বিধান চন্দ্র পাল»
চারপাশের বায়ু এখন দূষিত। অনেক কারণেই দূষিত। বিভিন্ন খনিতে সৃষ্ট দূষণ, খোলা বা উন্মুক্ত স্থানে ময়লা-আবর্জনা পোড়ানো থেকে নিঃসরণ, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো, অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজের ফলে সৃষ্ট ধুলোবালি, কলকারখানা থেকে নিঃসরণ, ইটভাটা থেকে নিঃসরণ, যানবাহন থেকে নিঃসরণ প্রভৃতি কারণে বায়ু এখন দূষিত। এর সাথে পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুসারে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্ত হয়েছে আরব সাগর থেকে আসা জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু অর্থাৎ আরব অঞ্চলের মরুভূমি থেকে বয়ে আসা ক্ষতিকর এবং ব্যাপক ধূলিকণা। অন্যভাবে বলতে গেলে, উপমহাদেশীয় উচ্চ চাপবলয় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ফলে এটা সুস্পষ্ট যে, আমাদের চারদিকের বাতাস এখন দূষিত।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে হলে লেখার শুরুতে যে নিঃসরণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেসব নিঃসরণ থেকে আসলে সালফার ডাইঅক্সাইড (ঝঙ২), নাইট্রোজেন অক্সাইডস (ঘঙঢ), এমোনিয়া (ঘঐ৩) ইত্যাদি নিঃসরিত হয়ে সালফিউরিক এসিড (ঐ২ঝঙ৪) ও নাইট্রিক এসিডে (ঐঘঙ৩) রূপান্তর ঘটায়। যার ফলে দুই ধরনের সঞ্চায়ন হয় শুষ্ক (উৎু) ও আর্দ্র (ডবঃ)। এই দুই ধরনের সঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে জলজ পরিবেশ, মানবস্বাস্থ্য, উদ্ভিদ, বস্তুসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেককিছুর ওপরই নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০ জনের মধ্যে নয় জন দূষিত বাতাসে শ্বাস নেন এবং বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর প্রধানত নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু ঘটে। (সূত্র: দি ডেইলি স্টার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২১)
বর্তমানে বাংলাদেশের অধিকাংশ স্থানের বায়ুই এখন কম-বেশি দূষিত। বিশ্বের যে সকল শহর বায়ুদূষণের কবলে আছে তার মধ্যে একদম সবার ওপরে স্থান আমাদের ঢাকা শহরের। ভারতের দিল্লি সবার ওপরে, ঢাকা ঠিক তার পরেই। কোনো কোনো সময়ে ঢাকা দিল্লিকেও অতিক্রম করে ফেলে। বিশ্বের বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের পর্যবেক্ষণ অনুসারে সাম্প্রতিক সময়গুলিতে ঢাকা শহরের বায়ুমান দূষণ দিনের বেশিরভাগ সময় বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এমন তথ্যও বিভিন্ন মিডিয়ায় গুরুত্ব সহকারে উঠে এসেছে। (সূত্র: প্রথম আলো ১৭ জানুয়ারি, ২০২১)।
অন্যদিকে ‘দ্য স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার-২০১৯ শীর্ষক’ বৈশ্বিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বের যে পাঁচটি দেশের শতভাগ মানুষ দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করে, বাংলাদেশ সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। আর বায়ুদূষণের ক্ষতির প্রভাবে মৃত্যু র সংখ্যার অবস্থান থেকে বাংলাদেশ ৫ নম্বর স্থানে। প্রসঙ্গত উল্লেখ থাকা প্রয়োজন যে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ। (সূত্র: বিবিসি বাংলা ৪ এপ্রিল, ২০১৯) পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন বলছে, ঢাকা ছাড়াও গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামে বায়ুদূষণ ক্রমেই বাড়ছে (সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন ৭ ডিসেম্বর, ২০২০)। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে, শহরাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চলের বায়ুদূষণের মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে যেমন, শহরাঞ্চলের বায়ুর দূষণ উৎসগতভাবে মূলত বহিঃস্থ চরিত্রের (গাড়ির ধোঁয়া, কলকারখানার বর্জ্য ইত্যাদি) অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে এখনো গৃহাভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণ অন্যতম একটি বড় সমস্যা (যেমন: উন্মুক্ত চুলার ব্যবহার)।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), নাসা, বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন ভিন্ন গবেষণায় বাংলাদেশে বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে পরিবহন বিশেষত ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও ইটভাটাকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যানবাহন ও ইটভাটাসমূহকে পরিবেশবান্ধব করতে যে সকল উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, তা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণেই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যভাবে বলতে গেলে সেগুলোর ফলপ্রসূ বাস্তবায়ন আমরা লক্ষ্য করছি না। অথচ এগুলোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করাটা অত্যন্ত জরুরি। যেমন, পরিবহন খাতে সুনির্দিষ্টভাবে গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানোর নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে কাজ করা, ২০১৮ সালে ইট প্রস্তুত ও ভাটা নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ অনুযায়ী সবকটি ইটভাটাকে আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে রূপান্তর করা; পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুসারে ইটভাটাগুলো কৃষি জমিতে স্থাপন না করা, কৃষিজমি থেকে মাটি তুলে ইট না বানানো ইত্যাদি অন্যতম।
বিভিন্ন গবেষণার বিশ্লেষণ এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের দেয়া নির্ভরযোগ্য তথ্য অনুসারে, বাতাসে মিশ্রিত সালফার, সিসা, দস্তা ইত্যাদি ধাতুকণা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, বিশেষত শিশুদের জন্য খুবই ক্ষতিকর। বায়ুদূষণের কারণে শুধু ফুসফুস সম্পর্কিত রোগ বিস্তার লাভ করতে পারে সেটিই নয়। এর ফলে হৃদরোগ, শ্বাসকষ্টজনিত জটিল সমস্যা, স্ট্রোক ও ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশের মতো মারাত্মক রোগও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
শিশু ও গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মানসিক অবসাদ, শিশুদের মধ্যে অ্যাজমার মতো রোগ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই বায়ুদূষণের লাগাম টেনে ধরাটা এখনই জরুরি। এ লক্ষ্যেই হয়তো সরকার নির্মল বায়ু আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এছাড়া বায়ুদূষণ বন্ধে গত ২৪ নভেম্বর, ২০২০ তারিখে নয় দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। এ সকল বিষয় নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কারণ আইনের মাধ্যমে জরুরিভিত্তিতে অনেককিছুর লাগাম টানা না গেলে শ্বাসজনিত নানা রোগ, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্যান্সার ও জেনেটিক পরিবির্তনজনিত বিভিন্ন অজানা রোগ আরও বেড়ে যাবে।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাবের ফলে বছরে যত মানুষের মৃত্যু ঘটে, তার দুই তৃতীয়াংশই বায়ুদূষণের ফলে। চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চ-এ সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত আরেক গবেষণার তথ্য অনুসারে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) মোট প্রাণহানির ১৫ শতাংশের পেছনে থাকতে পারে বায়ুদূষণ। সুতরাং সার্বিক বিবেচনায় আমার ধারণা, বায়ুদূষণের কারণে মানুষের চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, অসুস্থ মানুষের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে, উৎপাদনশীলতার ওপরও গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
