-
বিভিন্ন খালে নির্মিত হচ্ছে ২৭ সিল্ট ট্রেপ #
ভূঁইয়া নজরুল »
জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে বালি বিক্রি করে বছরে আয় হতে পারে ৭৪৮ কোটি টাকা। বৃষ্টির পানির সাথে পাহাড় থেকে নেমে আসা বালিকে যান্ত্রিকভাবে সংগ্রহ করে প্রতিবছর এই অর্থ আয় করা যেতে পারে। প্রকল্পের আওতায় নতুন করে নির্মাণ হতে যাওয়া সিল্ট ট্রেপগুলোতে (বালি জমার স্থান) সেভাবেই ডিজাইন করা হয়েছে। তবে সিল্ট ট্রেপ আগেও ছিল, সেসব সিল্ট ট্রেপ থেকে বালি উত্তোলন প্রক্রিয়া সঠিক ছিল না।
জানা গেছে, নগরীর চশমা পাহাড় খালে ষোলশহর শপিং কমপ্লেক্সের বিপরীত পাশে খালটি অনেক চওড়া। এই চওড়া জায়গাটি ছিল একটি সিল্ট ট্রেপ। পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি এখানকার চওড়া জায়গায় এলে স্রোত কমে যাবে এবং বালি জমে পানি সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে থাকে। এভাবে নগরীর বিভিন্ন খালে এধরনের অনেক সিল্ট ট্রেপ রয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় এধরনের আরো ৪২টি সিল্ট ট্রেপ করার প্রস্তাবনা ছিল। কিন্তু সেনাবাহিনীর অধীনে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার পর সিল্ট ট্রেপের সংখ্যা ও নকশায় পরিবর্তন আনা হয়েছে।
সিল্ট টেপের সংখ্যা ও নকশায় পরিবর্তন আনার কথা স্বীকার করে জলাবদ্ধতা নিরসন মেগা প্রকল্পে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রকল্প পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ মাঈনুদ্দিন বলেন, ‘আগের ডিপিপিতে প্রাকৃতিক সিল্ট ট্রেপ নির্মাণের কথা বলেছিলাম। কিন্তু প্রাকৃতিক সিল্ট ট্রেপ নির্মাণে অনেক বেশি (প্রতিটিতে প্রায় দুই একর) জায়গার প্রয়োজন হয়। এখন সেনাবাহিনী ডিজাইন করার সময় যান্ত্রিক সিল্ট ট্রেপ করছে এবং এতে জায়গা কম (প্রতিটিতে আধা একর) লাগবে এবং বালি উত্তোলনও সহজ হবে।’
এবিষয়ে জানতে চাইলে সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল মো. শাহ্ আলী বলেন, ‘পূর্বের ডিপিপিতে ৪২টি সিল্ট ট্রেপ ছিল। কিন্তু এতোগুলো সিল্টট্রেপ নির্মাণের জন্য মাঠ পর্যায়ে পর্যাপ্ত জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনে যান্ত্রিক সিল্ট ট্রেপ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। এতে জায়গাও কম লাগবে এবং বালি উত্তোলনও সহজ হবে।
সিল্ট ট্রেপ কি?
সিল্ট ট্রেপ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশ চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, সিল্ট ট্রেপ হলো পাহাড়ি এলাকা থেকে আসা বালিগুলোকে আটকানোর একটি মাধ্যম। এজন্য পানি প্রবাহের পথ হঠাৎ করে চওড়া করে দেয়া হলে স্বাভাবিক নিয়মে বালিগুলো জমা হয় এবং পানির সাথে থাকা কাদা ও ময়লাগুলো সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে চলে যায়।
তিনি আরো বলেন, এই বালিগুলো সংগ্রহ করে বিক্রি করা যায়। এজন্য বালি যেখানে জমা হবে সেখানে গাড়ি যাতায়াতের পথ থাকতে হবে। পূর্বেকার সময়ে নির্মিত সিল্ট ট্রেপগুলোতে গাড়ি যাতায়াতের পথ না থাকায় সিল্ট ট্রেপগুলো থেকে বালি উত্তোলন করা যায়নি।
সিল্ট ট্রেপ প্রসঙ্গে সিডিএ’র প্রকল্প পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ মাঈনুদ্দিন বলেন, ‘প্রাকৃতিক সিল্ট ট্রেপগুলোতে উজান থেকে আসা পানির স্রোত হঠাৎ করে কমে যায় এবং সেখানে বালি জমা হয়। তবে যান্ত্রিক সিল্ট ট্রেপে ধাপে ধাপে পানির স্রোত কমিয়ে একটি নির্ধারিত স্থানে বালিগুলো জমা করা হয়। এজন্য খালের পানির প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে যেতে হয়।’
এবিষয়ে সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল মো. শাহ আলী বলেন, ‘যান্ত্রিক সিল্ট ট্রেপ পদ্ধতি একটু ব্যয়বহুল। কিন্তু তারপরও এতে জায়গা কম লাগে এবং বালি সংগ্রহ পদ্ধতি অনেক আধুনিক। এই পদ্ধতিতে পানির প্রবাহকে কমিয়ে বালিকে সংগ্রহ করা হয় এবং পানির সাথে থাকা ময়লা ও মাটিগুলো সামনে অগ্রসর হয়ে চলে যাবে। আর এসব বালি সংগ্রহ করে প্রচুর টাকা আয়ও করা যাবে।’
প্রতি বর্ষায় আয় হবে ৭৪৮ কোটি টাকা!
