অরূপ পালিত »
তুমি ফিরবে জানি বহুদিন পরে
হয়তো বা হাজার বছর পরে।
কোন এক নিঃস্ব হৃদয়ে,
লক্ষ প্রাণের ভিড়ে, তুমি ফিরবে।
বহুরুপে সেই প্রাণে, অনেক নবীনের ভিড়ে,
তোমার আমার গড়া ভালবাসার নীড়ে। / (তুমি ফিরবে)
খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার নেই। আমার মানতে কষ্ট হয়। আমার বেশ ইচ্ছে ছিল সামনাসামনি একটুখানি বসে কথা বলার, দুচোখে দেখার। হৃদয়ের কিছু কিছু চাওয়া এবং কথা অতৃপ্ত থেকে যায় সবারই। আমার একটি জানার ইচ্ছে অজানা থেকে যাবে।
প্রিয় কালপুরুষ উপন্যাসের বইয়ের ”প্রচ্ছদে” পায়ে তীরবিদ্ধ কেন?
আমিতো সেখানে মানবতার আহ্বানের প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়েছিলাম। কিছু-কিছু গল্প সমাপ্ত বললে শেষ হয় না। ক্ষুধার্ত পাঠকের হৃদয়ে অতৃপ্তের রেশ থেকে যায়। তেমন কিছু উপন্যাস এবং গল্প আমার অতৃপ্তি রয়ে গেছে। উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ পড়ে আমার মতো অনেকেই বলবে। কালবেলা উপন্যাসটি আমি পড়েছি ৯২ কি ৯৩ সালে, অনিমেষের মাধবীলতাকে আমার সারাজীবন মনে থাকবে। যে বিষয়টি আমার কাছে গল্প লেখার অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করে! সেটা মাধবীলতার ত্যাগ। কয়েকবার পড়ার পরও তৃষ্ণা মেটাতে পারিনি। গল্পকার এই উপন্যাসটিতে শুধু
অ-মিলনের খেলা করে গেছেন।
বাংলাদেশের এই মেয়ে, যে কিনা শুধু ধুপের মত নিজেকে পোড়ায় আগামীকালকে সুন্দর করতে। দেশ গড়ার জন্যে বিপ্লবের নিষ্ফল হতাশায় ডুবে যেতে যেতে অনিমেষ আাবিষ্কার করেছিল বিপ্লবের আর এক নাম মাধবীলতা। এই কালজয়ী উপন্যাসের জনক সমরেশে মজুমদার কলমের খোঁচায় পাঠকের হৃদয়ে খেলা করেছেন। উনি পাঠককে রেখেছেন ‘দৌড়’ এর মাঝে। কোন উপন্যাসটি আগে পড়বেন। ‘দৌড়’ উপন্যাসটি তরুণ পাঠকের মাঝে সারা জাগিয়েছিল। বাঙালি মধ্যবিত্তের ১৯৭০ এর রাজনৈতিক টালমাটাল সময়ের চিত্র তিনি তুলে এনেছেন। রাকেশ এবং সুহাস নামক দুই যুবককে দিয়ে উনি পুরো গল্পের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছেন। রাকেশের চাকরিটা চলে যাবার কারণ পূর্বের ছাত্র জীবনের ‘পলিটিক্স’। তিনি ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের বাস্তব চিত্র আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। আর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র যার শিল্প সাহিত্যের চর্চায় দিন কাটত তিনি লোভে পড়ে বনে গেছেন জুয়ারি। সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস মানে সমাজের চিত্রকে পাল্টানো। আমার প্রিয় মানুষটিকে উপহার দিয়েছিলাম ’কালবেলা এবং ‘সাতকাহন’ সে যেন মাধবীলতা ও দীপাবলির মতো করে জ্বলজ্বল করে ওঠে। চা বাগানে বড় হওয়া দীপাবলির ব্যক্তিজীবনের লড়াই আমাদের সমাজের বহু নারীর কথা রূপায়িত করে। শত দুঃখেও নারীকে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে দেওয়া যাবে না।
ওনার এই দুইটি কথা মনে রাখার মতোঃ
ক) মেয়েরা গণেশের মত, মা দূর্গার চারপাশে পাক দিয়ে যে জগত দেখে তাতেই তৃপ্তি আর পুরুষরা কার্তিকের মত সারা পৃথিবী ঘুরে আসে অথচ কী দেখে তা তারাই জানে না। – সমরেশ মজুমদার (মেয়েরা যেমন হয়)।
খ) তুমি যদি জিততে চাও তাহলে তোমাকে নির্মম হতে হবে। অভিযানে বেরিয়ে দলের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে অভিযান বাতিল হয় না। অসুস্থকে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। সেই উপায় না থাকলে তাকে ফেলে রেখেই এগোতে হবে। এক্ষেত্রে দয়া-মায়া ইত্যাদি ব্যাপারগুলো খুবই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। কোনও কোনও মানুষ জীবনের নির্দিষ্ট লক্ষে এগিয়ে যাওয়ার সময় এমনই কঠোর হন। তাদের নিষ্ঠুর বলা হয়। ইতিহাস ওইসব মানুষের জন্য শেষ পর্যন্ত জায়গা রাখে। – সমরেশ মজুমদার (মনের মত মন)।
