বাবা কি ফিরবেন?

অরূপ পালিত »

নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে পুরো অডিটোরিয়ামে। ছাত্র-ছাত্রীরা আগ্রহ করে বসে আছে। এই গ্রামে এমন গুণীজনের আগমন আগে হয়নি। উপস্থাপকের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আগে মাইক্রোফোনটি হাতে নিয়ে বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘আমি আপনাদের মতো এই স্কুলের ছাত্র। আবার আমি প্রথম বেঞ্চের না, শেষ বেঞ্চের ছাত্র ছিলাম। এ কথা বলার মানে, শেষ বেঞ্চে বসেও কিছু করা যায়।’
‘আমি আমার প্রিয় সন্তানদের একটি গল্প শোনাব’ বলে তিনি শুরু করলেন-
‘এইটি একটি ঐতিহাসিক গ্রাম। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা মাষ্টারদা সূর্য সেনের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই গ্রাম।
ধলঘাটে জন্মগ্রহণ করেছেন বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। তিনি ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নারীমুক্তিযোদ্ধা এবং প্রথম বিপ্লবী শহীদ।
অগ্নিযুগের চট্টগ্রামের নারীদের কথা বলতে গেলে আরেকটি নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়, তিনি হলেন সাবিত্রী দেবী। এই ধলঘাট গ্রামের তাঁর বাড়িটি ছিল বিপ্লবীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এই দরিদ্র বিধবা তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে বাস করতেন। যখন সূর্য সেনের মাথার দাম ১০,০০০ টাকা ধার্য করেছিল ব্রিটিশরা তখনো তিনি পরম মমতায় সূর্য সেনকে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন। সূর্য সেনসহ অন্যান্য বিপ্লবীদের আশ্রয় দেবার অপরাধে তাঁকে এবং তাঁর পুত্র কন্যাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর মেয়ে স্বামীর প্রলোভনে রাজসাক্ষী হয়ে বেঁচে গেলেও সাবিত্রী দেবী এবং তাঁর পুত্র রামকৃষ্ণের জেল হয়। জেলে যক্ষাক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যায় প্ত্রু। তবুও এই মাকে দমানো যায়নি। আমৃত্যু তিনি সূর্য সেনের আদর্শকে ধারণ করে কাটিয়ে দিয়েছেন। মৃত্যুর আগে তিনি বিপ্লবীদের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন তাঁরা যেন তাঁর পুত্র হত্যার প্রতিশোধ নেন। এই গ্রামটিতে আরো অনেক গুণীজনের জন্ম। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের শ্রেষ্টতম অধ্যায় হলো ভাষা আন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্মলাভ হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।’
বিজ্ঞানী রুমাল বের করে চোখ দুটো মুছে নিয়ে আবার শুরু করলেন।
‘আজকে আমি যা বলছি নিজের দেখা এবং আমার জীবনের গল্প থেকে বলছি।
ধলঘাট রেলস্টেশনের পাশের গ্রাম বাগদন্ডী। রাস্তার পাশে একটি প্রাইমারি স্কুল। স্কুলে বসে থাকতেন এক পাগলী মা। সে মায়ের এক ছেলে ছিল। ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে রাস্তার একধারে পড়ে থাকতেন। খাবার-দাবার কেউ দিলে নিজে না খেয়ে ছেলেটার জন্য রেখে দিতেন। ছেলে খাবে বলে।
উনি সবসময় সন্ধ্যা হলেই স্টেশনে চলে যেতেন। ট্রেন চলে যাবার পর আবার চোখ মুছতে-মুছতে স্কুলে চলে আসতেন।
পাগলীর ছেলের নাম নিতাই। গ্রামের সবাই নিতাইকে ভালোবাসেন। সে যে একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান তা সে নিজেও জানতো না। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে সে কিছু পায়নি। ছোট ছিল বলে নিতাইরও বিশ্বাস ছিল তার বাবা একদিন তাদের কাছে ফিরে আসবেন।
এইভাবেই কয়েক বছর পেরিয়ে যায়।
একটুখানি বুঝতে পারে বাবা আর আসবে না। হঠাৎ করে একদিন কেঁদে ওঠে। বাবা তুমি কোথায় চলে গেলে। এখনো সন্ধ্যা নেমে আসলে আমি রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকি। তুমি আসবে বলে।
অনেক বছর পেরিয়ে গেছে, আদৌও কি আসবে?
নিতাইয়ের বাবা ছিলেন রেলওয়ের উচ্ছপদস্থ সরকারি কর্মচারী। কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে যাবার সময় ওনাকে কে বা কারা তুলে নিয়ে যায়।
যুদ্ধ চলাকালে নিতাইর মা প্রতিনিয়ত দুই ছেলেকে নিয়ে অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে গিয়ে কত কান্নাকাটি করেছেন স্বামীর খোঁজে। কিন্তু সব আশা-প্রত্যাশা মিথ্যায় পর্যবসিত হলো।
স্টেশন মাস্টারের কাছে প্রতিনিয়ত খোঁজখবর নিতো স্বামী এসেছেন কিনা।
নিতাইর মা শহর থেকে, দুই ছেলেকে নিয়ে ধলঘাটের বাগদন্ডী গ্রামে চলে আসেন।
হঠাৎ করে নিতাইয়ের ছোট ভাইটা পানিতে পড়ে মারা যায়। মারা যাবার পর নিতাইয়ের মা পাগল হয়ে যায়।
আপনাদের এতক্ষণ যা বলেছি তা আমার গল্প বলেছি।
আমি রেলস্টেশনে হাত পেতে ভিক্ষা করতাম। মাকে ভালো করার অনেক চেষ্টা করলাম। কিন্তু শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বিধাতা সেই সুযোগ আমাকে দিলেন না।
আজকে আমি এতটুকু এসে পৌঁছালাম। আমার আরেক নতুন মা-বাবার জন্য। ওনাদের কোন সন্তান ছিল না। স্টেশন থেকে আমাকে ও আমার মাকে নিয়ে যায়।
আমাকে স্নেহ মমতা দিয়ে লালন-পালন করেছেন। সৃষ্টিকর্তা আমার যদি পুনর্জন্ম রাখেন, আমাকে যেন আবার ওনার সন্তান হিসেবে পাঠায়।
আমার মা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শুধুমাত্র একটা কথা বলে গেছেন। “বাবারে স্টেশনে গিয়েছিলি?
দেখলি মানুষটার কোনো কান্ডজ্ঞান নেই। আজও আসেনি।”
মাকে সান্তনা দেবার জন্যই, মায়ের আদেশ মেনে বুকে পাথর চেপে বাবার খোঁজে স্টেশনে যেতাম।
জানতাম বাবা আর আসবে না। প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে আমার মায়ের জীবন শেষ সীমানায় গিয়ে ঠেকে।
এখন আমার ছেলে-মেয়েও বড় হয়ে গেছে। কিন্তু আমার বাবাতো ফেরেননি।