বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন

বিজ্ঞানীদের জীবনী

টমাস আলভা এডিসনের জন্ম ১৮৪৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কানাডার মিলানে। তাঁর পিতা ছিলেন ওলন্দাজ বংশোদ্ভুত। এ সময় তাঁর পিতার আর্থিক সচ্ছলতা ছিল। ফলে এডিসনের ছেলেবেলার দিনগুলো ছিল আনন্দদায়ক। সাত বছর বয়সে এডিসনের পিতা মিশিগানের অন্তর্গত পোর্ট হারান নামে একটা শহরে এসে নতুন করে বসবাস শুরু করলেন। এডিসন স্কুলে ভর্তি হলেন। তিনি অসম্ভব মেধার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু স্কুলের গন্ডিবাঁধা পড়াশুনা তাঁর নিকট একঘেঁয়েমি মনে হত। পড়াশুনায় কোনো মনোযোগ নেই, শিক্ষকদের অভিযোগ শুনে ক্ষুব্ধ হতেন। ফলে স্কুল ছাড়িয়ে আনলেন। এখানেই এডিসনের তিন মাসের স্কুল জীবনের সমাপ্তি ঘটল। আর কোনদিন স্কুলে যান নি এডিসন। এবার মায়ের নিকট তাঁর পড়াশুনা শুরু হল।
তিনি ১৮৬৯ সালে বোস্টনে চাকরিরত অবস্থায় একটি যন্ত্র আবিষ্কার করলেন যা দিয়ে ভোল্ট গণনা করা যায়। এই যন্ত্রের গুণাগুণ বিবেচনা
করে উদ্ভাবক হিসেবে তাঁকে পেটেন্ট দেওয়া হল। আর এই পেটেন্ট এডিসনের জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এরপর বোস্টন শহর ছেড়ে চলে এলেন নিউইয়র্কে। হাতে মোটেও পয়সা নেই। খাওয়া হয় নি দু’দিন ধরে। এক টেলিগ্রাফ অপারেটরের সাথে পরিচয় ঘটল। সে এডিসনকে এক ডলার ধার দিয়ে গোল্ড ইনডিকেটর কোম্পানির ব্যাটারি ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেখানে দু’দিন কেটে গেল। তৃতীয় দিন তিনি খেয়াল করলেন ট্রান্সমিটারটি খারাপ হয়ে গিয়েছে। ম্যানেজারের অনুমতিক্রমে তিনি অল্পক্ষণের মধ্যেই ট্রান্সমিটারটি মেরামত করে ফেললেন। এর ফলে তিনি কারখানার ফোরম্যান হিসেবে চাকরি পেলেন। তাঁর মাইনে ছিল ৩০০ ডলার। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নিজের যোগ্যতা বলে ম্যানেজার পদে উন্নীত হলেন। এই অর্থ দিয়ে তিনি নিজের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনে গবেষণার কাজে লাগাতেন। গোল্ড ইনডিকেটর কোম্পানি টেলিগ্রাফের জন্য এক ধরনের যন্ত্র তৈরি করত যার ফিতের উপর সংবাদ লেখা হত। সময় এডিসনের মনে হল বর্তমান ব্যবস্থার চেয়ে আরো উন্নত ধরনের যন্ত্র তৈরি করা সম্ভব। এজন্যে প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার। এ সময় চাকরিতে ইস্তফা দিলেন এডিসন। কয়েক মাস প্রচণ্ড পরিশ্রমের পর উদ্ভাবন করলেন এক নতুন যন্ত্র। এটি আগের চেয়ে অনেক উন্নত এবং সেই সঙ্গে এর উৎপাদন ব্যয়ও কম। তিনি এ যন্ত্রটি নিয়ে গেলেন গোল্ড ইনডিকেটর কোম্পানীর মালিকের নিকট। এতে মালিক খুশি হলেন। এডিসনকে জিজ্ঞাসা করলেন, কত দামে সে যন্ত্রটি বিক্রি করবে? এডিসন দ্বিধান্বিতভাবে বললেন, যদি পাঁচ হাজার ডলার দাম বেশি হয়, আবার তিন হাজার ডলার খুব কম হয় তবে কোম্পানী স্থির করুক তারা কি দামে যন্ত্রটি কিনবে। কোম্পানীর মালিক এডিসনকে চল্লিশ হাজার দিয়ে বললেন, আশা করি আপনাকে আমরা সন্তুষ্ট করতে পেরেছি। এডিসন তো হতবাক! এই প্রচুর অর্থ বিজ্ঞানী এডিসনের জীবনে এক অভাবনীয় পরিবর্তন এনে দিল। এতদিন তিনি অন্যের অধীনস্থ হয়ে কাজ করতেন। সেখানে তাঁর স্বাধীনতা ছিল না। এবার কয়েক মাসের চেষ্টায় নিউজার্সিতে তৈরি হল তাঁর কারখানা। তিনি সেখানে দিবারাত্রি কাজ করতেন। রাত্রে মাত্র কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নিতেন। এ কারখানাটি ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি গবেষণাগার। কয়েক বছরের মধ্যেই এডিসন প্রায় একশোটির বেশি নতুন উদ্ভাবন করে তার পেটেন্ট নিলেন। এগুলি বিক্রি করে পেলেন প্রচুর অর্থ। এডিসন এবার নিজের কারখানায় কাজ করতে করতে পুনরায় আকৃষ্ট হলেন টেলিগ্রাফির দিকে। অল্পদিনেই তৈরি হল ডুপ্লেক্স টেলিগ্রাফ পদ্ধতি। এর সাহায্যে দুটি বার্তা একই সাথে একই তারের মধ্যে দিয়ে দুই দিকে পাঠানো সম্ভব। এরপরে একই সময়ে একই তারের মধ্যে দিয়ে একাধিক বার্তা প্রেরণ করতে সক্ষম হলেন। আর এই পদ্ধতির সাহায্যে টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার যে শুধু অসাধারণ উন্নতি হল তাই নয়, বরং খরচও কয়েকগুণ হ্রাস পেল। তিনি ১৮৭৬ সালে তাঁর নতুন কারখানা স্থাপন করলেন মেনলো পার্কে। এখানে একদিকে তাঁর গবেষণাগার অন্যদিকে কারখানা। এই মেনলো পার্কে বিজ্ঞানী এডিসনের প্রথম উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার টেলিফোন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ। আলেকজান্ডার গ্রাহামবেল আবিষ্কার করেছিলেন টেলিফোন, কিন্তু ব্যবহারের ক্ষেত্রে বহুবিধ সমস্যা দেখা গিয়েছিল। এডিসন কয়েক মাসের চেষ্টায় তৈরি করলেন কার্বন ট্রান্সমিটার। আর এর সহায়তায় গ্রাহকদের প্রতিটি কথা স্পষ্ট এবং পরিষ্কারভাবে শোনা গেল। চতুর্দিকে সুনাম ছড়িয়ে পড়ল এডিসনের। এডিসন দীর্ঘদিন মানুষের শ্রবণ যন্ত্র নিয়ে কাজ করেছিলেন। এবার তিনি স্থির করলেন ইলেকট্রিক কারেন্টকে কাজে লাগিয়ে আলো জ্বালাবেন। সে সময় এক ধরনের বৈদ্যুতিক আলো ছিল কিন্তু তা ব্যবহারের উপযোগী ছিল না। প্রথমেই তিনি এমন একটি ধাতুর সন্ধান করেছিলেন যার মধ্যে কারেন্ট প্রবাহিত করলে উজ্জ্বল আলো বিকিরণ করে। তিনি বিভিন্ন রকমের ধাতু নিয়ে ১৬০০ রকমের পরীক্ষা করলেন।
অবশেষে দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরতৈরি করলেন কার্বন ফিলামেন্ট। তিনি শুধু বাল্বের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন। এরপর প্রয়োজন দেখা দিল সমগ্র বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি সাধনে তৎপর হলেন। তিনি তৈরি করলেন নতুন এক ধরনের ডাইনামো, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার জেনারেটর থেকে শুরু করে ল্যাম্প তৈরি করা প্রভৃতি। নিউইয়র্কে প্রথম বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র গড়ে উঠল যার অগ্রনায়ক ছিলেন বিজ্ঞানী এডিসন। এবার এডিসন তাঁর বিখ্যাত মেনলো পার্ক ছেড়ে ওয়েস্ট অরেঞ্জে চলে এলেন। ১৮৪৭ সালের ঘটনা। এসময় তিনি শব্দের গতির মতো কীভাবে ছবির গতি আনা যায় তাই নিয়ে শুরু করলেন ব্যাপক গবেষণা। মাত্র দু’বছরের মধ্যে উদ্ভাবন করলেন ‘কিনেটোগ্রাফ’ যা গতিশীল ছবি তোলবার জন্য প্রথম ক্যামেরা। ১৯২২ সালে এডিসন আবিষ্কার করলেন কিনেটোফো যা সংযুক্ত করা সিনেমার ক্যামেরার সাথে। এরই ফলে তৈরি হল সবাক চিত্র। এই পরিশ্রমী বিজ্ঞানী অবশেষে ১৯৩১ সালের ১৮ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করলেন। তাঁর মৃত্যুর পর নিউইয়র্ক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, ‘মানুষের ইতিহাসে এডিসনের মাথার দাম সবচেয়ে বেশি”। কারণ এমন সৃজনীশক্তি অন্য কোনো মানুষের মধ্যে দেখা যায় নি।