এমরান চৌধুরী »
১. বাসুদেব খাস্তগীর পেশায় শিক্ষিক নেশায় একজন নিবেদিতপ্রাণ সাহিত্যকর্মী। তিনি কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, গীতিকার সবিশেষ ছড়াকার হিসেবে সমাদৃত। ১৯৮৪ সালে কলেজে অধ্যায়নকালীন তাঁর ছড়ার জগতে অভিষেক। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পনেরো। এতে ছড়া, কিশোর কবিতা, কিশোর গল্প, স্বরলিপিসহ ছড়াগানের গ্রন্থ যেমন আছে, তেমনি আছে সম্পাদনাগ্রন্থও। তাঁর ছড়াগ্রন্থগুলো হলো: ছন্দ আনন্দে ২০১৫, ঋতুর রঙে বাংলার রূপ ২০১৬, ছড়ায় ছড়ায় হাসি, ছড়া ভালোবাসি ২০১৬, সময়ের ছড়া ২০১৮, ছড়ায় ছড়ায় সা রে গা মা ২০১৯।
এখানে যে ছড়াগ্রন্থটি নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব সেটির নাম ‘আট লাইনে ছোটোদের শত ছড়া’। বইটির প্রকাশক: আনিসুল ইসলাম সুজন, অক্ষরবৃত্ত, চট্টগ্রাম। ‘আট লাইনে ছোটোদের শত ছড়া’ নামটির মধ্যে স্পষ্ট ছড়াগুলি কাদের জন্য লেখা? বিচিত্র বিষয়বস্তু নিয়ে বরাবর ১০০ ছড়া গ্রন্থিত হয়েছে এখানে। শিশুতোষ ছড়ায় সাধারণত যে সব চিত্রকল্প থাকে এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি, তার সাথে যুক্ত হয়েছে কৌতুহলোদ্দীপক ও শিক্ষণীয় কয়েকটি ছড়া । শিশুতোষ ছড়ার চিরায়ত অনুষঙ্গের পাশাপাশি ছড়াকার নানা বিষয় নিয়ে লিখেছেন সযত্নে সাবলীলভাবে।
২.আমরা জানি, শিশুতোষ ছড়ার ভাষা হয় সহজ সরল। যুক্তাক্ষর যতটা এড়িয়ে যাওয়া যায় কিংবা কম ব্যবহার করা যায় ততই ভালো। সেদিক দিয়ে ছড়াকারকে হতে হয় সজাগ, সতর্ক ও যত্নশীল। শব্দচয়ন, বাক্যগঠনে থাকতে হয় নামতার মতো শৃঙ্খলা। সর্বোপরি প্রতি পঙক্তিমালা সাজাতে হয় এমনভাবে যাতে অনায়াসে কর্ণে ধ্বনিত হয় ঝর্ণার কল্লোল। বাসুদেব খাস্তগীরের আলোচ্যগ্রন্থের ছড়াগুলোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুতোষ ছড়ার বৈশিষ্ট্যগুলো দীপ্যমান। বৈশিষ্ট্য তথা গুণাবলির দিকে নজর রেখে তিনি এক একটি ছড়া বুনেছেন পরম মমতায়। তাঁর ভাষাশৈলী মোলায়েম, শব্দচয়ন শিশুর মতো কোমল, বাক্যগঠনে সতর্কতার সাথে পরিহার করেছেন বাড়তি মেদ। ফলে এক নিঃশ্বাসে পড়ে নেওয়া যায় এক একটি ছড়া। যেমন,
ছোট্ট দুটো ছাগল ছানা
পাগল করে বাড়ি
ছানার মুখে ঐ দেখা যায়
একটুখানি দাড়ি। (ছাগল ছানা, পৃষ্ঠা-০৭)
কিংবা
শেওড়া গাছে ভূতের বাড়ি
ভূতের মুখে ছাই
ভূত গিয়েছে নদীর কূলে
তাইরে নাইরে নাই। (ভূতের বাড়ি, পৃষ্ঠা-১০)
লক্ষ্য করুন কী চটুল গতিতে দোল খেয়ে খেয়ে পঙক্তিগুলো এগিয়ে গেছে। কোথাও এতটুকু হোঁচড় খায়নি আর শিশুকে দিয়েছে অপার আনন্দ —তাইরে নাইরে নাই।
৩. বাসুদেব খাস্তগীরের ছড়ার বিষয় ভাবনায় রয়েছে বিচিত্র অনুষঙ্গের উপস্থিতি। এ বিচিত্র অনুষঙ্গে আছে মামা, চাঁদ মামা আর প্রাণি জগতের কথিত মামাদের জয় জয়কার। সে সাথে আছে ব্যাঙ, চিল, কাক, ময়না, হুল ফোটানো মশাও। আছে বিড়াল ছানা। বাদ যায়নি চাঁদের বুড়ি আর গল্প দাদু। আরও কত কী! মিষ্টি মিষ্টি শব্দে তিনি বানিয়েছেন একটা একটা ছড়ার অবয়ব। দু’চার পঙক্তি তুলে আনছি,
পাকা ধানে হাসে মাঠ
নদী জলে হাসে
পাহাড়ের হাসি দেখো
সবুজাভ ঘাসে।
খোকনের হাসি দেখি
খেলা করা মাঠে
