে। লালাভ চিবুক বেয়ে নেমে আসে জলের ক্ষীণধারা। চোখের জলের নোনাস্বাদে অভ্যস্ত হয়ে বুঝেছে, সমুদ্রজলের সাথে এর তেমন বৈসাদৃশ্য নেই। সে গভীর সমুদ্রের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে ভাবে, এসপারভ হয়তো বেঁচে আছে! একদিন বঙ্গোপসাগর এসপারভকে ফিরিয়ে দেবে- এরূপ একটি প্রত্যাশা বর্ষার মেঘের মতো তার ভেতরে বেড়ে উঠতে থাকে।
অন্ধকার গাঢ় কালো চাদরের মতো প্রসারিত হয়ে আছে দিগন্ত অবধি। তখন আকাশজুড়ে চলছে তারাবাজি উৎসব। এরই মাঝে শুক্লপক্ষের চাঁদ রুপালি টিপের মতো জ্বলজ্বল করছে। কালোজলের ওপরে জোছনা তার রুপালি মুদ্রায় বসিয়েছে ধ্রুপদি নাচের আসর। নাতিউশা জলের সম্মোহনে হঠাৎ ডেকে উঠলো- এসপারভ! এসপারভ!
বিদেশিনীর এই ক্ষীণ ডাক ঢেউয়ের তীব্রনিনাদে একাকার হয়ে যামিনীর নিস্তব্ধতা ভেঙে উড়িয়ে নিল দূরে। স্থির ছায়ামূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নাতিউশার মনে হলো তার হৃদয়টি যেন টুকরো-টুকরো হয়ে ওড়ে গেল দিগন্তের পানে। রাত্রির মাদকতা ছড়ানো বাতাসে সিল্কের মতো সোনালি চুল বারবার জড়িয়ে যাচ্ছিল তার চিবুকে। সেদিকে মনোযোগ নেই তার। কেনই বা থাকবে। বিরহের চাদরে ঢাকা এই ক্ষিণাঙ্গিনী স্বপ্নভঙ্গের যাতনায় পার করছে সময়ের এফোঁড়-ওফোঁড়।
নাতিউশা রাশান মেয়ে। ভালোবাসতো সদ্যপাস করা ইলেক্ট্রিকেল ইঞ্জিনিয়ার এসপারভকে। তখন এসপারভ হন্য হয়ে চাকরি খুঁজছে। হঠাৎ পেয়েও গেল। পোস্টিং পেল বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কাজে। ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্প। তাই মাইনে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। দু’বছর পূর্বে সে সুদূর রাশিয়া থেকে ওড়ে এলো বাংলাদেশে। তারপর থেকে নাতিউশা একা। ঝরেপড়া বিবর্ণ সেঞ্চুরি পাতার ওপর দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে তার প্রতিটি বিকেল প্রিয়তমকে না-দেখার বেদনায় বাদামি হয়ে ওঠে। কখনো সে একা বসে থাকে আলেকজান্ডার গার্ডেনের সবুজ ঘাসের ওপর। পাতাহীন বৃক্ষগুলোকে তার মনে হয় না জীবন্ত। মনে হলো প্রকৃতির ক্যানভাসে কোনো শিল্পীর পেনসিল স্কেচ। বৃক্ষেরা যেন ধূসর চোখে দেখছে নাতিউশাকে। ওদের জীবনে সবুজ নেই। শুধু সবুজ কেন পৃথিবীর সমস্ত রঙ থেকে ওরা রয়েছে যোজন-যোজন দূরত্বে। বৃক্ষের কষ্টে নাতিউশার কষ্ট আরো বেড়ে ওঠে। সে বুঝে গেছে না দেখার নামই দূরত্ব। সেই দূরত্বের কোনো সীমারেখা নেই। তাই অসীম শূন্যতার মাঝে গন্তব্য স্থির করতে গেলে দিগবিভ্রম হয়। এতে আরো বাড়ে মনের যাতনা। এরূপ যাতনার মধ্যে দিন কাটে তার। অবসরে সে গুগল