সুপ্রভাত ডেস্ক »
সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, আপনাদের বিএনপির সাংবাদিক হওয়ার দরকার নেই। আপনারা দেশের সাংবাদিক হন, জনগণের সাংবাদিক হন, মানুষের সাংবাদিক হন। এটাই হচ্ছে নতুন বাংলাদেশের প্রতিজ্ঞা।
তিনি বলেন, সাংবাদিকতার নামে যারা স্বৈরাচারের পক্ষে দাঁড়ায়, তারা আসলে সাংবাদিক না। তারা প্রেস ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে একটি ব্যক্তির পক্ষে, একটি দলের পক্ষে অবস্থান নেয়– তারা সাংবাদিকতার সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। তারা হয়ে গেছে দলীয় কর্মী। এই জিনিসগুলো আপনাদের অনুধাবন করতে হবে। আমাদের যেন তাদের মতো চলতে না হয়, সেটাও মাথায় রাখতে হবে।
মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে একটি সমাবেশে অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির এ সদস্য।
আমীর খসরু বলেন, আমরা ১৫ বছর ধরে সাংবাদিকতার চিত্র সম্মুখভাগে দেখেছি। কারণ আমরা সম্মুখভাগে ছিলাম। কারা নিজের দেশকে বিক্রি করে সাংবাদিকতা করেছে, কারা ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারের সঙ্গে থেকে সুবিধা ভোগ করেছে, সাংবাদিকতার দায়িত্বকে ধ্বংস করেছে, সব দেখেছি। শেখ হাসিনার প্রেস কনফারেন্স শেষে যে সাংবাদিকরা জনগণের কথা না তুলে ধরে স্বৈরাচারের কথা তুলে ধরেছে। তারা কি কোনো সাংবাদিক? তারা তো সাংবাদিকতার মানসম্মান নষ্ট করেছে।
তিনি আরও বলেন, আপনারা নিশ্চয় দেখেছেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরে তারেক রহমানকে বিদ্রূপ করে একটা কার্টুন ছাপা হয়েছিল। সবাই ভেবেছিল এই সাংবাদিক বিপদে পড়বে। কিন্তু হলো উল্টো– তারেক রহমান সাহেব স্ট্যাটাস দিলেন, ‘আমরা দেড় দশক ধরে যুদ্ধ করছি– এই সাংবাদিকরা যাতে তাদের এ কাজগুলো করতে পারে।’ এই কথার মধ্যেই সব মেসেজ চলে এসেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এ সদস্য বলেন, আমরা সত্যিকারের সাংবাদিকতা চাই, নিরপেক্ষতা চাই। সাংবাদিকদের পেশাগত মানদণ্ড অক্ষত রাখতে হবে। এটাই হবে নতুন বাংলাদেশের শপথ। আগামীতে সাংবাদিকরা যদি জনগণের কথা তুলে ধরতে পারে, স্বাধীনতার কথা, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক অধিকার তুলে ধরতে পারে– তাহলেই হবে সফল সাংবাদিকতা।
‘আমি কিন্তু আজকের এই দিনে গত বছরে জেলে ছিলাম– যখন শেখ হাসিনা পালিয়ে যাচ্ছিলেন। জেলের ভেতরে জানতে পারলাম, সেনাবাহিনীর প্রধান তখন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন। জেলখানায় আমাদের কাছে তো কোনো সংবাদ থাকে না। কিছু কিছু লোক রুমে রেডিও চালায়, ওটা তার বন্দোবস্তের মাধ্যমে। তো একজন এসে বলল, এটা শুনতে হবে, সেনাবাহিনীর প্রধান বক্তব্য রাখছেন। তখনই মনে হলো, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন, পদত্যাগ করেছেন।’
কঠিন সময়ের কথা স্মরণ করে আমীর খসরু বলেন, আগে তো অনেকবার জেলে গিয়েছি কিন্তু শেষবার অর্থাৎ গত বছর এই দিনে জেলে কাটানো সময় অনেক কঠিন ছিল। পাঁচটার সময় লকআপ, পরিবারের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই, বাইরে থেকে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ– এই কঠিন অবস্থার মধ্যে একটা দিন কাটাচ্ছি। এই সময়ে যখন এ খবর এলো, তখনই আমরা ধরে নিয়েছি দেশ মনে হয় মুক্তির দিকে যাচ্ছে।
জেলের মধ্যে বোমা ফাটার মতো আওয়াজ হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, যখন সেনাপ্রধান তার বক্তব্যে শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরলেন, তখন সমস্ত জেলখানায় একসাথে অনেকটা বোমা ফেটেছে। মানে সবাই একসাথে আওয়াজ করে উঠেছে, যা অনেকটা বোমার মতো। তখন আমরা কঠিন সময় পার করছিলাম। জেলার, জেল সুপার কিছুক্ষণের মধ্যে আমার রুমে চলে এলো। তারা যখন এলো, তখন থেকে মনে হলো আমি জেলের মালিক হয়ে গেছি আর তারা আমার অধীন হয়ে গেছে। তখন আমার মনে হচ্ছিল আমি যেভাবে বলব, জেলখানা সেভাবে চলবে।
