শঙ্কর প্রসাদ দে »
অর্থমন্ত্রীর এবারের বাজেটে বৈচিত্র্য আশা করা হয়েছিল। অথচ করিৎকর্মা এই মানুষটি গতানুগতিকতার বাইরে যেতে পারেননি। টিআইবি আশা করেছিল কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ করা হবে। এখন তারা মনক্ষুণœ হয়ে অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা করছেন। আমি বরং অর্থমন্ত্রীর পক্ষে, কালোটাকা শুধু দুর্নীতি করলে হয় না। এর উৎপত্তি শুধু চোরাকারবারে হয় তাও নয়। রপ্তানি ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং করে কালোটাকা হয় তাও পুরোপুরি সত্য নয়। এই তিনটি উৎস ছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে যে সম্পদ প্রবাহ, লেনদেন, পণ্য বাজারজাতকরণে সরকারের কর ও ভ্যাট আহরণে অদক্ষতা কালোটাকার উৎপত্তির অন্যতম কারণ। ধরুন কোন ব্যক্তির ৪টি ব্রিক ফিল্ড আছে। উনি ২০ লক্ষ টাকা ভ্যাটের পরিবর্তে দিলেন মাত্র ৫ লক্ষ টাকা। বাকি ১৫ লক্ষ টাকা কালো হয়ে গেল। ধারণা করা হয় অর্থনীতিতে এক চতুর্থাংশ কালোটাকার উপস্থিতি। এই টাকা সবসময় অর্থনীতির ক্ষতি করে তাও নয়। যেমন ধরুন অপ্রদর্শিত টাকা দিয়ে কেউ যদি এক বা একাধিক ফ্ল্যাট ক্রয় করেন তবে এর ফলাফল হবে ইট উৎপাদন, বালি ব্যবসা, সিমেন্ট উৎপাদন, দক্ষ অদক্ষ শ্রমিকসহ অনেকের আয় রোজগারের ওপর ভাল প্রভাব পড়া ও অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়া।
তবে কোভিডÑ১৯ ব্যবস্থাপনা নিয়ে পরিষ্কার কোন পরিকল্পনা পাওয়া গেল না। গত অর্থবছরে ১০ হাজার কোটি টাকার থেকে বরাদ্দ পুরোটা ব্যবহার হয়নি। এবারও ১০ হাজার কোটি টাকাই বরাদ্দ। প্রশ্নটা টাকার নয়। কোভিড স্বাস্থ্যখাতের যে সব দুর্বলতাগুলো পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েছিল, সেগুলোর মেরামত এবং ভবিষ্যৎ প্রয়োজন বিবেচনায় রেখে সুনির্দিষ্ট কি কি করা হবে এবং তার জন্য টাকার বরাদ্দ না রাখা প্রমাণ করে স্বাস্থ্যখাতের পরিপূর্ণ মূল্যায়ন হয়নি। উদাহরণ দিয়ে বলি, প্রত্যেক উপজেলায় অন্তত ১০টি করে আইসিইউ স্থাপন করার সামর্থ আমাদের আছে। সে জন্য যদি আরো ৫ হাজার কোটি বরাদ্দ রাখা হতো গোটা জাতি এতে খুশি হতো। এজন্য বলছিলাম, অর্থমন্ত্রী বাজেট প্রণয়নে আমলাতান্ত্রিকতা ও গতানুগতিকতার আশ্রয় নিয়েছেন, খুব বেশি হোমওয়ার্ক করেননি। কোভিডের কারণে দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। কোভিড ক্রাইসিস থেকে বাংলাদেশসহ গোটা পৃথিবী সহসাই মুক্তি পাবে মনে হচ্ছে না। প্রচলিত শিক্ষা কাঠামো ঠিক রেখে শিক্ষক ও ছাত্রদের বাড়িতে বসে পাঠ্যক্রম শেষ করার কোন বিকল্প এখন আর অবশিষ্ট নেই। নিঃসন্দেহে এটি একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। এই উদ্যোগে অন্তত ৫০ লক্ষ ছাত্রছাত্রীকে এনড্রয়েড মোবাইল সরবরাহ করতে হবে। প্রশ্ন হলো এই টাকা খরচ করার সামর্থ কি আমাদের নেই। অবশ্যই আছে এবং বাকি থাকে শিক্ষকদের ডিজিটালাইজড করা। সেটি বড় কোন কাজ নয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য শিক্ষাখাতে ডিজিটালাইজড প্রকল্প নেয়া উচিত ছিল এবং এজন্য বড় একটা বরাদ্দ রাখা দরকার ছিল। প্রয়োজনে প্রতিরক্ষাখাতে কিছু ব্যয় কমিয়ে এই বরাদ্দ মঞ্জুর করলে জাতি উপকৃত হতো। কোভিড পরিস্থিতির উন্নতি হলে শিশুÑকিশোর স্কুল কলেজে যাবেÑ ভাগ্যের ওপর এমন ভরসা রেখে শিক্ষাখাতের বাজেট বরাদ্দ যথাযথ হয়নি বলেই মনে হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে এর খেসারত দিতে হবে কড়া গ-ায়।
