সুপ্রভাত ডেস্ক »
ঘড়ির কাঁটা তখন মধ্যরাত ছুঁইছুঁই। চারপাশে নীরবতা। কেউ জানত না, আকাশের অনেক ওপরে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে ভয়ঙ্কর সব যুদ্ধবিমান। কেউ ভাবতেও পারেনি, যুক্তরাষ্ট্র ঠিক তখনই হামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
মাত্র দুই সপ্তাহ সময় বেঁধে দিয়েছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সবাই ধরে নিয়েছিল, হয়তো এটা কেবল হুঁশিয়ারি। কিন্তু শেষরাতে ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে সবাইকে চমকে দিলো যুক্তরাষ্ট্র।
মিজৌরি থেকে উড়ে আসা বি-২ বোমারু বিমানগুলো ৩৭ ঘণ্টার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছাল ইরানের আকাশে। এরপর ভূগর্ভস্থ ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনাসহ আরও দুটি কেন্দ্রে ফেলা হলো এক ডজন বাংকার বিধ্বংসী বোমা। একই সময়ে মার্কিন সাবমেরিন থেকে ছোড়া হলো ৩০টি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র।
ইরান বলছে, হামলার আগে ওইসব স্থাপনা খালি করে দেওয়া হয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তাদের লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস করা।
এ হামলা ইরান-ইসরায়েল চলমান উত্তেজনার ভেতরে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। অনেকেই বিশ্বাস করতেন, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে নামবে না। কিন্তু শনিবার রাতের আঘাত সেই বিশ্বাসকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এখন সবাই জানতে চাইছে—এই হামলার পর কী হবে? যুদ্ধ আরও ছড়িয়ে পড়বে, নাকি বন্ধুত্ব আর সংলাপের পথেই ফিরবে বিশ্ব?
নিউইয়র্ক টাইমস–এর এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ বোমারু বিমানগুলো মিজৌরি অঙ্গরাজ্যের হোয়াইটম্যান বিমানঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করে প্রায় ৩৭ ঘণ্টা টানা উড়ে ইরানের ফর্দো পারমাণবিক কেন্দ্রে পৌঁছে এক ডজন বাংকারবিধ্বংসী বোমা ফেলে। মাঝ আকাশে একাধিকবার জ্বালানি নেওয়ার পর বিমানগুলো তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছায়। এই অভিযানে মার্কিন বিমানবাহিনী প্রথমবারের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করে ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের ‘জিবিইউ-৫৭’ বাংকার-বাস্টার বোমা।
একই সময়ে, ইরানের নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর সাবমেরিন থেকে ছোড়া হয় অন্তত ৩০টি টিএলএএম ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের দাবি, এসব হামলার মূল লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ সক্ষমতা ধ্বংস করা।
যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ স্পিরিট বোমারু বিমানগুলোকে ধরা অত্যন্ত কঠিন। এসব বিমানে ‘স্টিলথ’ প্রযুক্তি ব্যবহৃত হওয়ায় রাডার সিগন্যাল খুব সামান্য প্রতিফলিত হয়। এটি এতটাই উন্নত প্রযুক্তির যে, রাডারে এর প্রতিচ্ছবি অনেক সময় একটি ছোট পাখির চেয়েও কম দেখা যায়। ফলে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার জন্য বি-২ একটি চরম চ্যালেঞ্জ।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, হোয়াইট হাউজে নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বৈঠকের আগেই এই হামলার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। হামলায় ব্যবহৃত বিমানগুলোকে প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে গুয়াম বা দিয়েগো গার্সিয়া ঘাঁটিতে পৌঁছানোর সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু তারা সরাসরি ইরানে প্রবেশ করে হামলা চালিয়ে ফিরে আসে।
তেহরান হামলার সত্যতা স্বীকার করলেও জানায়, ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো আগেই খালি করা হয়েছিল। তবে তারা এই হামলাকে ‘আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। পাশাপাশি, প্রতিশোধ নেওয়ার কথাও জানিয়েছে ইরানের শীর্ষ সামরিক নেতৃত্ব।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেকেই ধারণা করেছিলেন ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিলেও সরাসরি যুদ্ধের পথে হাঁটবেন না। কিন্তু এই হামলার মাধ্যমে সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করলেন তিনি। ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা মানে শুধু একটি সামরিক অভিযান নয়, বরং এক ধরনের যুদ্ধঘোষণা। এখন বিশ্বের নজর ইরানের পাল্টা পদক্ষেপের দিকে। পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায়, তা নির্ভর করছে তেহরানের পরবর্তী সিদ্ধান্তের ওপর।