সুস্পষ্টভাবে বলতে গেলে, ক্রমবর্ধমান শহরমুখী জনসংখ্যার কারণে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ, নির্মাণ সামগ্রী তৈরি করা, যানবাহনের সংখ্যা ও কলকারখানা বৃদ্ধি পাওয়ায় এ সকল উৎস থেকে বায়ুদূষণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদী বায়ুদূষণ পরিবীক্ষণ থেকেও এটা এখন সুস্পষ্ট যে, বর্ষাকালসহ অন্যান্য মৌসুমে বাতাসে গ্যাসীয় পদার্থ ও বস্তুকণা সহনীয় মাত্রায় থাকলেও, শুষ্ক মৌসুমে (নভেম্বর থেকে মার্চ মাসে) বস্তুকণা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি থাকে। শীতকালে বৃষ্টিপাত কম হয় এবং বাতাসের গতিবেগ কম থাকে, ফলে তখন বায়ুদূষণের পরিমাণ স্বাভাবিকভাবেই বেশি হয়। এ সময়ে শহর এলাকার আশে-পাশে স্থাপিত ইটভাটা থেকে নিঃসরণ বায়ুদূষণ বাড়িয়ে দেয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক কর্মকা- সম্প্রসারিত হওয়ার ফলে বিভিন্ন উৎস থেকে নিঃসরণের পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অন্যদিকে অনেকগুলো কারণে আমরা নিজেরাই আসলে বায়ুদূষণ বৃদ্ধির জন্য দায়ী, যেমন, জেনারেটরের ব্যাপক ব্যবহার, নীতি অনুসরণ না করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা; সঠিকভাবে ডাস্টবিন ব্যবহার না করা, রাস্তা ও রাস্তার পাশের গাছসমূহ নিয়মিতভাবে পরিষ্কার না করা কিংবা পানি না ছিটানো, নির্মাণ কাজ চলাকালে পানি না ছিটানো, নির্মাণ সামগ্রী আচ্ছাদন দ্বারা আবৃত না করা, সারাবছর ধরে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করা ইত্যাদি। ইটভাটা ও যানবাহনের কথা আগেই বলেছি। এছাড়া যত্রতত্র ধূমপান করাও বায়ুদূষণের অন্যতম একটি কারণ।
এইসব ক্ষেত্রকে আমরা চাইলে একেবারে বাদ দিয়ে দিতে পারি, আর কোন কোন ক্ষেত্রকে পরিকল্পিতভাবে একেবারে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে নিয়ে এসে বায়ুদূষণ একেবারেই কমিয়ে ফেলতে বা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারি।
পরিবেশ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা, সিটি করপোরেশনসহ সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহের এজন্য আরও জোরালো ভূমিকা জনগণ প্রত্যাশা করে। এছাড়া সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি মিডিয়ারও এ সকল ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। জনগণকে বায়ুদূষণের সামগ্রিক বিষয়ে তথ্য দেওয়া ও সবাইকে বায়ুদূষণ বন্ধের কাজে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করে তোলাটাও অত্যন্ত জরুরি হবে।
নগরে বায়ুদূষণ কমিয়ে আনার জন্য আরও অনেককিছুই করা প্রয়োজন। তার মধ্যে অগ্রাধিকার দিয়ে যে সকল বিষয়কে বিবেচনায় রাখা যেতে পারে সেগুলি হলো: রাস্তায় মোটরচালিত যানবাহনের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা; সাইকেলসহ অযান্ত্রিক যানবাহনের ব্যবহার উৎসাহিত করতে সমন্বিত নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা; সকল অতিরিক্ত পুরাতন ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন অপসারণ করা; শিল্প, গৃহস্থালী ও চিকিৎসা বর্জ্যের পরিমাণ হ্রাস এবং এসব বর্জ্যের যথাযথ ও স্বাস্থ্যসম্মত নিক্ষেপণ ও ধ্বংস নিশ্চিত করা; নগরের ভিতরে গাছের সংখ্যা এবং জলাশয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করা, বাড়ির ছাদে বাগান তৈরিতে উৎসাহিত করা এবং জনসংখ্যার বৃদ্ধি হ্রাস করা ইত্যাদি। গ্রামাঞ্চলে গৃহের বাইরের বায়ুদূষণ বন্ধ করার জন্য গুরুত্ব দিয়ে যে সকল কর্মকা- গ্রহণ করা যেতে পারে, সেগুলি হলো: দেশের সব স্থান থেকে দুই স্ট্রোক ইঞ্জিনবিশিষ্ট যানবাহন নিষিদ্ধ করা; সব শিল্পকারখানাকে বায়ুদূষণ কমাতে ইটিপি ব্যবহার নিশ্চিত করা ইত্যাদি। এছাড়া সবচাইতে বেশি দূষণসৃষ্টিকারী ইটভাটাসমূহের বিষয়ে এই লেখায় পূর্বেই করণীয় বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে।
পরিশেষে একথা বলাই বাহুল্য যে, মানুষের অস্তিত্ব যে সকল উপাদান ছাড়া কল্পনা করা যায় না, তার মধ্যে বায়ু অন্যতম, কারণ বায়ু ছাড়া মাত্র কয়েক মিনিট পর্যন্ত হয়তো মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব, এর বেশি নয়। ফলে নির্মল বায়ু সেবন প্রতি মুহূর্তের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ফলে, জীবনধারণের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এই উপাদানকে সুরক্ষিত রাখাটা আমার, আপনার সকলেরই অন্যতম নাগরিক দায়িত্ব হোক।
লেখক : প্রাবন্ধিক