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিটিউশন অব বাংলাদেশ চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, সিল্ট ট্রেপগুলো যদি সঠিক ডিজাইন এবং পরিকল্পনায় নির্মিত হয় তাহলে এগুলো থেকে অর্থ আয় করা সম্ভব। সিটি করপোরেশন টাকা খরচ করে আর খাল থেকে বালি উত্তোলন করতে হবে না। ঠিকাদারগণ সিল্ট ট্রেপ ইজারা নিয়ে নিজেরাই বালি উত্তোলন করবে। এতে নগরীর নালা ও খালগুলো যেমন দ্রুত ভরাট হবে না তেমনিভাবে খাল থেকে বালি উত্তোলন করে অর্থও আয় করা সম্ভব।
জানা যায়, একেকটি সিল্ট ট্রেপের দৈর্ঘ্য ৬০ মিটার, প্রস্থ ২৫ মিটার এবং গভীরতা ১০ ফুট (প্রায় ৩ মিটার)। সেহিসেবে প্রতিটি সিল্ট ট্রেপের আয়তন ৪৫০০ ঘনমিটার (১ লাখ ৫৮ হাজার ৮৯৫ বর্গফুট)। বর্তমানে বাজারে প্রতি বর্গফুট বালির দাম ৮ টাকা ৫০ পয়সা। সেহিসেবে একটি সিল্ট ট্রেপ থেকে একদফায় পাওয়া যাবে ১৩ লাখ ৫০ হাজার ৬০৭ টাকা। তাহলে ২৭টি সিল্ট ট্রেপ থেকে একদফায় পাওয়া যাবে ৩৭ কোটি ৪১ লাখ ১৮ হাজার ২৭৭ টাকার বালি।
এ বিষয়ে সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল মো. শাহ্ আলী বলেন, ‘দুই দিনের বৃষ্টিতে একটি সিল্ট ট্রেপ ভরে যাবে। বর্ষা মৌসুমে যদি ৪০দিন বৃষ্টি হয় তাহলে ২০ দফা ভরাট হবে এসব সিল্ট ট্রেপ। সে হিসেবে প্রতি বর্ষা মৌসুম শেষে আয় হবে ৭৪৮ কোটি ২৩ লাখ ৬৫ হাজার ৫৫০ টাকা।’
তিনি আরো বলেন, ‘বালি বিক্রির অর্থ দিয়ে পুরো প্রকল্প মেইনটেনেন্স করা যাবে। তবে এজন্য বর্ষা এলে বৃষ্টির পরপরই বালি উত্তোলন করতে হবে।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেসব খালে উজান থেকে পাহাড়ি বালি নেমে আসে সেসব প্রতিটি খালে আমরা দুটি করে সিল্ট ট্রেপ নির্মাণ করছি। সিডিএ আগের ডিপিপিতে পুরো নগর জুড়ে ৪২টি সিল্ট ট্রেপ করার কথা বলেছিল। শুধুমাত্র বালি বহন করে এমন খালগুলোতে সিল্ট ট্রেপ তৈরি করছি।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত পাহাড় কাটা হয়। চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোও বালি মাটির পাহাড়। বৃষ্টিতে এসব পাহাড় থেকে বালি নেমে এসে নগরীর নালা ও খালগুলো ভরাট হয়ে যায়। আর ভরাটের পরপরই নালা ও খাল উপচে পানি রাস্তা দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে পুরো নগরী জলাবদ্ধতার শিকার হয়। একইসাথে নালা ও খালের মাটি উত্তোলনেও সিটি করপোরেশনের প্রচুর অর্থ খরচ হয়ে থাকে। জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ২০১৭ সালে ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকায় জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পটি অনুমোদনের পর গত জুনে এর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। বর্তমানে সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) আকারে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এতে জুন ২০২৩ সালের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।