কৃষিতে ২০০৯ সালের গৃহিত পদক্ষেপগুলো নড়চড় হয়নি। খাদ্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম, মাছ, সবজির দাম গত কয়েক বছর ধরে স্থিতিশীল থাকার প্রধান কারণই হলো নীতিগত অবস্থান অব্যাহত রাখা। অর্থমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর গৃহিত বরাদ্দ নীতি অক্ষুণœ রেখে ভালই করেছেন। এখন মাছ আর মুরগিওয়ালা পাড়ায় পাড়ায় এসে হাজির হয় সকাল বেলা। কৃষির এই সাফল্য অব্যাহত রাখার বিকল্প নেই।
কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে অন্য জায়গায়। কৃষকের হাতে কিছু টাকা সঞ্চয় হয়। সরকার সেগুলোর কোন নিরাপত্তা তো দিলই না উল্টো ব্যাংক এবং ডাকঘরে টাকা রাখা আরো কঠোর করে কঠিন অবস্থার সৃষ্টি করেছে। সঞ্চয়পত্রের কথা আমি বাদ দিচ্ছি। কারণ গ্রামের মানুষ এখনো সঞ্চয়পত্র কি জিনিস বুঝে না। সে বুঝে ডাকঘর, ব্যাংক, রিকসা, অটোতে বিনিয়োগ। বুর্জোয়া রাষ্ট্র কাঠামোর এক মর্মান্তিক নীতিগত সমস্যা। কৃষক নিজে বা তার প্রবাসী সন্তান কিছু টাকা জমিয়ে অটো কিনল। বছর ঘুরতে দেখা গেল টাকা গেছে, অটোও গেছে। সব খেয়ে ফেলেছে ড্রাইভার, গ্যারেজ ওয়ালা বা পুলিশ। ব্যাংকে টাকা রাখলো সুদ পায় ৪ বা ৫ শতাংশ। অথচ মুদ্রাস্ফীতি ৬শতাংশের মতো। অর্থাৎ কষ্টার্জিত ১০০ টাকা ব্যাংকে রাখলে বছর শেষে সে টাকার মূল হয়ে যাবে ৯৮ টাকা। ডাকঘরের সুদ নির্ধারণ করেছেন ৭ শতাংশ। কিন্তু সিলিং দিয়েছেন ১০ লাখ। অর্থমন্ত্রী এই পলিসির সোজা অর্থ দাঁড়ায় ১০ লাখ টাকার বেশি যা আছে তা খেয়ে ফেল অথবা গরিবের কাছে সুদে খাটাও অথবা শেয়ারবাজারে খাটাও। দেখবেন কিছুদিন শেয়ারবাজারের ব্রোকার হাউসগুলোকে বাজারে বাজারে অফিস খুলতে বলবে। এর সোজা অর্থ হলো গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোর আশেপাশে একদল টাউট বাটপার দেখিয়ে দেয়া। আজকের বিশাল রিজার্ভের কৃতিত্ব কৃষক শ্রমিকের প্রবাসী ছেলে অথবা গার্মেন্টসে খেটে খাওয়া মেয়েগুলো অথবা কৃষক নিজে। রপ্তানি পণ্যে এখন কৃষিপণ্যের অবস্থান ঈর্ষণীয়। আর শহরে শিক্ষিতরা নানা ফন্দিফিকিরে গ্রামীণ মানুষের সঞ্চিত টাকাগুলো নিয়ে দিবারাত্র ছিনিমিনি খেলছে। কৃষকের উদ্বৃত্ত অর্থকে এভাবে অবহেলা করা ঠিক হয়নি।
অর্থমন্ত্রীর বিগত সময়ে একটি সিদ্ধান্ত বাহাবা পাবার যোগ্য। প্রবাসীদের বলা হয়েছে, ব্যাংকিং চ্যানেলে ১০০ টাকা পাঠালে ২.৫ টাকা করে প্রণোদনা দেয়া হবে। রেমিট্যান্স প্রণোদনা যাদুর মতো কাজ করছে। হুন্ডি জাতীয় কাজ কারবার এখন কমে এসেছে। ঈর্ষণীয় রিজার্ভের এটিই মূল কারণ।
এরপরও বলবো মন্দের চেয়ে বাজেটে ভালোর দিক বেশি। কিন্তু বেশি পীড়া দিয়েছে টীকা ক্রয়, উৎপাদন, গণহারে ভ্যাকসিনেশন নিয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা অভাব। এখন নির্ভর করতে হবে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের ওপর। তৎক্ষণাৎতো ইচ্ছে করলে সবকিছু করা যেতো। বাজেটের প্রয়োজন হয় পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হওয়ার জন্য। বহু পোড়খাওয়া মানুষ হিসেবে অর্থমন্ত্রীর সুনাম আছে। দেখা যাক কোভিড বিক্ষুব্ধ ২০২১-২০২২ অর্থবছরে তিনি কতটুকু দক্ষতার পরিচয় দেন।
লেখক : অর্থশাস্ত্রের প্রাক্তন প্রভাষক
ও আইনজীবী