বিড়ালের বন্ধুত্ব

আব্দুস সাত্তার সুমন »

মানিকদি গ্রামের শেষ মাথায় ছিল ছোট্ট রিদওয়ানের বাড়ি। খুব সকালে যখন ধানভেজা বাতাস মাঠের ওপর দিয়ে দৌড়াতো, রিদওয়ান তখন স্কুলব্যাগ গোছাতো। কিন্তু একদিন, ব্যাগে খাতা-কলমের মাঝে সে একটি ছোট্ট নরম কিছু স্পর্শ করল।
টুপ করে লাফ দিয়ে বের হয়ে এল একটি সাদা বিড়ালছানা! তার চোখ দুটো যেন দুধের ওপর ফোটা দুই ফোঁটা আকাশ! বিড়ালটার গলায় বাঁধা ছিল নীল রঙের একটা ফিতা, ফিতার ওপর ছোট লেখা আমার নাম মেঘদূত।
রিদওয়ান অবাক হলেও ভয় পেল না। বরং বিড়ালটির চোখে এমন এক মিষ্টি ভরসা ছিল, যেন সে অনেক দূর থেকে শুধু রিদওয়ানের বন্ধু হতে এসেছে। রিদওয়ান বলল, তুমি কোথা থেকে এলে, হে মেঘদূত?
মেঘদূত তখন মিঁউ করে উত্তর দিল। সেই মিঁউ যেন একটা গল্প বৃষ্টির দিনে হারিয়ে যাওয়া তার আগের মালিক, অন্ধকার রাতে ভয় পাওয়া, আর অনেক দূর হেঁটে শেষে রিদওয়ানের উঠোনে এসে থেমে যাওয়া। রিদওয়ান বিড়ালটিকে কোলে নিল। সে কোলে থাকার ভরসাতেই মেঘদূত বুঝতে পারল, বন্ধুত্ব কখনো লুকিয়ে আসে না; বন্ধুত্ব হঠাৎ করেই ঠিক দরজার সামনে দাঁড়ায়।
বিকেল হলেই রিদওয়ান মাঠে যেত আর মেঘদূত লাফিয়ে লাফিয়ে পিছনে যেত। রিদওয়ান দৌড়ালে মেঘদূত দৌড়াতো, রিদওয়ান হাসলে সে লেজ নাড়াতো,
রিদওয়ান রেগে গেলে মেঘদূত তার গা দিয়ে মাথা ঘষে রাগ ভাঙিয়ে দিত।
একদিন স্কুল থেকে ফিরে রিদওয়ান দেখতে পেল মেঘদূত নেই। বাড়িতে, উঠোনে, মাঠে কোথাও নেই! রিদওয়ানের বুক কেঁপে উঠল। সে ছোট্ট হলেও মেঘদূতকে হারানোর ভয়টা ছিল খুব বড়। বিকেলে আকাশ কালো হয়ে ঝড় শুরু হল। রিদওয়ান ছুটে বের হলো রেইনকোট পরে, যদিও মা অনেক বার বলল না, বের হবি না! কিন্তু বন্ধুর জন্য রিদওয়ান থামেনি।
বাঁশঝাড়ের কাছে সে শুনতে পেল ক্ষীণ মিঁউ মিঁউ শব্দ।
মেঘদূত ভিজে কাঁপছে। তার পায়ে কাঁটা বিঁধেছে। রিদওয়ান তাকে বুকে চেপে ধরল। ঝড়ের মাঝেও সেই কোলে মেঘদূত শান্ত হয়ে গেল, যেন বলছে,
আমি জানতাম তুমি আসবে।
পরদিন মেঘদূতের পায়ের ব্যান্ডেজ করে দিল গ্রামের এক দাদু ভেটেরিনারি। মেঘদূত তখন রিদওয়ানের দিকে তাকিয়ে এমনভাবে চোখ টিপল, যেন বলল, বন্ধুরা শুধু খেলে না; বন্ধুরা পাশে দাঁড়ায়। সেদিন থেকে রিদওয়ান আর মেঘদূত দু’জন দুইজনের অবিচ্ছেদ্য সাথী। রিদওয়ান পড়ার টেবিলে বসলে মেঘদূত তার পাশে ঘুমায়। রাত হলে দুজনই আকাশের দিকে তাকায় মেঘ দেখে, তারা দেখে, আর ভাবে মানুষ আর বিড়ালের বন্ধুত্বও আকাশের মতোই বিশাল, নরম, আর চিরস্থায়ী।