বাবার সাইকেল

বিচিত্র কুমার »

রাহুলের বয়স দশ। সে থাকে বাংলাদেশের এক ছোট্ট গ্রামে যেখানে কাঁচা রাস্তা, ধানখেত, পুকুর আর পাখির ডাকেই কাটে সকাল-বিকেল। গ্রামে একটা মাত্র স্কুল, আর সেই স্কুলের একজন শিক্ষক হলো রাহুলের বাবা।
রোজ সকালে বাবা তার পুরোনো লাল রঙের সাইকেলটা নিয়ে স্কুলে যান। সাইকেলটা অনেক পুরোনো। চাকা একদিকে হেলে পড়ে, প্যাডেলে একটু খসখস শব্দ হয়, আর ঘণ্টার টিনটিন শব্দটা পুরো গাঁয়ের চেনা।
রাহুল সেই সাইকেলটার বড় ভক্ত।
যখনই বাবা স্কুল থেকে ফিরতে থাকেন, রাহুল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। দূর থেকে বাবার সাইকেলের ঘণ্টা শোনা গেলেই দৌড়ে চিৎকার করে ওঠে,
“মা! বাবা আসছে!”
বাবার হাতে তখন কখনো থাকে বাতাবি লেবু, কখনো গুঁড়-মুড়ি, কখনো আবার এক কিছু মোয়া।
সেই সাইকেলেই কত স্মৃতি!
একবার সাইকেলের পেছনে বসে রাহুল প্রথমবার মেলার মাঠে গিয়েছিল। সেই গল্প সে আজও ভুলতে পারেনি।
একদিন সকালে হঠাৎ রিমঝিম বৃষ্টি শুরু হলো। মেঠো রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে পড়েছিল।
বাবা একটু তাড়াহুড়ো করে সাইকেলে উঠতেই এক জায়গায় পিছলে গিয়ে পড়ে গেলেন। রাহুল দৌড়ে গিয়ে দেখে, বাবার হাঁটুতে আঘাত লেগেছে আর সাইকেলের সামনের চাকাটা একেবারে বেঁকে গেছে।
বাবা কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“সাইকেলটা বুঝি এবার আর চলবে না রে…”
রাহুলের বুকটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। সাইকেলটা তো বাবারই নয়, তারও যেন খুব আপন।
সেদিন বিকেলে রাহুল চুপিচুপি নিজের সঞ্চয় বাক্স খুলল। তাতে কিছু টাকাপয়সা জমিয়েছিল, পুরোনো পাঁচ টাকার কয়েন, দশ টাকার নোট মিলিয়ে মোটে ৭৮ টাকা।
সে সিদ্ধান্ত নিল, যেভাবেই হোক, বাবার সাইকেলটা ঠিক করাবে।
পরদিন সকালে, স্কুল ছুটির দিন ছিল। মা ঘরের কাজে ব্যস্ত। রাহুল লাল সাইকেলটা ঠেলে ঠেলে নিয়ে গেল বাজারের মাথায়, কালু কাকার সাইকেল গ্যারেজে।
কালু কাকা অবাক হয়ে বললেন,
“রে রাহুল, একা একা এই সাইকেল এনেছিস?”
রাহুল চোখ নামিয়ে বলল,
“বাবার সাইকেল ভেঙে গেছে। এটা ঠিক করে দেবে কাকা? আমার কাছে কিছু টাকা আছে…”
সে কৌটাটা বাড়িয়ে দিল।
কালু কাকা টাকা দেখে মৃদু হেসে বললেন,
“এইটুকু টাকায় কাজ হয় না রে, তবে তোর মনটা অনেক বড়। তোর বাবার সাইকেল আমি নিজের হাতে ঠিক করে দেব।”
সেদিন বিকেলেই সাইকেলটা হয়ে উঠল নতুনের মতো । চাকা ঘুরছে ঠিকঠাক, প্যাডেলের শব্দ নেই, আর লাগানো হলো একটা নতুন ঝকঝকে ঘণ্টা।
রাহুল নিজেই সাইকেলটা ঠেলে বাড়ি আনল।
সন্ধ্যায় বাবা বাড়ি ফিরে দরজার সামনে নতুন হয়ে ওঠা সাইকেলটা দেখে থমকে দাঁড়ালেন।
রাহুল ছোট্ট গলায় বলল,
“বাবা, এটা এখন আবার তোমার ‘স্কুল যাওয়ার বন্ধু’। আমি আর কালু কাকা মিলে ঠিক করিয়েছি।”
বাবার চোখে জল চলে এল। তিনি রাহুলকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“তুই যে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া রে।”
সেই রাতেই বাবা রাহুলকে পেছনে বসিয়ে সাইকেলে করে বাজারে নিয়ে গেলেন।
তাকে কিনে দিলেন একটা বড় বাতাবি লেবু আর একটা চকোলেট।
সাইকেলের নতুন ঘণ্টা বাজতে লাগল টিং টিং! যেন গাঁয়ের বাতাসেও শোনা গেল,
“ভালোবাসা মানেই তো এমন নির্বাক, নিঃস্বার্থ, সত্যি!”