বিজয়ের পতাকা

বিচিত্র কুমার »

হাসানপুর গ্রামের ছোট্ট ছেলেটির নাম নাফিস। বয়স মাত্র দশ বছর, কিন্তু দেশের প্রতি তার ভালোবাসা অনেক গভীর। প্রতি বছর বিজয় দিবস এলে তার একটাই ইচ্ছে নিজের হাতে পতাকা ওড়াবে। বাবাকে সে বারবার বলে,
‘বাবা, এবার আমরাও বড় একটা পতাকা ওড়াবো আমাদের উঠোনে!’
বাবা হেসে বলেন, ‘অবশ্যই, কিন্তু মনে রেখো, পতাকা শুধু কাপড়ের টুকরো নয়। এটা আমাদের দেশের সম্মান, মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের প্রতীক। একে শ্রদ্ধা জানাতে হবে।’
নাফিস বাবার কথা গম্ভীর মুখে শোনে। সে জানে, মুক্তিযুদ্ধ কোনো গল্প নয়, এটা সত্যি। তার দাদু যুদ্ধ করেছিলেন, বাবার মুখে সেই কষ্টের গল্প শুনে সে অনেক সময়ই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে। তাই এবারের বিজয় দিবসে সে কিছু একটা করবেই।
বন্ধুদের সঙ্গে বসে সে পরিকল্পনা করে। তাদের স্কুলের সামনের মাঠে পতাকা ওড়াবে। কিন্তু তার জন্য দরকার বড় একটা বাঁশ আর একটা পতাকা।
বন্ধু মীম বলল, ‘আমার মা তো সেলাই জানেন, আমরা কি কাপড় কিনে নিজেরাই বানাতে পারি?’
রায়হান মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ! আর লাল বৃত্ত তো রঙ দিয়ে আঁকা যায়!’
তাদের কথায় সবার মনে উৎসাহ জাগল। সবাই মিলে নিজের পয়সা জমানো শুরু করল। যার যত সঞ্চয় ছিল, একসঙ্গে জড়ো করে কিছু টাকা হল। সেই টাকায় তারা সবুজ কাপড় আর লাল রং কিনল। মীমের মা খুব যত্ন করে কাপড় কেটে একটি সুন্দর পতাকা তৈরি করে দিলেন। রাতের আঁধারে সবাই মিলে রঙ দিয়ে মাঝখানে লাল বৃত্ত আঁকল। সেদিন রাতে আনন্দে নাফিস ঘুমোতেই পারল না। তার মনে হচ্ছিল, যেন সে দেশের জন্যই কিছু করতে চলেছে।১৬ ডিসেম্বর সকালে খুব উৎসাহ নিয়ে তারা মাঠে গেল। কিন্তু গিয়ে দেখে, বাঁশ নেই! রাতের অন্ধকারে কেউ সেটি নিয়ে গেছে। সবাই হতাশ হয়ে পড়ল।
সোনিয়া বলল, ‘এখন কী হবে?’ তুষার মুখ কালো করে বলল, ‘পতাকা তো বাঁশ ছাড়া তোলা যায় না।’ ঠিক তখনই স্কুলের দারোয়ান চাচা এসে বললেন, ‘তোমরা যে বাঁশটা নিয়েছিলে, সেটি খুব পুরোনো ছিল, আমি ভেবে রেখেছিলাম, মসৃণ করে ঠিকঠাক কেটে দেব, যাতে ভালোভাবে কাজে লাগে। এসো, নিয়ে চলো!’
সবাই আনন্দে নাচতে লাগল। দারোয়ান চাচা নিজের হাতে তাদের জন্য বাঁশটি এনে দিলেন।
সকাল ৯টা বাজতেই স্কুল মাঠে অনেক মানুষ জড়ো হলো। প্রধান শিক্ষক ঘোষণা দিলেন, ‘আজ আমাদের শিক্ষার্থীরা তাদের ভালোবাসা দিয়ে তৈরি পতাকা উত্তোলন করবে।’
সবাই হাততালি দিল। নাফিস আর তার বন্ধুরা মিলে পতাকাটি ধরে বাঁশের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে দিল। প্রধান শিক্ষক ধীরে ধীরে সেটি উপরে তুলতেই লাল-সবুজ পতাকাটি বাতাসে উড়তে লাগল।
চারপাশে সবাই একসঙ্গে গলা মিলিয়ে বলে উঠল, ‘জয় বাংলা!’
নাফিসের চোখে আনন্দের জল এসে গেল। মীম ফিসফিস করে বলল, ‘আমরা পেরেছি, নাফিস!’
নাফিস হাসল, ‘হ্যাঁ, কারণ আমরা সবাই একসঙ্গে চেষ্টা করেছি।’
সেদিন সে এক নতুন শিক্ষা পেল পতাকা শুধু কাপড় নয়, এটি ভালোবাসা, সম্মান, আর ঐক্যের প্রতীক। একসঙ্গে চেষ্টা করলে, তবেই আসে সত্যিকারের বিজয়।