সুপ্রভাত ডেস্ক
মহামারির ধাক্কা সামলে অর্থনীতিকে উন্নয়নের হারানো গতিতে ফেরানোর বাজেট দিতে এসে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বললেন ছয়টি চ্যালেঞ্জের কথা।
এসব চ্যালঞ্জ মোকাবিলায় ‘অত্যন্ত কৌশলী’ হতে হবে মন্তব্য করে তিনি বললেন, সঠিকভাবে সমাধান না করা গেলে তা সামষ্টিক অর্থনীতির ‘স্থিতিশীলতা বিনষ্ট’ করতে পারে। খবর বিডিনিউজের।
২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা খরচ করার একটি পরিকল্পনা তিনি বাজেটে দিয়েছেন যার ৩৮ শতাংশ তাকে যোগাতে হবে ঋণ করে। তার বাজেটের শিরোনাম, ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’।
সরকারের নেওয়া নানা উদ্যোগে মহামারীর আগে বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন গতিতে পৌঁছেছিল, সবিস্তারে তার বিবরণ দিয়ে মুস্তফা কামাল তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘বিগত দুই বছরের অপ্রত্যাশিত অভিঘাত কোভিড-১৯ এর প্রভাব কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল ঠিক তখনই মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত।’
তিনি জানান, কোভিড মোকাবিলা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে গত দুই অর্থবছরে নেওয়া উদ্যোগগুলো সরকার আগামী অর্থবছরেও অব্যাহত রাখবে। তবে, সংকটের প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হওয়ার সাথে সাথে অগ্রাধিকারও কিছুটা পরিবর্তন হবে।
‘অতিমারির তৃতীয় বছরে এসে আমাদের অগ্রাধিকার হবে আয়বর্ধন ও কর্মসৃজনের ধারা অব্যাহত রেখে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে টেকসই করা ও এর মাধ্যমে অর্থনীতির ভিত্তিকে একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়া। এজন্য আমরা প্রণোদনা কার্যক্রমগুলোর বাস্তবায়ন আগামী অর্থবছরে অব্যাহত রাখবো।’
‘পাশাপাশি, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিল্প ও সেবা খাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ অর্থনীতির সকল গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর যাতে অতিমারির প্রভাব সম্পূর্ণরূপে কাটিয়ে উঠতে পারে সে লক্ষ্যে সব ধরনের নীতি-সহায়তা প্রদান করব। আমি আপনার (স্পিকার) মাধ্যমে জাতির কাছে এ আশাবাদ ব্যক্ত করতে চাই যে, আগামী অর্থবছরই হবে অতিমারির প্রভাব কাটিয়ে ওঠার জন্য আমাদের শেষ বছর।’
এই আশাবাদের মধ্যেই বাস্তবতা মনে করিয়ে দিয়ে সতর্কবার্তা এসেছে অর্থমন্ত্রীর কথায়।
‘সম্প্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়ে ব্যারেল প্রতি ১১৩ মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। অপরদিকে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য বিশ্ববাজারে অন্তত ১২ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তেল-গ্যাসের পাশাপাশি বৈশ্বিক কমোডিটি মার্কেটের কয়েকটি পণ্যের ক্ষেত্রে (যেমন গম, ভুট্টা, সানফ্লাওয়ার অয়েল ও রেয়ার আর্থ খনিজ) রাশিয়া ও ইউক্রেন গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী দেশ। ফলে, আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যেরও মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে।’
‘পশ্চিমা দেশগুলো কর্তৃক আন্তর্জাতিক পেমেন্ট নেটওয়ার্ক সুইফট হতে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করায় সার্বিকভাবে রাশিয়ার আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সংকুচিত হয়ে আসছে, যা বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থাকে ব্যাহত করছে। রাশিয়া-ইউক্রেইন সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে তা বৈশ্বিক অর্থনীতির কোভিড-পরবর্তী পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রতিবারের মত এবারও তিনি বাজেট প্রণয়নের আগে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনসমূহ, অর্থনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের সাথে আলোচনা করেছেন। মন্ত্রণালয়/বিভাগ এবং বিভিন্ন সংগঠন থেকে বাজেটের উপর প্রস্তাব নিয়েছেন। সব আলোচনা ও প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে আগামী অর্থবছরের ছয়টি প্রধান চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছেন। সেগুলো হল-
১. মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা
২. গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের মূল্যবৃদ্ধিজনিত বর্ধিত ভর্তুকির জন্য অর্থের সংস্থান
৩. বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ব্যবহার এবং মন্ত্রণালয়/বিভাগের উচ্চ-অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করা
৪. শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন
৫. অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজন কর সংগ্রহের পরিমাণ এবং ব্যক্তি আয়করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি করা
৬. টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখা
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এ সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের অত্যন্ত কৌশলী হতে হবে। কোনো একটি সমস্যা সঠিকভাবে সমাধান করা না গেলে তা সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে পারে।’
মুস্তফা কামাল এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বিদ্যমান চাহিদার লাগাম টেনে সরবরাহ বাড়ানোকেই মূল কৌশল ভাবছেন।
তিনি বলেন, ‘সে লক্ষ্যে আমদানিনির্ভর ও কম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ব্যয় বন্ধ রাখা অথবা হ্রাস করা হবে। নিম্ন অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়নের গতি হ্রাস করা হবে এবং একইসময়ে উচ্চ ও মধ্যম অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা হবে।
‘জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের বিক্রয়মূল্য পর্যায়ক্রমে ও স্বল্প আকারে সমন্বয় করা হবে। রাজস্ব আহরণ কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষ্যে কর সংগ্রহে অটোমেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে এবং মূল্য সংযোজন কর ও আয়করের নেট বৃদ্ধি করা হবে। বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহিত করা হবে এবং আন্ডার/ওভার ইনভয়েসিংয়ের বিষয়টি সতর্ক পর্যবেক্ষণে রাখা হবে।’
একইসঙ্গে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ‘প্রতিযোগিতামূলক’ রাখার চেষ্টার কথাও বলেন আ হ ম মুস্তফা কামাল।
তিনি বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতির প্রাণশক্তি হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি এবং দৃঢ় ও সাহসী নেতৃত্ব। সংগত কারণেই কোভিড-১৯ ও ইউক্রেইন যুদ্ধ উদ্ভূত অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবেলা করে দেশের সর্বস্তরের জনগণের জীবন-জীবিকা এবং সর্বোপরি ব্যাপক কর্মসৃজন ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখা এবারের বাজেটে প্রাধান্য পাবে।
‘বিগত দুই অর্থবছরে আমরা যেভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে করোনা মোকাবেলা করে দেশের অর্থনীতিকে মূল গতিধারায় ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলাম, অনুরূপভাবে আগামী অর্থবছরেও ইউক্রেন সংকট উদ্ভূত বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করে দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখব।’