ম্যাপে তালাশ করে দেখে নেয় রাশিয়া থেকে বাংলাদেশের দূরত্ব। রাশিয়ার তুলনায় খুবই ছোট্ট একটি দেশ। নাতিউশার মনটা ছটফট করে ওঠে। ইচ্ছে হয় এখনই ওড়ে যাবে এসপারভের কাছে। নাতিউশা মনকে শক্ত করে। তবু একটি ভয় বারবার ফিরে আসে তার মনে। সে ভয় কোনো অনাগত দুর্ঘটনার। এসপারভ বলেছিল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে তাকে ইউরোনিয়াম নিয়ে কাজ করতে হবে। ইউরোনিয়ামকে তারা বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তর করবে। নাতিউশা জানে কাজটি অবশ্যই ঝুঁকিবহুল।
তার মনে পড়ে আজ থেকে বহু বছর আগে ঘটে যাওয়া চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুর্ঘটনার কথা। কী ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছিল চেরনোবিলে! দশদিন ধরে জ্বলেছিল আগুন। বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল হিরোশিমার চেয়েও বেশি তেজস্ক্রিয়তা। এখনো পর্যন্ত চেরনোবিলের পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে কেউ বাস করে না। নতিউশা আর ভাবতে পারে না। সহসা আর্দ্র হয়ে ওঠে তার চোখ।
গেল বছর রাশিয়ায় তীব্র শীত পড়েছিল। ভারী তুষার ঝড়ে জনজীবন প্রায় অচল। ব্লিজার্ডের দিনে নাতিউশা একপ্রকার ঘরে বন্দি। সামান্য দূরত্ব থেকেও নিজের ঘরটি দৃষ্টিগোচর হয় না। চারদিকে কেবল বরফকুচির ওড়াউড়ি ছাড়া আর কিছু নজরে আসে না। নাতিউশাদের ঘরের চাল, বাগান চাপা পড়ে আছে বরফস্তূপের নিচে। রাস্তায় বরফ জমে চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে আছে। পরিচ্ছন্নকর্মীরা যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রাস্তার বরফ সরাতে। এ যেন প্রকৃতির সাথে মানুষের যুদ্ধ। এ সময়ে অনেক রাশান দুর্যোগ থেকে রেহাই পেতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণে যায়। নাতিউশার মা-বাবাও দিনকয়েক আগে দুবাই গেছে বেড়াতে। নাতিউশা যায়নি। ট্যুরে যেতে সে কিছুতেই মনের সায় পাচ্ছিল না। ব্লিজার্ডের এমন দিনে হঠাৎ নাতিউশা এসপারভের ফোন পেল। এসপারভ বলল, চলে এসো নাতিউশা। তোমাকে নিয়ে কক্সবাজার ট্যুরে যাব। অফিসে বলে রেখেছি, কয়েকদিনের ছুটি পাওয়া যাবে। এসপারভের ফোন পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো নাতিউশা। বুঝতে পারল, তার মন থেকে গলতে শুরু করেছে দীর্ঘবিরহের বরফ। ইচ্ছে হলো অ্যালব্যাট্রস পাখির মতো ওড়ে যেতে। কিন্তু সে তো বিহঙ্গ নয়। তাই পরদিন ঢাকার ফ্লাইট ধরল।
কক্সবাজারে কয়েকদিনের অবকাশে নাতিউশা ও এসপারভ নিজেদের নতুনভাবে আবিষ্কার করল। পাহাড় ও সমুদ্রের চিরকালের মিতালি তাদের মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু নাতিউশা বুঝে উঠতে পারেনি তার সেই মুগ্ধতা বালির বাঁধের চেয়েও ক্ষণস্থায়ী হবে। এসপারভ ছাত্রজীবনেই ছিল দুরন্ত। এখনো মোটেও কাটেনি তার দুরন্তপনা। ইচ্ছে ছিল নাবিক হবে। স্বপ্ন ছিল সমুদ্র জয়ের। তার সাধ পূর্ণতার নাগাল পায়নি কখনো। আজ নীলাম্বরী জলে গোসল করতে নেমে সে অন্যরকম আনন্দে মেতে উঠল। ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছিল তার দুরন্তপনা। সাঁতার কেটে ছুটে যাচ্ছিল গভীর জলে। বঙ্গোপসাগর সুইমিংপুল নয়। তবু জলে নামার পূর্বে এসপারভ ভদকা গিলেছে খুব। ভদকা বাংলাদেশে শীতঋতু ছাড়া তেমন স্যুট করে না। তবু এসপারভের ভদকা না হলে চলে না। আসলে রাশানরা ভদকা ছাড়া চিনেই বা কী! এদিকে নাতিউশার চোখের পলক না পড়তেই এসপারভ তলিয়ে গেল জলের নিচে। নির্বাক নাতিউশা উঁচু-উঁচু ঢেউয়ের উল্লাস ছাড়া আর কিছু দেখতে পেল না। সমুদ্র এতো নিষ্ঠুর হতে পারে সে ভাবতে পারেনি। সেও ঝাঁপ দিয়েছিল জলে এসপারভকে উদ্ধার করতে। কিন্তু ঢেউয়ের প্রতিকূলে লড়াই করতে গিয়ে কাবু হয়ে ভেসে যাচ্ছিল। উদ্ধারকর্মীরা দেখতে পেয়ে তাকে টেনে তুলে আনে পাড়ে। এক ক্লান্ত মারমেইডের মতো অনেক্ষণ সে পড়ে থেকেছিল মাটিতে। উৎসুক লোকজনের অনেকেই বিকিনিপরা নাতিউশাকে ভুল করে মারমেইড বলে ডেকে উঠেছিল।
নাতিউশা আর ফিরে যায়নি স্বদেশে। সমুদ্রের বাঁধনে জড়িয়ে আছে তার মনপ্রাণ। সাঁঝের মায়া তাকে প্রলুদ্ধ করে। টেনে আনে সমুদ্র পাড়ে। সে তাকিয়ে থাকে জোছনামাখা বিস্তীর্ণ জলরাশির দিকে। হঠাৎ দেখতে পেল জলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়ামূর্তি। জলের ওপর স্থির হয়ে কেউ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে! ছায়ামূর্তি অবিকল এসপারভের মতো। সম্মোহিত নাতিউশাকে বেষ্টন করে আছে যেন কোনো এক জাদুকরের মায়াজাল। সে চাপাস্বরে ডাক দিল, এসপারভ! এসপারভ!
ছায়ামূর্তি অনড়। নাতিউশার ডাক কতদূর শোনা গেল, বুঝা গেল না। কেবল জলের সুতীব্র চিৎকার ফিরে এলো তার কানে। এত কাছ থেকেও সাড়া দিচ্ছে না এসপারভ। নাতিউশার খুব অভিমান হয়। বুঝতে পারে না এ কোন খেলায় মেতেছে এসপারভ। নাতিউশা পা বাড়ায়। এক কদম, দুই কদম…। ডুবে যায় পায়ের পাতা। একটু একটু করে হাঁটুর ওপরে ওঠে আসে জল। তারপর বেহায়া জল ঝাঁপিয়ে পড়ে তার স্তনের ওপর। এখন জলের সঙ্গম নয়। তার লক্ষ অভীষ্ট গন্তব্যে। আর একটু গেলেই নাগাল পাবে এসপারভের। নাতিউশা থামে না। কারো সাধ্য নেই তাকে থামানোর।
সেদিনের পর থেকে কক্সবাজারে সন্ধ্যার বেলাভূমিতে বিদেশিনীকে আর দেখা যায়নি।