পঙ্কজ শীল »
সুন্দরবনে বাস করত এক বুড়ো বাঘ। সবাই তাকে ডাকত বাঘমামা বলে। এখন তার দাঁত কম, গর্জনেও আগের মত তেজ নেই, দৌড়ালে হাঁপিয়ে ওঠে, তবু জঙ্গলের সকলেই তাকে ভয় পায়। আসলে ভয় নয়, অনেকটা শ্রদ্ধা মেশানো ভয়। কারণ বাঘমামা একসময় ছিলেন ভয়ানক সাহসী আর পরাক্রমশালী। এখন সে অবসরপ্রাপ্ত বাঘ! শিকার ছেড়ে দিয়েছে, মাছ আর ফল খেয়ে কাটিয়ে দেয় দিন।
তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঘমামার এক নতুন ইচ্ছে জন্মেছে। ইচ্ছে, সে এবার মানুষ হবে!
একদিন এক বনের স্কুলে হঠাৎ ঢুকে পড়ল বাঘমামা। বনজ স্কুলে হরিণছানা, বানর, কচ্ছপ, খরগোশ, ময়ূর সবাই পড়তে আসে। শিক্ষক ছিলেন পেঁচা স্যার। গম্ভীর, জ্ঞানী, ধীরে ধীরে কথা বলেন, আর সবচেয়ে বড় কথা, কারও চোখে চোখ রাখতে পারেন বলে সবাই তাকে ভয় পায়।
বাঘমামা স্কুলে ঢুকে গর্জন করল, তবে গলা কাঁপছিল, তাই গর্জনটা অনেকটা হাঁচির মতো শোনাল। সবাই থেমে তাকাল তার দিকে। পেঁচা স্যার বললেন, ুএই বুড়ো বয়সে স্কুলে আসার কারণ কী?’
বাঘমামা বসে পড়ল এক কোণায়। বলল, “আমি মানুষ হতে চাই স্যার! মানুষরা নাকি অনেক জ্ঞানী, তারা সাইকেল চালায়, মোবাইলে কথা বলে, হেলিকপ্টারে চড়ে, গল্প লেখে, গান গায়! আমিও মানুষ হয়ে সেইসব করব।”
বনজ স্কুলে হাসির ঝড় উঠল। বানর মুচকি হাসল, হরিণছানারা ফিসফিস করতে লাগল। ময়ূর বলল, “তুমি তো বাঘ! মানুষ হবার স্বপ্ন কেন?”
বাঘমামা বলল, “কারণ মানুষ হলে আর কেউ ভয় পাবে না। কেউ বলবে না ‘বাঘ এসেছে পালাও’। মানুষ হলে হয়তো বন্ধুরা চা খেতে ডাকবে, কেউ ফেসবুকে ছবি দেবে ‘বাঘ ভাইয়ের সঙ্গে সুন্দর সন্ধ্যা’। আমি চশমা পরে হাঁটবো, কেউ ভয় পাবে না। শুধু বলবে, ‘আহা, কী জ্ঞানী বাঘ!’’’
পেঁচা স্যার চিন্তায় পড়ে গেলেন। বললেন, “তুমি যদি সত্যি মানুষ হতে চাও, তবে তোমাকে আমাদের নিয়মে চলতে হবে। স্কুলে ভর্তি হতে হবে, অ আ ক খ শিখতে হবে, পরীক্ষায় পাশ করতে হবে, জ্ঞান অর্জন করতে হবে, আর সবচেয়ে বড় কথা বন্ধু হতে হবে সকলের।”
বাঘমামা রাজি হয়ে গেল। সে পরদিন থেকে স্কুলে যেতে লাগল। ছোটদের সঙ্গে বসে “ওই অজগর আসছে তেড়ে?” পড়ত, “চাঁদ উঠে ছিল গগনে” গাইত। কচ্ছপের সঙ্গে খাতা ভাগ করত, বানরের সঙ্গে আঁকার খাতা আদানপ্রদান করত।
প্রথম প্রথম সমস্যা হচ্ছিল খুব। তার পা বড়, ডেক্স ভাঙে, কলম হাতে আটে না। কিন্তু ধীরে ধীরে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠল।
একদিন হরিণছানা রুবি বলল, “বাঘমামা, তুমি এখন সত্যি অনেক বদলে গেছ। তুমি কাউকে ভয় পাও না, তুমিও কাউকে ভয় দেখাও না।”
বাঘমামা হেসে বলল, “আগে ভয় দেখিয়ে রাজা ছিলাম, এখন ভালোবেসে বন্ধু হচ্ছি। রাজা হলে সবাই সামনে হাঁটে মাথা নিচু করে, বন্ধু হলে সবাই কাছে আসে হাত বাড়িয়ে।”
স্কুলে “মানুষ হবার প্রতিযোগিতা” নামক এক মজার আয়োজন হলো। সবাইকে মানুষ হবার অভিনয় করতে হবে। বানর মানুষ সেজে মোবাইল নিয়ে ছবি তুলল, খরগোশ সেজে জ্যাকেট পরে হেঁটে গেল, ময়ূর গান গেয়ে মঞ্চ মাতাল।
শেষে এলো বাঘমামার পালা। সে সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি মানুষ হতে চাই না, আমি মানুষের মতো মানুষ হতে চাই। যার ভেতরে থাকবে মায়া, দয়া, বন্ধুত্ব। মানুষ হয়েও যারা গাছ কেটে বন উজাড় করে, নদী নোংরা করে, পশুকে খাঁচায় ভরে রাখে তাদের মতো মানুষ হতে চাই না।”
পুরো বনজ স্কুল চুপ হয়ে গেল। কেউ হাসল না, কেউ কাঁদল না, শুধু পেঁচা স্যার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “বাঘমামা, তুমি আজ আমাদের সবচেয়ে বড় পাঠ দিয়ে গেলে। তুমি যদি সত্যিই মানুষ হতে চাও, তবে এমনই হও যে ভালোবাসে, শেখে, শেখায় আর কখনো কাউকে কাঁদায় না।”
সেদিন থেকে বনজ স্কুলে নতুন নিয়ম হলো মানুষ হবার পাঠ শুধু বইয়ে নয়, মনেও হবে!” আর বাঘমামা? সে এখন স্কুলের সবচেয়ে প্রিয় “মামা”। সে গল্প বলে, কবিতা লেখে, আঁকতে শেখায়, মাঝে মাঝে হালকা গর্জন দেয়, ভয় দেখাতে নয়, সবাইকে হাসাতে।
তার সেই গর্জন এখন জঙ্গলে নতুন নাম পেয়েছে, “হাসির গর্জন”।
আর মানুষ হবার ইচ্ছেটা?
সে এখন বাঘমামার গল্পে থাকে, শিশুর মুখে মুখে ফেরে, আর প্রতিটি প্রাণী শেখে মানুষ হতেই হবে এমন নয়, মনুষ্যত্ব থাকলেই হলো!