সবচেয়ে ভালো হাসি
বই নিলে পাঠে। (বই, পৃষ্ঠা-২১)
রংধনু-তে সাতটি রং থাকে। এই সাতটি রঙের নাম এক এক করে বলা খুব একটা সহজ নয়। নামগুলো মনে রাখার জন্য রয়েছে একটা সূত্র। সেটি নিয়ে একটি চমৎকার ছড়া লিখেছেন বাসুদেব খাস্তগীর।
মা বলেছে আকাশ নীলে
কী অপরূপ মেলা
দেখবে এসো খোকাখুকু
যায় রে বয়ে বেলা।
সাতটি রঙে সাজলে আকাশ
রংধনু হয় বলা
রংগুলোকে সংক্ষেপে কয়
‘বেনীআসহকলা’। (সাতটি রং, পৃষ্ঠা-২২)
ছোটদের ছড়ার মূল লক্ষ্য শিশুকে আনন্দ দেওয়া। তার ভেতরে, তার শিরায় উচ্ছ্বাসের স্পর্শ জাগানো। সে সাথে যদি শিক্ষার বা শেখার বিষয় কিছু থাকে তা ছড়ার বোনাস। ছড়াগুণ বজায় রেখে এই বোনাস সংযোজনে প্রয়োজন ছড়াকারের কুশলি হাত। বাসুদেব খাস্তগীর সেই কুশলী হাতের একজন চৌকস ছড়াকার।
৪. ‘আট লাইনে ছোটোদের ছড়া’ নামটি যেমন অভিনব, তেমনি অনেকগুলো ছড়ার বিষয় নির্বাচনে রয়েছে চমক ও নতুনত্বের প্রয়াস। ছোটরা তাল ভালোবাসে, দুলতে পছন্দ করে। তাই তালে তালে পঠনে বেশ মজা পায় তারা। কারণ তাল আর সুরের শব্দ সে মায়ের কোলেই পেয়েছে। বাসুদেব খাস্তগীর ছোটদের ইংরেজি ও বাংলা বর্ণ পরিচয়, বানানের রূপ ও গাণিতিক সংখ্যা নিয়ে যেসব ছড়া বানিয়েছেন তা ছোটদের পাঠে আগ্রহী করে তুলতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। শুধু বাংলা, ইংরেজি বর্ণ, গাণিতিক সংখ্যা চেনানো নয়, তিনি ব্যাকরণের কিছু কৌতুহলোদ্দীপক বিষয়, যেমন: সমার্থক শব্দ, কার এর ব্যবহার নিয়েও ছড়া সাজিয়েছেন। বাসুদেব খাস্তগীর এই জাতীয় ছড়া দ্বারা ছোটদের এক সাথে পড়া ও ছড়ার আনন্দ দিতে প্রয়াসী হয়েছেন বলা যায়। যেমন,
ছড়া মানে নেত্র, নয়ন
বলতে পারো আঁখি
বিহঙ্গ আর পক্ষী একই
কিংবা খেচর পাখি।
স্যার বলেছে আমার ক্লাসে
‘বুঝে নিও তমা
সমার্থক কয় শব্দ এমন
আঁধার মানে অমা।’
(সমার্থক শব্দ, পৃষ্ঠা-২৭)। তেমনি,
দিবস মানে দিন
ভিতর মানে ওঘ
হনন মানে লুঠ
পাট মানে ঔটঞঊ.
পশ্চাৎ মানে পিঠ
বাচ্চা মানে কওউ
বক্র মানে বাঁক
ভাগ্য মানে খটঈক. (পৃষ্ঠা-২৯)
৫. বাসুদেব খাস্তগীর এর ছড়া ও তাঁর লেখালেখি সম্পর্কে ছড়াসম্রাট সুকুমার বড়ুয়ার এক নাতিদীর্ঘ ভূমিকা স্থান পেয়েছে আলোচ্য গ্রন্থটিতে। তিনি বলেছেন, ‘বাসুদেব খাস্তগীর লেখালেখির জগতে পরিচিত এক নাম। মেধায়-মননে বিভিন্নমুখী লেখালেখিতে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি।…বাসুদেব খাস্তগীরের আট লাইনে ‘ছোটদের শত ছড়া’ বইয়ের ছড়াগুলো বেশ প্রাণবন্ত…। ছড়াগুলোতে সহজ সরল ভাষায় শিশুমনস্ক শিক্ষণীয় অনেক বিষয় তুলে ধরার চমৎকার প্রয়াস আছে।’ ছড়াসম্রাটের এই উচ্ছ্বাসের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে পারি বাসুদেব খাস্তগীর নিঃসন্দেহে একজন শক্তিমান ছড়াকার। সীমিত পঙক্তিমালায় ছড়া লিখতে তিনি কোথাও এতটুকু থমকে পড়েছেন বলে মনে হয়নি। তাঁর ছন্দজ্ঞান এতই টনটনে যে কোনো পর্বে মাত্রাগত কারণে শৈথিল্য পরিলক্ষিত হয়নি। সাবলীল অন্ত্যমিল, যুৎসই অনুপ্রাসে তাঁর দক্ষতা দেখার বিষয়। বাংলা শব্দের সাথে ইংরেজি শব্দের অন্ত্যমিলে (হক/ফড়ম, বীজ/ ঃবধপয, নাচ/ ঁং, তোয়াজ/ ধিঃপয) এরকম দু’একটা জায়গায় কারো কারো খটকা লাগতে পারে।