বিড়ালের মামা

জুয়েল আশরাফ »

আমার সবচেয়ে আপন মানুষ একজন অদ্ভুত মানুষ। তার নাম মামা, পুরো নাম মফিজুর রহমান। তবে পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা তাকে ডাকে ‘মোটা বিড়ালের মামা’।
কেন এমন নাম, বলছি। মামার গায়ের রঙ চালতার মত গাঢ় বাদামি, গড়নটা গোলগাল, হাঁটলে থলথলে কাঁপে। আর আছে তার একখানা বিশাল বড় পেট, পাড়ার সবচেয়ে বড় লাউয়ের মতো ঝুলে থাকে। সে কারণেই নাম মোটা বিড়ালের মামা।
কিন্তু নামটা তার খাবার থেকে বেশি আসে। কেউ যদি একবার মামার খাওয়ার দৃশ্য দেখে, জীবনে ভুলতে পারবে না। দুপুরে তিন প্লেট ভাত, পাঁচটি রসগোল্লা আর এক হাঁড়ি ডাল ভরে খান। তবে আশ্চর্যজনকভাবে তার খাবারের প্রতি লোভ নেই, সবই আবেগ। মামা যখন খান, বলেন, ‘এই ভাত আমার শৈশবের কান্না। এই ডাল আমার হোস্টেলের ঝাঁটা খাওয়া। এই মিষ্টি আমার কলেজের ফাঁকা পকেট। বুঝলি ছেলে?’
মামা বিয়ে করেননি। পাড়ার সবার চোখে পাগল টাইপের লোক। কিন্তু আমার চোখে তিনি হিরো। কারণ, এই পাগল লোকটিই আমাকে দত্তক নিয়েছেন।
আমি তখন ফুটপাতে কাঁথা গায়ে ঘুমাচ্ছিলাম। বয়স পাঁচ কি সাড়ে পাঁচ। মা-বাবার নাম জানতাম না। এমন সময় একদিন, গায়ে পাউরুটির টুকরো পড়ে থাকা দেখে, মামা রাস্তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে বলেছিলেন, ‘নাম কী রে তোদের রাজপথের রাজা?’
আমি বলেছিলাম, ‘নেই।
তারপর তিনি নিজের পেটের খালি অংশে আমার মাথা রেখে বলেছিলেন, ‘তোর নাম হবে মুগুর!’
আমি ভেবেছিলাম এটা নিশ্চয় কোনো রাজকীয় নাম। পরে বুঝলাম, মামার প্রিয় তরকারির নামেই আমার নাম। কিন্তু কিছু যায় আসে না, মামা যেখানে, সেখানেই আমার রাজত্ব।
আমাদের সংসারে মানুষ আছি দুইজন, আর আছে আটটা বিড়াল। প্রত্যেকটার আলাদা নাম। বেবি, কেচকি, লিচু, লেমন, মামা, খোকা, ঘুগনি আর পদ্ম। এদের নিয়ে মামা গান বাঁধেন, শাড়ি পরিয়ে পুতুল সাজে সাজান, আর রোজ একবার করে সবার গালে চুমু খান।
যেদিন গল্পটা ঘটল, দিনটা ছিল অমাবস্যা, পাড়ার মেলা উৎসবের ঠিক আগের দিন। এমনিতেই এলাকায় হৈচৈ, কিন্তু আমাদের ঘরে ভয়াবহ বিপদ। মামার পেটের অসুখ। হঠাৎ করে যা খাচ্ছে, বেরিয়ে যাচ্ছে। সেই লোক, যে সারা জীবনে থেমে থেমে খেয়েছে, এখন চুপচাপ বসে আছে।
আমার মন খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু মামার মন আরও বেশি খারাপ। কেননা, মেলার দিন তার বিশেষ রেসিপি- জিলাপি, পেঁয়াজু, পাঁপড়ভাজা, পুড়ি আর দুধ মালাই খাওয়ার কথা ছিল। হাসপাতালে যেতে চাইছেন না। বলছেন, ‘গরিবের পেটের অসুখ কেউ বুঝবে না, ওষুধের বদলে দেবে ঘৃণা।’
আমি চুপ করে গেলাম। ভাবলাম, এবার আমাকে কিছু একটা করতে হবে। সেই রাতে আমি লুকিয়ে পাড়ার ক্লিনিকের সামনে গেলাম। ডাক্তার সাহেব, দয়ালু মানুষ, বললেন, ‘তোর মামাকে নিয়ে আয় কাল সকালেই। আমি ফি নেব না।’
খুশি হয়ে ফিরছিলাম, হঠাৎ শুনি, পাশের দোকান থেকে বিড়ালদের খাবার চুরি গেছে। চারদিকে গণ্ডগোল। লোকজন বলছে, ‘এই যে মোটা মামা, এদের বাড়ির বিড়ালগুলোই চুরি করছে!’
আমি বললাম, ‘ওদের পেট খালি, আপনি খাওয়ান, চুরি করবে না।’
লোকজন হেসে উড়িয়ে দিল। পরদিন ভোরে মামার গলা শুনে আমার ঘুম ভাঙল। দেখলাম, আমার প্রিয় আটটা বিড়াল মামার পেটে গুটিশুটি হয়ে ঘুমাচ্ছে। মামা তাকিয়ে বললেন, ‘মুগুর, ওরা শুধু বিড়াল না, আমার ডাক্তার।’
আমি হেসে ফেললাম। সত্যি, ওর শরীরের সব উত্তাপ, ব্যথা, বিষন্নতা যেন আটটা গরম গা আর একটা ছোট্ট ঘর মিলেই টেনে নিয়েছে। আমি বললাম, ‘আজ তো গরুর পা দিয়ে হালিম রান্না করবে বলেছো। তুমি কি রাঁধবে?’
মামা বললেন, ‘এবার অন্য রেসিপি। নাম: ভালবাসার ঝোল। তুই থাকিস পাশে। আমার একটাই ইচ্ছে, যেদিন আমি থাকবো না, তুই এই আটটা বিড়াল নিয়ে একটা নতুন সংসার তৈরি করবি। আর একটা ছেলে কুড়িয়ে এনে নাম দিবি মুগুর-টু।’
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘তখন আমি তাকে শেখাবো কীভাবে পেঁয়াজুপুড়ি বানাতে হয়!’
আমি এখন বড় হয়েছি। স্কুলে সেভেনে পড়ি। মামা নেই। কিন্তু তার বানানো ‘ভালবাসার ঝোল’ আমি এখনো মাঝে মাঝে বানাই। আমাদের সংসার এখন ১৮টা বিড়ালের। আর আছে একটা ছোট্ট ছেলে, পথ থেকে পাওয়া। তার নাম আমি দিয়েছি ‘চিকেন ফ্রাই’।
মোটা বিড়ালের মামা বলতেন, ‘আসলে কেউ হারিয়ে যায় না। শুধু একটু জায়গা দরকার হয়, যেখানে তাকে রেখে বলা যায়, তুই আমার সব।’