দুই বাংলার পাঠকের নয়নমণির জন্ম ১৯৪৪ সালে ১০ই মার্চ উত্তরবঙ্গের গয়েরকাটায়। প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে। তিস্তা আর আংরাভাসা নদীর নির্মল বাতাস গায়ে মেখে পিতা কৃষ্ণদাস মজুমদার ও মাতা শ্যামলী দেবীর সাথে ডুয়ার্সের গয়েরকাটা চা বাগানে কাটিয়েছেন শৈশব। ভবানী মাস্টারের পাঠশালায় তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু। এরপর বিদ্যালয়ের পাঠ জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে হয়। ডুয়ার্সের চা-বাগানের জীবন নিয়ে তাঁর অনেক গল্প ও উপন্যাসে উঠে এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পোড়া গন্ধের আর দেশে উত্তাল স্বাধীনতা আন্দলোনের মাঝে বড় হওয়া।
ষাটের দশকের গোড়ায় তিনি কলকাতায় এসেছিলেন। ভর্তি হয়েছিলেন স্কটিশ চার্চ কলেজের বাংলা বিভাগের (সাম্মানিক) স্নাতক স্তরে। এরপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
কর্মজীবন ও সাহিত্য চর্চা
কর্মজীবনে তিনি আনন্দবাজার পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড এর সাথে যুক্ত ছিলেন। গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি তাঁর প্রচন্ড আসক্তি ছিলো। তার প্রথম গল্প ‘অন্যমাত্রা’ লেখাই হয়েছিলো মঞ্চনাটক হিসেবে। আর সেখান থেকেই তাঁর লেখকজীবনের শুরু। তাঁর লেখা ‘অন্যমাত্রা’ ছাপা হয়েছিলো দেশ পত্রিকায় ১৯৬৭ সালে। সমরেশ মজুমদারের প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’ ছাপা হয়েছিলো দেশেই ১৯৭৫ সালে। তিনি শুধু তাঁর লেখনী গল্প বা উপন্যাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি; ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি থেকে গোয়েন্দা কাহিনি, কিশোর উপন্যাস লেখনীতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তাঁর প্রত্যেকটি উপন্যাসের বিষয় ভিন্ন, রচনার গতি এবং গল্প বলার ভঙ্গি পাঠকদের আন্দলিত করে। চা বাগানের মদেসিয়া সমাজ থেকে কলকাতার নিম্নবিত্ত মানুষেরা তাঁর কলমে উঠে আসেন রক্ত-মাংস নিয়ে। সমরেশ মজুমদারের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলির মধ্যে সাতকাহন, তেরো পার্বণ, স্বপ্নের বাজার, উজান, গঙ্গা, ভিক্টোরিয়ার বাগান, আট কুঠুরি নয় দরজা, অনুরাগ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তার ট্রিলজি ‘উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ’ বাংলা সাহিত্য জগতে তাঁকে বিশেষ খ্যাতির অধিকারী করেছে। লিখেছেন দুহাত ভরে। গল্প, স্মৃতিকথা, ভ্রমনকাহিনী কোথাও থামেননি।
লেখকের ঝুড়িতে রয়েছে অনেক সাহিত্যকীর্তির স্বীকৃতি
অনেক অসাধারণ লেখনীর শব্দের এই রূপকার জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কার অর্জন করেছেন।
আনন্দ পুরস্কার -১৯৮২
বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার,
দিশারী ও চলচ্চিত্র প্রসার সমিতি – শ্রেষ্ঠ স্ক্রিপ্ট রাইটার – ১৯৮২
সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার-১৯৮৪
বঙ্কিম পুরস্কার – ২০০৯
বঙ্গবিভূষণ – ২০১৮, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত।
১৯৮২ সালে আনন্দ পুরস্কার,
১৯৮৪ সালে সাহিত্য আকাদেমী পুরস্কার, বঙ্কিম পুরস্কার এবং আইয়াইএমএস পুরস্কার জয় করেছেন। চিত্রনাট্য লেখক হিসেবে জয় করেছেন বিএফজেএ, দিশারী এবং চলচ্চিত্র প্রসার সমিতির অ্যাওয়ার্ডসহ অজস্র সন্মানে ভূষিত তিনি।
সমরেশ মজুমদার কলকাতা এবং বাংলাদেশ এর সর্বকালের অন্যতম সেরা লেখক হিসাবে পাঠকমন জয় করেছেন।
এই যেন এক রাজার বিদায়
আগে থেকেই সিওপিডিও সমস্যায় ভুগছিলেন লেখক। সাথে ছিল (স্লিপ অ্যাপনিয়া) ও ঘুমের মধ্যে শ্বাসকষ্টের সমস্যা। ২০২৩ সালের ২৫ই এপ্রিল মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ জনিত সমস্যার কারণে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানেই ৮ই মে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
মৃত্যু চিরন্তন সত্য! কিন্তু সমরেশ মজুমদারের মতো কথাসাহিত্যিকের অবসান বলতে নেই। তিনি তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে পাঠকের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন সারাজীবন।