আবদুল মান্নান »
২৩ জুন ২০২১ সাল বাঙালির বাতিঘর, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বাহাত্তরতম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। এই শুভ দিনে এই দলের প্রতিষ্ঠার সাথে যারা জড়িত ছিলেন তাঁদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি । স্মরণ করছি সেই মহাপুরুষ, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যিনি এই দল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন, তাঁকে । শুরুতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ তারপর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ যা উপমহাদেশের অন্যতম বৃহত্তম ও প্রাচীন রাজনৈতিক দল। সাতচল্লিশ পূর্ববর্তী সময়ে যে ক’টি রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগ অন্যতম । এই সব দলের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি বহুধাবিভক্ত হয়েছে, কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর দলটি দেশ শাসন করেছে বহুবছর, বর্তমানে নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে দলটি অনেকটা ছত্রভঙ্গ। মুসলিম লীগ পাকিস্তান শাসন করেছে বটে কিন্তু কখনো নির্বাচনের মুখোমুখি হয়নি। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলায় প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে তারা মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্টের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল ।
শোষণহীন স্বাধীন পাকিস্তানের বাঙালি প্রথম ধাক্কা খেলো ১৯৪৮ সালে, যখন পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ঘোষণা করলেন পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। জিন্নাহর এই ঘোষণার প্রথম প্রতিবাদ করে ঢাকার জনগণ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যার মধ্যে তরুণ শেখ মুজিবও ছিলেন । তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র । গড়ে ওঠে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন। শেখ মুজিব জানতেন সংগঠন ছাড়া কোন আন্দোলন সফল হয় না । ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জন্ম হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের । ছাত্রলীগ গঠনের পেছনে শেখ মুজিব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও তিনি কোন পদপদবির জন্য মরিয়া ছিলেন না যা বর্তমান রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেখ মুজিব সহ তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীরা তখন বুঝেছিলেন শুধু ছাত্র সংগঠন দিয়ে কোন আন্দোলন সফল করা দুরূহ কাজ । ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে শেখ মুজিব ও অন্যান্যদের প্রচেষ্টায় গঠিত হলো পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, পাকিস্তানের প্রথম রাজনৈতিক দল। মাওলানা ভাসানী সভাপতি আর শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক । শেখ মুজিবকে করা হলো যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক । আওয়ামী লীগ গঠনের সময় শেখ মুজিব জেলে ছিলেন ।
১৯৪৯ সাল হতে ২০২১ সাল আওয়ামী লীগের ইতিহাস এক মহাকাব্য । এই দলের ইতিহাসের সমতুল্য ইতিহাস উপমহাদেশে আর কোন রাজনৈতিক দলের নেই । পরিবর্তীকালে আওয়ামী মুসলিম লীগ হতে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয় যাতে দলটি অসাম্প্রদায়িক চরিত্র পায়। মুসলিম লীগের বিপরীতে আওয়ামী লীগ ছিল জনমানুষের দল। দলটি সব সময় বাঙালির ন্যায্য দাবির জন্য লড়াই করেছে, আন্দোলন করেছে, নেতা কর্মীরা জেলে গিয়েছে, রাজপথে প্রাণ দিয়েছে। জন্মের পর হতে আওয়ামী লীগের পথচলা কখনো কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। দলটি নিষিদ্ধ হয়েছে কয়েকবার । দলে ভাঙন হয়েছে একাধিকবার। ১৯৬৬ সালে দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণা করলে দলের সভাপতি আবদুর রসিদ তর্কবাগীশ দল হতে পদত্যাগ করেন । দলের সভাপতি নির্বাচিত হন দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান আর সাধারণ সম্পাদকের হাল ধরেন তাজউদ্দিন আহমদ। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ চলেছে আওয়ামী লীগ হতে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের দ্বারা গঠিত প্রবাসী সরকার দ্বারা আর তাঁরা চালিত হয়েছেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ দ্বারা। বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগকে নূতন জীবনদানে এগিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধুর পুরানো সহকর্মীরা। ১৯৭৫ সালের পনেরই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়া পুনরায় আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন । জন্মলগ্ন হতে সকল অগণতান্ত্রিক সরকার আওয়ামী লীগকে তাদের শত্রু মনে করেছে কারণ আওয়ামী লীগ জনগণের কথা বলে আর ধর্মনিরপেক্ষ ও জনবান্ধব রাজনীতির চর্চা করে । অন্যদিকে যতবারই অগণতান্ত্রিক শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে ততবারই তারা ধর্মকে পুঁজি করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছে ।
বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করার পর দলের হাল ধরেছিলেন শহীদ তাজউদ্দিনের স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন । বঙ্গবন্ধুর দুই জীবিত কন্যা শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা তখন নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। ১৯৮১ সালে দলের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। মে মাসে তিনি ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফিরে দলের হাল ধরেন। ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ একুশ বছর পর বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে সরকার গঠন করে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের দলীয় সমর্থকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে । তখন হত্যা, ধর্ষণ, ভিটে মাটি হতে উচ্ছেদ আর নির্যাতন হয়ে ওঠে তাদের প্রধান কাজ। দেশের এই কঠিন সময়ে নির্যাতিতদের পাশে এসে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ ও দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। বেগম জিয়ার পরবর্তী চার বছরের মেয়াদে শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা করা হয় একাধিকবার।
২০০৮ সালের নির্বাচনে পুনরায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে এবং এই পর্যন্ত দলটি লাগাতার তিন মেয়াদে সরকার পরিচালনা করছে । এই তিন মেয়াদে সম্পূর্ণ বদলে গেছে বাংলাদেশ । হয়ে উঠেছে উন্নয়নের রোল মডেল । আর শেখ হাসিনা একটি স্বল্পোন্নত দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে এখন শুধু উন্নয়নশীল ও মধ্যম আয়ের দেশের প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি একজন বিশ্বস্বীকৃত রাষ্ট্রনায়ক। বঙ্গবন্ধু যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন তাতে তিনি সাথে পেয়েছেন একঝাঁক নিবেদিতপ্রাণ নিঃস্বার্থ নেতা কর্মী যদিও দলে খন্দকার মোশতাকের মতো ব্যক্তিরাও ছিলেন। শেখ হাসিনা ততটা ভাগ্যবতী নন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের আওয়ামী লীগে স্বার্থান্ধ লোকজনের সংখ্যাই বেশি। তারা শুধু সুযোগের অপেক্ষায় । বঙ্গবন্ধুর সময় যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন তাঁরা ছিলেন খাঁটি রাজনীতিবিদ । আর এখন যারা আওয়ামী লীগ করেন তাদের বড় সংখ্যা ব্যবসায়ী যাদের চৌদ্দগুষ্টির সাথে আওয়ামী লীগের কোন সম্পর্ক ছিল না । রাজনীতি করার পিছনে তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ব্যবসায়িক স্বার্থ । আর এক দল আছে যারা দলকে পুঁজি করে আখের গোছাতে ব্যাস্ত ।
বঙ্গবন্ধু বলতেন ‘আমলা নয় মানুষ সৃষ্টি করুন’ । আর এখন আমলারা দেশের সর্বময় কর্তা । তারা মনে করেন তারাই একমাত্র মানুষ এবং তাদের ছাড়া সব কিছু অচল । বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগে নেতা নেত্রীদের সাথে জনগণের সরাসরি সম্পর্ক ছিল । দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু নিয়মিতভাবে বিকেলে পুরানো গণভবনের গেইটে এসে অপেক্ষমাণ সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলতেন । নানা কারণে বর্তমানে শেখ হাসিনার পক্ষে তা সম্ভব নয় । বর্তমান সময়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে বেশ কিছু অযোগ্য ব্যক্তি বসে আছেন যাদের কারণে সরকারের দুর্নাম হয় । অন্যদিকে এক শ্রেণির আমলা আছেন যারা শেখ হাসিনাকে জনগণ হতে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে সদাতৎপর। এতসব কিছুর পরও এখনো এই দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে মনে করে তাদের শেষ ভরসাস্থল, শেষ বাতিঘর। দেশে কোন দুর্যোগ নেমে এলে তাদের বিশ্বাস সে দুর্যোগ হতে তাদের উদ্ধার করবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ । এটি তারা তাদের অতীত অভিজ্ঞতা হতে বিশ্বাস করে। তবে এই আস্থা, এই বিশ্বাস শেখ হাসিনা পরবর্তিকালের আওয়ামী লীগে থাকবে কিনা তা কোটি টাকার প্রশ্ন। জয়তু বঙ্গবন্ধু, জয়তু শেখ হাসিনা । বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে তার প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে প্রাণঢালা অভিনন্দন ।
লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক