সাধন সরকার :
বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের ভূপৃষ্ঠের কোনো একটি ¯’ানের জলবায়ুগত ধরন (তাপ, বায়ুপ্রবাহ ও ভিন্ন প্রকৃতিগত অব¯’া) হলো ঋতু। ছোট্টবন্ধুরা, আমরা যে গ্রহে বাস করি, সেই পৃথিবী নামক গ্রহসহ সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ সূর্যের চারপাশে ঘুরে। পৃথিবীসহ প্রতিটি গ্রহ দুভাবে ঘুরে। একবার নিজের অক্ষে বা চারদিকে, আরেকবার সূর্যের চারদিকে। নিজের চারদিকে পৃথিবীর এই ঘোরাকেই ভূগোলের ভাষায় বলে আহ্নিকগতি। আর এই আহ্নিকগতির ফলে দিনরাত হয়। আবার পৃথিবী কিš‘ সূর্যের চারদিকেও ঘোরে। এই ঘোরাকে বলে বার্ষিকগতি। আর এই বার্ষিকগতির কারণেই ঋতু পরিবর্তন হয়। বন্ধুরা, সূর্যের চারদিকে পৃথিবীকে ঘুরে আসতে সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা। ঘুরে আসার এই সময়কালকে বলে এক বছর বা এক সৌরবছর।
বন্ধুরা, সমগ্র পৃথিবীকে আমরা একটি মানচিত্রে যদি কল্পনা করি তাহলে দেখতে পাব এই মানচিত্র বা পুরো পৃথিবীর মাঝখানে নিরক্ষরেখা বা বিষুবরেখা (মানচিত্রে মাঝ বরাবর পূর্ব-পশ্চিমে দাগ বা রেখা) দ্বারা পৃথিবীকে ওপরে-নিচে দুটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। ওপরের অংশকে উত্তর গোলার্ধ আর পৃথিবীর মানচিত্রের নিচের অংশকে বলে দক্ষিণ গোলার্ধ। জেনে রাখা ভালো, পৃথিবী যে পথে সূর্যের চারদিকে ঘুরে সে পথ পুরোপুরি বৃত্তাকার বা গোল নয়, বরং উপবৃত্তাকার। পৃথিবী যেহেতু নিজের অক্ষে বা চারদিকে ঘুরে, আবার যেহেতু সূর্যের চারদিক ঘুরে তাই বিভিন্ন সময় পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ সূর্যের দিকে হেলে থাকে। এর ফলে কখনো উত্তর গোলার্ধ সূর্যের কাছে যায় আবার কখনো দক্ষিণ গোলার্ধ। যখন যে অংশ সূর্যের কাছে যায় বা হেলে পড়ে তখন সে অংশ খাড়াভাবে সূর্যের তাপ ও আলো পায়, স্বাভাবিকভাবে সে অংশে বেশি গরম পড়ার কারণে তখন সেখানে গ্রীষ্মকাল হয়। একটা অংশ সূর্যের কাছে থাকা মানে অপর অংশ উল্টোদিকে সূর্যের দূরে অব¯’ান করার কারণে সেখানে তাপ ও আলো কম অর্থাৎ শীতকাল।
উদাহরণস্বরূপ যদি আমরা বলি, বাংলাদেশ যেহেতু উত্তর গোলার্ধে আর অস্ট্রেলিয়া যেহেতু দক্ষিণ গোলার্ধে সেহেতু বাংলাদেশে যখন গ্রীষ্মকাল, অস্ট্রেলিয়ায় তখন শীতকাল। বিপরীতভাবে বাংলাদেশে যখন শীতকাল অস্ট্রেলিয়ায় তখন গ্রীষ্মকাল। বন্ধুরা, এবার একটু কল্পনা করে দেখ তো যদি পৃথিবী সূর্যের চারদিকে না ঘুরার কারণে ঋতু পরিবর্তন না হতো তাহলে একটা দেশে তো সব সময় একটা ঋতু থাকতো তাই নয় কি? নাতিশীতোষ্ণ (খুব বেশি গরম না, আবার খুব বেশি শীতও নয়, এমন আবহাওয়া) অঞ্চলে সাধারণত রয়েছে পাঁচটি ঋতু। যথা- বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, হেমন্ত, শীত। ক্রান্তীয় অঞ্চলসমূহে (গ্রীষ্মকালে কম বৃষ্টিপাত, শীতকালে বেশি বৃষ্টিপাত এর প্রধান বৈশিষ্ট্য) সাধারণত রয়েছে দুটি ঋতু : শুষ্ক ও আর্দ্র। আবার ভারত মহাসাগরের আশপাশে অব¯ি’ত মৌসুমি এলাকাসমূহে রয়েছে প্রধানত তিনটি ঋতু : শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা।
বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। পুরো এক বছরকে ছয়টি ঋতুতে বিভক্ত করা হয়েছে, যথা : গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। মূলত মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এদেশে ঋতুর আগমন ঘটে এবং সেগুলো একটার পর একটা ঘুরে ঘুরে আসে। ঋতুগুলোর তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ও বায়ুপ্রবাহ একটি থেকে অপরটি আলাদা। ভৌগোলিক অব¯’ানের দরুণ বাংলাদেশের জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ। যদিও বাংলাদেশের জলবায়ু প্রধানত উপক্রান্তীয় মৌসুমি প্রকৃতির তথা উষ্ণ ও আর্দ্র। তথাপি আমাদের বাংলাদেশে প্রতি দু মাস অন্তর ঋতুবদল হয়। একবারে সময় মেনে মাস ধরে ধরে ঋতুগুলো পরিবর্তন যে হয় তা কিš‘ নয়, কিছুটা সময় আগে-পরেও হতে পারে! জলবায়ু পরিবর্তনের এই বৈশি^ক প্রেক্ষাপটে ঋতুগুলোর ধরন বদলে গেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে বাস্তবিক পক্ষে বাংলাদেশে তিনটি ঋতুর আনাগোনা সবচাইতে বেশি!
ছোট্টবন্ধুরা, অধিক তাপমাত্রা আর ঝড়বৃষ্টি প্রাক মৌসুমি গ্রীষ্মকালের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বাংলা বছরের শুরু হয় গ্রীষ্ম দিয়ে। গ্রীষ্মের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষে প্রথম দিন হিসেবে উদ্যাপন করা হয়। বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য (এপ্রিল মাসের মধ্যভাগ থেকে জুন মাসের মধ্যভাগ পর্যন্ত) এ দুই মাস গ্রীষ্মকাল। গ্রীষ্মের দিনগুলো সাধারণত উষ্ণ ও শুষ্ক। বাংলাবর্ষের দ্বিতীয় ঋতু হলো বর্ষা। এর ¯ি’তি আষাঢ় ও শ্রাবণ (জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত) এ দু’মাস। বর্ষায় চারদিকে পানি থৈ থৈ করে। নদী-নালা, খাল-বিল ও পুকুর-ডোবা কানায় কানায় ভরে ওঠে। বর্ষার শেষ হওয়ার পর বছরের তৃতীয় ঋতু শরৎ এক অপূর্ব শোভা ধারণ করে হাজির হয়। ভাদ্র ও আশ্বিন (আগস্ট মাসের মধ্যভাগ থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যভাগ পর্যন্ত) মিলে শরৎকাল।
এ সময় নীল আকাশে সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায়। বাংলাবর্ষের চতুর্থ ঋতু হেমন্ত। এর সময়কাল কার্তিক ও অগ্রহায়ণ (মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য ডিসেম্বর) মাস জুড়ে। শীতকাল ষড়ঋতুর পঞ্চম ঋতু। বাংলা বর্ষপঞ্জির সময়কাল অনুসারে পৌষ ও মাঘ (মধ্য ডিসেম্বর থেকে মধ্য ফেব্রুয়ারি) এ দু মাস শীতকাল হলেও বাস্তবে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়াারি পর্যন্ত শীতের ঠান্ডা অনুভূত হয়! শীতকাল বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ও আরামদায়ক ঋতু। শীতকাল প্রধানত শুষ্ক। বাংলা বর্ষপঞ্জির সর্বশেষ ঋতু বসন্ত। শীতের পর বসন্তকাল বাংলাদেশের প্রকৃতিতে রমণীয় শোভা বিস্তার করে তার চিরচেনা পরশ বুলিয়ে যায়। ফাল্গুন ও চৈত্র মাস (ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগ থেকে এপ্রিলের মধ্যভাগ পর্যন্ত) নিয়ে বসন্তকাল। বাংলাদেশের দক্ষিণে সমুদ্র, উত্তরে হিমালয় পর্বত এবং বিশাল সমভূমির জন্য বাংলাদেশে শীত বা গ্রীষ্ম এককভাবে কোনোটিই অতি বেশি অনুভূত হয় না। বাংলাদেশের এ নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু প্রকৃতির কিছু জলবায়ুগত দুর্যোগ ছাড়া মোটামুটি আরামপ্রদ বলা যেতে পারে।