জেল ভাঙার চেষ্টা চলছিল, তখন বন্দিদের ছাড়া তিনি বের হবেন না জানিয়ে ছিলেন উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এ নেতা বলেন, তখন জেলখানায় ১০ হাজার লোক একসাথে ছিলাম। বেশিরভাগ বিএনপির নেতাকর্মী, ছাত্র-জনতা, অন্য পেশার মানুষ। সবাই অন্যায়ভাবে জেলে, কেউ এক মিনিটও থাকতে চায় না। যখন শেখ হাসিনা পালিয়েছে, তখন ওরা বলছে, ‘আমি এ মুহূর্তে বাড়ি যেতে চাই।’
আমীর খসরু বলেন, তখন জেল ব্রেকের একটা ধাক্কা চলছিল। গেট ভেঙে ফেলছে, বেরিয়ে যাচ্ছে। তখন জেল সুপার বললো, ‘স্যার, আপনার উপস্থিতিতে যদি জেল ব্রেক হয়, ইতিহাসে খারাপ নজির সৃষ্টি হবে। দয়া করে যদি এটা বন্ধ করেন। তখন আমি বললাম, আমি কীভাবে বন্ধ করব– এখানে কতগুলো বিল্ডিং! তখন তারা আমাকে একটা হ্যান্ড মাইক দিলো। বললো– স্যার, আপনি যদি বিল্ডিংয়ের সামনে গিয়ে একটু অনুরোধ করেন। আমি গেলাম, বললাম– শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে, আমরা সবাই বেরিয়ে যাব। কিন্তু আমি তোমাদের ছাড়া জেল থেকে বের হব না। এটা বলার পরে সবাই শান্ত হয়ে গেল।
জেল কিলিংয়ের মতো কিছু হয়ে যেতে পারে– এই ভয় ছিল উল্লেখ করে বিএনপির এ নেতা বলেন, তবুও একটা জায়গায় জেল ব্রেক হয়েছে। আর্মি গিয়েছে, হেলিকপ্টার গিয়েছে, গোলাগুলিও হয়েছে। আমাদের ভয় ছিল– জেল কিলিংয়ের মতো শেখ হাসিনা আমাদের আবার শেষ করে দেবে কি না। সেখান থেকে আমরা কোনোভাবে মির্জা ফখরুল ইসলামের মাধ্যমে আর্মি চিফের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তখন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে আসে।
১০ হাজার বন্দির ত্যাগ কেউ দেখেনি জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা যে রাস্তায় ১৫ বছর ধরে ত্যাগ স্বীকার করেছি, সেই পথে যারা জীবন দিয়েছে, তাদের কোনো ছবি কোথাও নেই। ১০ হাজার বন্দির মধ্যে কয়েক হাজার ডিবি অফিসে কীভাবে নির্যাতিত হয়েছে, কেউ দেখেনি। আমি দেখেছি– আমার সামনে নিয়ে গেছে। ডিবি একজনকে নিয়ে যাচ্ছে সেল থেকে– তারা হেঁটে যাচ্ছে কিন্তু কেউ হেঁটে ফিরে আসতে পারছে না। সমস্ত শরীরে অত্যাচারের দাগ, কান্না করছে।
আমীর খসরু বলেন, এই দেশের শহরে শহরে যারা মারা গেছে, অন্ধ হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে, তাদের চিত্র কোথাও নেই। ক্যামেরায় যারা এসেছে শুধু তাদের চিত্র আছে। কিন্তু লাখ লাখ জনতা যারা আসে নাই, তারাই চরমভাবে নির্যাতিত হয়েছে। তাদের ত্যাগেই আন্দোলন টিকে আছে।
বিএনপি কৃতিত্বের জন্য আন্দোলন করেনি মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিএনপি কোনো সময় এই কৃতিত্ব দাবি করেনি। আমরা কৃতিত্বের জন্য আন্দোলন করিনি। আমরা আন্দোলন করেছি দেশের মুক্তির জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, মানুষের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।
বিএনপির এ নেতা বলেন, আমরা যদি কৃতিত্ব দাবি করি, দেশ বিভক্ত হবে। কিন্তু আমরা বিভক্তি চাই না। ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার যাতে ফিরে না আসে সেজন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। এটা এক নম্বর শত্রু। এই শত্রুর দোসরদেরও চিহ্নিত করতে হবে।
নতুন রাজনীতিতে মানসিক পরিবর্তন দরকার উল্লেখ করে আমীর খসরু বলেন, মানুষ এখন ভাবছে আমার ছেলে-মেয়েকে পড়াতে পারব তো? চাকরি পাব তো? ভোট দিতে পারব তো? আইনের শাসন থাকবে তো? এই জিনিসগুলো পরিষ্কার করতে হবে। রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। রাজনীতির সংস্কৃতি বদলাতে হবে। সহনশীলতা আনতে হবে। দ্বিমত থাকলেও পরস্পরের প্রতি সম্মান রাখতে হবে।
এসময় উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান।