জাহেদ কায়সার »
শান্তিপ্রিয় বাঙালি জাতিকে যুগে যুগে শোষণ করেছে বহিরাগত নানা জাতি। লুণ্ঠিত হয়েছে বাংলার সম্পদ, বিপন্ন হয়েছে জাতিস্বত্তা। বাঙালি জাতিস্বত্তায় এমনই এক গৌরবের নাম স্বাধীনতা যুদ্ধ।
১৯৭১ সাল। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা বাংলার সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। ২৬ তারিখ সারা দিন ধরে চলে কারফিউ। ২৭ মার্চ ঘণ্টা দুয়েকের জন্য কারফিউ তুলে নেওয়া হলো। সকাল নয়টা থেকে বেলা ১১টা।
সফিকের বাবা নাসিরুদ্দিন ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। সফিক তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র । ষ্টেশনের পাশ দিয়ে বুড়িমার বাগানের গা ঘেঁষে সরু ইটের রাস্তাটা দিয়ে বাঁ হাতে কিছুটা গেলেই সফিকের স্কুলটা । বাঁশের বেড়া দিয়ে পরপর ছ’টা ঘর, মাথাটায় টিনের ছাদ। তিনি এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
২৭ মার্চ সকালে স্কুল থেকে এসে রেডিও ছাড়লেন কিছু একটা শুনতে! সফিকের বাবা মাথা নিচু করে দুই হাতের ওপর মাথা রেখে কী যেন মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। সফিক পাশে এসে দাঁড়ালো, বাবা মনোযোগ দিয়ে রেডিও শুনছেন। রেড়িওতে বার বার ভেসে আসছে স্বাধীনতার ঘোষণা।
একসময় বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। চারিদিকে আন্ধকার। রাতে হঠাৎ কিসের আওয়াজ, সফিক জানালার ফাঁক দিয়ে দেখল বড় বড় জিপ গাড়িতে হর্ন বাজাতে বাজাতে মিলিটারিরা তাদের গ্রামে প্রবেশ করছে। সৈন্যরা ঝুপঝাপ করে গাড়ি থেকে নামছিল। সবার পায়ে শক্ত বুট খাকি শার্ট, মাথায় লোহার টুপি এবং কাঁধে রাইফেল। তাদের দেখে অজানা আতঙ্কে সফিকের বাবার মন আঁতকে উঠল পরের দিন দেখল মিলিটারিরা গ্রামের ব্রীজটার পাশে বড়সড় তাঁবু টানিয়েছে।
রাত গভীর হলো, হঠাৎ ভয়ংকর আওয়াজ! দরজায় কট কট শব্দ। সফিকের বাবা ছুটে গিয়ে বিছানা থেকে সবাইকে নামিয়ে খাটের নিচে ঢুকিয়ে দিচ্ছিলেন। ছোটাছুটি করে অন্যদেরও মেঝেতে নামালেন। এরই মধ্যে দুজন মিলিটারি দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে সফিকের বাবাকে তুলে নিয়ে গেলো। তারপর রাতভর ভয়াবহ নির্যাতন। ভোর বেলায় গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেল স্কুল মাঠে। পাক হানাদার বাহিনীর এমন নির্মম নির্যাতন আর গণহত্যার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে এদেশের ছাত্র – জনতা।
দীর্ঘ নয় মাস পাক হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নামক একটি ভুখণ্ডের সূচনা হয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা, নারী-পুরুষ তথা আপামর জনসাধারণ। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হলো আমাদের লাল-সবুজের পতাকা। সফিকের বাবা যে স্কুলের শিক্ষক ছিলেন সে স্কুলের নাম দেওয়া হলো শহীদ নাসিরুদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়।
১৬ ডিসেম্বর, বিজয় দিবস। দূর থেকে মাইকের আওয়াজ ভেসে আসছে – ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না।’
সফিক দীর্ঘদিন পরবাবার স্কুলে আসলো । আগে স্কুলের ছাদটা ছিল টিন শেডের। এখন পাকা দোতলা বিল্ডিং করা হয়েছে । সফিকের মনটা হঠাৎ কেমন করে ওঠে। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তার বাবা। প্রায় একবছর হতে চললো স্কুলটি বন্ধ। করোনা রোগের জন্য লকডাউন চলছে। তাই স্কুলে ছাত্র – ছাত্রীদের কোন কোলাহল নেই। শুধু স্কুল ভবনে ছাদে শির উঁচু করে উড়ছে বিজয় নিশান।